মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ

প্রকাশনার সময়: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:০৫

সাকিব আল হাসানের ব্যাট থেকে গুলির বেগে বল ছুটে গেল বাউন্ডারিতে। স্টাম্প মাইকে শোনা গেল গর্জন। নিশ্চিতভাবেই তা মুশফিকুর রহিমের বজ্র হুঙ্কার! টিভি পর্দায় দেখা গেল, ড্রেসিং রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছেন নাজমুল হোসেন শান্তও। মাঠ থেকে ড্রেসিং রুম হয়ে পুরো মাঠে, রাওয়ালপিন্ডি হয়ে গতকাল গোটা পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ল যেন সেই আওয়াজ। পাকিস্তানের বুকে বাংলাদেশের বিজয় উল্লাস! জয়ের সুবাস মেখে যে দিনের শুরু, স্থানীয় সময় দুপুর আড়াইটায় সেই আবেশে মাখামাখি হলো বাংলাদেশ দল। দ্বিতীয় টেস্টে পাকিস্তানকে ৬ উইকেট হারিয়ে ঐতিহাসিক এক সিরিজ জয়ে নিজেদের রাঙাল নাজমুল হোসেন শান্তর দল। এর মধ্য দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে নতুন দিন শুরু হলে। এই জয়ে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। অভিনন্দনবার্তায় তিনি বলেছেন, ‘জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে দেশে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, তারই সুফল পাওয়া যাচ্ছে ক্রীড়াঙ্গনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। পাকিস্তানকে টেস্টে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশ করা কিংবা সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জেতা, সবকিছুই নতুন বাংলাদেশের প্রতিফলন।’

দেশের বাইরে বাংলাদেশের মাত্র দ্বিতীয় সিরিজ জয় এটি। তবে পূর্ণ শক্তির কোনো দলের বিপক্ষে এটিই প্রথম। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ২-০ ব্যবধানে জিতলেও সেবার চুক্তি সংক্রান্ত ঝামেলায় খেলেননি শীর্ষ ক্রিকেটারদের কেউ। বাংলাদেশ সিরিজ জিতেছিল দ্বিতীয় সারির দলের বিপক্ষে। এবারের জয় তাই অনেক বেশি স্পেশাল, আরও বেশি স্মরণীয়। শেষ ইনিংসের ১৮৫ রান তাড়ায় শেষ দিনে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ১৪৩ রান। সেই লক্ষে খুব দ্রুততায় ছুটতে পারেনি দল। তবে প্রয়োজনও পড়েনি। ম্যাচ সব সময়ই ছিল নিয়ন্ত্রণেই। রান তাড়ায় কখনো মনে হয়নি বাংলাদেশ হারতে পারে।

ফিফটি করতে পারেননি কোনো ব্যাটসম্যান। কয়েক জনের অবদানে বেশ সহজেই জিতে গেছে বাংলাদেশ। গোটা সিরিজেরই প্রতীকী বলা যায় এই শেষ ইনিংস। সম্মিলিত দলীয় পারফরম্যান্সের জয়গান গেয়েই অসাধারণ এ সিরিজ জয়ের সাফল্য ধরা দিয়েছে।

নিজেদের সুদীর্ঘ টেস্ট ইতিহাসে আগে কেবল একবারই দেশের মাঠে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল পাকিস্তান। ২০২২ সালে তারা তিন ম্যাচের সিরিজের সবকটি হেরেছিল ইংল্যান্ডের কাছে।

এই দিনের বাস্তবতায় বাংলাদেশের জয়টাই ছিল সবচেয়ে সম্ভাব্য ফল। কিন্তু ম্যাচের তৃতীয় দিনে (কার্যত যা ছিল দ্বিতীয় দিন) ফিরে গেলে, ২৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে যখন ধুঁকছিল বাংলাদেশ, মান বাঁচানোই যখন মনে হচ্ছিল বড় দায়, সেখান থেকে এভাবে ম্যাচ জয় তো রূপকথার মতোই। বাংলাদেশের ইতিহাসে তো বটেই, টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসেই আলাদা জায়গা নিয়ে থাকবে এই জয়।

প্রথম ইনিংসে এত কম রানে ৬ উইকেট হারিয়েও জয় টেস্ট ক্রিকেটে দেখা গেল ১৩৭ বছর পর! সেই ১৮৮৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ১৭ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ও পরে ৪৫ রানে অলআউট হয়েও শেষ পর্যন্ত ১৩ রানে ম্যাচ জিতেছিল ইংল্যান্ড। এবার বাংলাদেশও এই রেকর্ডে তাদের সঙ্গী। দিনের শুরুতে পাকিস্তানি পেসারদের বোলিং ছিল বেশ আঁটোসাঁটো। দ্বিতীয় বলে সাদমান ইসলাম একটি চার মারলেও পরে শট খেলার সুযোগ খুব একটা পাননি দুই ব্যাটসম্যান।

সকাল থেকে দারুণ বোলিং করতে থাকা মির হামজা পাকিস্তানকে এনে দেন প্রথম সাফল্য। তার দুর্দান্ত ডেলিভারি জাকির হাসানের ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে ছোবল দেয় স্টাম্পে। আগের দিন ২৩ বলে ৩১ রান করা ওপেনার আউট হন ৩৯ বলে ৪০ রান করে।

একটু পর হামজার বলেই রক্ষা পান সাদমান। স্লিপে কঠিন ক্যাচ তালুবন্দি করতে পারেননি সালমান আলি আঘা। তবে পরের ওভারেই ফাঁদে পা দেন এই ওপেনার। বারবার তাকে ড্রাইভ করতে প্রলুব্ধ করছিলেন পাকিস্তানি বোলাররা। ড্রাইভ খেলেই মিড অফে সহজ ক্যাচ দেন তিনি ২৪ রান করে।

এরপর কিছটা অস্বস্তিময় সময় এসেছে নাজমুল হোসেন শান্ত ও মুমিনুল হকের জন্য। ব্যাটের কানায় লেগেছে বল, স্লিপ দিয়ে গলে গেছে কয়েক দফায়। তবে সব সামলে রানও বাড়াতে থাকেন দুজন। লাঞ্চের আগে জুটি পেরিয়ে যায় পঞ্চাশ।

লাঞ্চের পরপর শান্তকে হারায় বাংলাদেশ। সালমানকে রিভার্স সুইপে চার মারার পরের বলে শর্ট লেগে ক্যাচ দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক (৮২ বলে ৩৮)। টানা ৯ ইনিংসে ফিফটির দেখা পেলেন না তিনি। এর চেয়েও বড় আক্ষেপ হতে পারে এ দিন, জয়ের মুহূর্তটায় থাকতে পারলেন না ক্রিজে।

সেই সুযোগটি হারান মুমিনুলও। দীর্ঘক্ষণ লড়াই করে এক প্রান্ত থেকে দলকে টানছিলেন তিনি। ব্যাট করছিলেন বেশ সতর্কতায়। কিন্তু হঠাৎ আবরার আহমেদকে তুলে মেরে উইকেট হারান তিনি ৩৪ রানে (৭১ বলে)।

মুশফিকু রহিম ও সাকিব আল হাসান সেই ভুল করেননি। দলের অভিজ্ঞতম দুই ক্রিকেটার আস্তে আস্তে দলকে নিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। জয় নাগালে থাকার পরও অনেক সময় নিয়েছেন দুজন। ৩২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি এসেছে ১২ ওভারে।

‘জুলাই বিপ্লবের সুফল’: এদিকে পাকিস্তানকে ধবলধোলাই করে টেস্ট সিরিজ জয়ে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। অভিনন্দনবার্তায় তিনি বলেছেন, ‘জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে দেশে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, তারই সুফল পাওয়া যাচ্ছে ক্রীড়াঙ্গনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। পাকিস্তানকে টেস্টে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশ করা কিংবা সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জেতা, সবকিছুই নতুন বাংলাদেশের প্রতিফলন।’

ক্রীড়া ক্ষেত্রে সাফল্য পেতে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক বলয় থেকে ক্রীড়াঙ্গনকে মুক্ত রাখলে দেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রে আরো সাফল্য আসবে।’

ক্রীড়া উপদেষ্টার আশা, ক্রীড়াঙ্গনের প্রতিটি পর্যায়ে সাফল্যের এ ধারা অব্যাহত থাকবে।

পাকিস্তানকে ৬ উইকেটে হারিয়ে ২-০তে সিরিজ জিতে নিয়েছে বাংলাদেশ দল। পাকিস্তানের মাটিতে যেকোনো সংস্করণের ক্রিকেটে এটাই বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ জয়। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ও।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

পাকিস্তান প্রথম ইনিংস: ২৭৪ ও দ্বিতীয় ইনিংস: ১৭২

বাংলাদেশ: প্রথম ইনিংস: ২৬২ ও দ্বিতীয় ইনিংস: (লক্ষ্য ১৮৫, আগের দিন ৪২/০) ৫৬ ওভারে ১৮৫/৪ (জাকির ৪০, সাদমান ২৪, শান্ত ৩৮, মুমিনুল ৩৪, মুশফিক ২২*, সাকিব ২১*; হামজা ১/৪৬, শাহজাদ ১/৪০, আবরার ১/৪০ ও সালমান ১/১৭)

ফল: বাংলাদেশ ৬ উইকেটে জয়ী।

সিরিজ: দুই ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ ২-০ ব্যবধানে জয়ী।

ম্যাচসেরা : লিটন কুমার দাস।

সিরিজ সেরা : মেহেদী হাসান মিরাজ।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ