বিশ্বকাপের উত্তেজনা আর উন্মাদনা আজ তুঙ্গে। ফুটবল মহাযজ্ঞের উত্তাপের পারদ সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়ে ফেলেছে। হবেই বা না কেন? আজ যে ফুটবলের মহামঞ্চের ফাইনাল। শ্রেষ্ঠত্ব ছিনিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে পর্দা নামবে গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের। তাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু একটাই বিষয়— ফ্রান্স বিশ্ব শিরোপা ধরে রাখবে নাকি আর্জেন্টিনা ৩৬ বছর পর বিশ্বজয়ের খরা কাটাবে?
রোমাঞ্চকর শ্বাসরুদ্ধকর মহারণটি মাঠে গড়াবে বাংলাদেশ সময় আজ রাত ৯টায়। কাতারের লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে ফুটবলের বিশ্ব মুকুট কেড়ে নেয়ার সুযোগ আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স দু’দলের সামনেই। যারা জিতবে তাদের ঘরেই উঠবে তৃতীয় বিশ্বকাপ। আর কাইলিয়ান এমবাপের জন্য দেশের মতো টানা দ্বিতীয় বিশ্ব শিরোপা জয়ের সুবর্ণসুযোগ।
আর ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসির সামনে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের হাতছানি। ফাইনাল শেষে কার হাতে উঠবে সোনালি ট্রফি? কে হাসবেন শেষ হাসি? উত্তরটা পেতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন দুনিয়ার তাবত ফুটবলানুরাগীরা।
সন্দেহ নেই, আজকের হাইভোল্টেজ ফাইনাল হবে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। ফুটবল বিশেষজ্ঞরা আভাস দিচ্ছেন তেমনটাই। জমজমাট ফাইনালের আগে দু’দলই রণকৌশল ঠিক করে চলেছে। ফাইনালের ঠিক আগে আর্জেন্টিনার প্রাণভোমরা ও অধিনায়ক লিওনেল মেসির পুরোনো চোট মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
অনেকে শঙ্কা করছেন, খুদে জাদুকরের চোট ফাইনালে ভোগাতে পারে আর্জেন্টিনাকে। কিন্তু আবার অনেকে বিষয়টি তেমন গুরুতর নয় বলেই মনে করছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, মেসির থেকে ফরাসিদের দৃষ্টি যেন কিছুটা হলেও অন্যদিকে যায় এ কারণেই তার চোটের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে!
যদিও আর্জেন্টাইন অধিনায়ককে ফরাসিরা ভয় পাচ্ছে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন দলটির মিডফিল্ডার থিও হার্নান্দেজ। অন্যদিকে ফাইনালের আগে ফ্রান্সের ট্রাম্পকার্ড হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন তারকা ফরোয়ার্ড করিম বেনজেমা। চোটের কারণে শেষ মুহূর্তে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়া রিয়াল মাদ্রিদ সুপারস্টার ফাইনালে খেলতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। না খেললেও প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে তাকে সাইডবেঞ্চে রাখতে পারেন ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশমস।
তবে ফরাসি দলে হানা দিয়েছে ভাইরাস। দলের অনেকে সর্দিতে আক্রান্ত। বিশ্বকাপ জেতার পথে আর্জেন্টিনার সামনে মহাশক্তিশালী ফ্রান্স বড় বাধাই। নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়েই মেসিদের লড়তে হবে কিলিয়ান এমবাপে, অ্যান্তোনিও গ্রিজমানদের ফ্রান্সের সঙ্গে। এবার বিশ্বকাপে কিন্তু একটি জায়গায় আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের দারুণ মিল। গ্রুপ পর্বে দুই দলই নিজেদের ‘আরব’ প্রতিপক্ষের বিপক্ষে হেরেছে। আর্জেন্টিনা নিজেদের প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে হেরে গিয়েছিল।
ফ্রান্স হেরেছে তিউনিসিয়ার কাছে, গ্রুপের শেষ ম্যাচে। এর বাইরে অবশ্য যথেষ্ট দাপট দেখিয়েই দুই দল গ্রুপ পর্বের বাধা ডিঙিয়েছে। আর্জেন্টিনা পেছনে ফেলেছে মেক্সিকো ও পোল্যান্ডকে। ফ্রান্স ডেনমার্ক ও অস্ট্রেলিয়াকে। ফাইনালটি ফ্রান্স-আর্জেন্টিনা ম্যাচের আবরণে মেসি-এমবাপে লড়াইও। পিএসজির দুই সতীর্থ ফাইনালে দেশের শ্রেষ্ঠত্বের পাশাপাশি নিজেদের অর্জনের লড়াইয়েও মেতে উঠবেন। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত মেসি ও এমবাপে-দুজনেই পাঁচটি করে গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে আছেন।
‘গোল্ডেন বুট’ নিয়ে তো তারা দুজন লড়ছেনই, তারা খুব ভালোভাবেই আছেন ‘গোল্ডেন বল’ বা সেরা খেলোয়াড় হওয়ার লড়াইয়েও। তবে দিনের শেষে দুজনেরই মূল লক্ষ্য ২৪ ক্যারেট ওজনের সোনার ওই ট্রফিটি। যেটি দিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করবেন তারা। এই জায়গায় এমবাপে ‘অভিজ্ঞ’। তিনি ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ জিতেছেন। এবার জিতলে টানা দ্বিতীয়বার সেই অভিজ্ঞতা হবে। ২০১৪ সালে মেসি আর্জেন্টিনাকে নিয়ে ফাইনালে উঠেছিলেন। কিন্তু বিশ্বকাপ জেতা হয়নি তার।
এবারের বিশ্বকাপে এমবাপের যে পারফরম্যান্স, তাতে আর্জেন্টিনা-সমর্থকরা চিন্তিত হতেই পারেন। বিশেষ করে গোটা সময় বোতলবন্দি থাকার পরও এমবাপের যে কোনো ফাকফোঁকর বের করে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দেয়ার যে প্রবণতা, সেটিই চিন্তার মূল কারণ। ফাইনাল জিততে হলে আর্জেন্টিনাকে যে কোনো মূল্যে এমবাপেকে ঠেকাতে হবে। কোচ লিওনেল স্কালোনির মূল চিন্তা যে এমবাপে, সেটি না বললেও চলছে। একই কাজ করতে পারেন লিওনেল মেসিও। দিদিয়ের দেশমসের শিষ্যদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারেন এ ফুটবল মহাতারকা।
তবে আগের ম্যাচগুলোতে ইংল্যান্ড কিংবা মরক্কো যেভাবে এমবাপেকে সামলেছে, স্কালোনি সমাধান খুঁজে নিতে পারেন। আর্জেন্টিনার রক্ষণে থাকবেন নিকোলাস ওতামেন্দি ও ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো। এমবাপেকে সামলানোর দায়িত্ব থাকবে হয়তো লিসান্দ্রো মার্তিনেজের কাঁধে। তাকে নিচে নামিয়ে রক্ষণকে জমাট করতে পারেন স্কালোনি। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার গিদো রদ্রিগেজকে এ ম্যাচে খেলানো হতে পারে। তিনি মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচে খেলেছিলেন। খুব যে ভালো খেলেছিলেন তা নয়, তবে ফ্রান্সের বিপক্ষে তিনি কাজে লাগতে পারেন। তবে স্কালোনি নিশ্চয়ই বিশেষ পরিকল্পনা আঁটছেন। তবে বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে সেই পরিকল্পনা ঠিকঠাক কাজে লাগবে কিনা, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
তবে আর্জেন্টিনার বড় ভরসা অবশ্যই মেসি। তিনি যে ম্যাচের পরিস্থিতি খুব ভালো পড়তে পারেন, সেটি তিনি তার ক্যারিয়ারজুড়েই প্রমাণ করে দিয়েছেন। মেসি যে কোনো কিছুই করতে পারেন। আর্জেন্টিনার জন্য এটা একটা শক্তির দিক। তারা নিজেরা যেমন এমবাপেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, ঠিক তেমনি ফ্রান্সকেও ব্যস্ত থাকতে হবে মেসিকে নিয়ে। এমবাপে যেমন যে কোনো সুযোগে যে কোনো কাণ্ড ঘটিয়ে দিতে পারেন, মেসিও তা—ই। মেসি অনেক বেশি অভিজ্ঞও।
বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনার দেখা হয়েছে মোট তিন বার। এর মধ্যে আর্জেন্টিনার দুই জয়ের বিপরীতে ফরাসিরা জিতেছে একবার। সেটাও গত রাশিয়া বিশ্বকাপের রাউন্ড অব সিক্সটিনের ম্যাচে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ওই ম্যাচে ৩-৪ গোলে হেরেছিল আর্জেন্টিনা।
মেসিদের হারিয়ে ওই আসরের শিরোপা ঘরে তুলে নেয় ফরাসিরা। বিশ্বকাপে দু’দলের প্রথম দেখা হয় ১৯৩০ সালে বিশ্ব ফুটবলের প্রথম আসরে। আর দ্বিতীয় দেখা ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপে। দুই আসরেই আলবিসেলেস্তেদের বিপক্ষে ধরাশায়ী হয়েছিল ফরাসিরা। সবমিলিয়ে দু’দলের ১২ দেখায় আর্জেন্টিনা জিতেছে ৬ ম্যাচ। আর ফ্রান্স জিতেছে ৩ ম্যাচ। বাকি ৩ ম্যাচ ড্রয়ের খাতায় যোগ হয়েছে।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ