অফিসিয়ালি যুদ্ধ থামার পরবর্তী এক বছর বিশ্বনেতারা গণিমতের মাল হিসাব করতে ব্যস্ত থাকে। অবশেষে ১৯১৯ সালে ইংল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্টসহ হাজারও কূটনীতিবিদের উপস্থিতিতে প্যারিস পিস কনফারেন্স সংঘটিত হয়। সম্মিলিতভাবে যাবতীয় অপরাধের তকমা জার্মানির কপালে সেঁটে দেয়া হয় এবং দাবি করা হয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সকল দেশের বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ যেন জার্মানি দেয়। এরকম প্রবল বৈশ্বিক চাপের প্রভাবে জার্মানিতে মাথা চাড়া দেয় এডলফ হিটলার আর তার উগ্র জাতীয়তাবাদ। এর চেইন-রিয়াকশন হিসেবে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যার ফলে ইউরোপ বিশ্ব-রাজনীতির মঞ্চ থেকে মুখ থুবড়ে পড়ে, আমেরিকা চলে আসে ক্ষমতায়।
এই একই কনফারেন্সে আরব আর জায়নিস্ট, উভয়পক্ষ আসে ওয়াদাকৃত হিস্যা নিতে। সমঝোতার দায়ভার কাঁধে তুলে নেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন। ওনার নির্দেশে আরবি ভাষায় পারদর্শী কিং ক্রেইন যুগলদ্বয় সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে বেদুইন এবং অন্যান্য গোত্রগুলোর ওপর সারভে চালান এবং রিপোর্ট করেন যে আরব দুনিয়ায় ইহুদিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র তৈরির জন্য কোনো উপযুক্ত জায়গা নেই, এমনকি তারা জায়নবাদী মানসিকতা প্রয়োগ করাকেই অসম্ভব বলে নাকচ করে দেন। কিন্তু কিং ক্রেইন কমিশনের এই রিপোর্টকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আরবদের পক্ষ থেকে প্যারিসে আসেন ফয়সাল ইবনে শরিফ হুসেন। সঙ্গে আনেন তার বন্ধু টি. ই. লরেন্সকে আরব স্বাধীনতার পক্ষে আওয়াজ তোলার জন্য। ওই একই কনফারেন্সে চেইম ওয়াইজমেন জায়নিস্টদের মুখপাত্র হিসেবে যোগদান করেন। আরব আর জায়নিস্টদের প্রবল বাগ-বিতণ্ডার মাঝে সাইক-পিকট চুক্তিই দিনশেষে প্যারিস পিস কনফারেন্সে গৃহীত হয়।
যার ফলস্বরূপ সিরিয়ান ভূমির কিয়দংশ ফ্রান্সের হাতে চলে যায়। ফ্রান্স প্রাপ্ত অংশে মেরোনাইট (লেভেনান্ট তথা সিরিয়ান অধিবাসী) খ্রিষ্টানদের জন্য লেবানন নামের নতুন রাষ্ট্র গঠন করে।
পাশাপাশি আলাওয়ি এবং জাবাল-আল-দ্রুজ নামে যথাক্রমে আলাওয়ি এবং দ্রুজ ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা স্টেটের ব্যবস্থা করে। তখন পর্যন্ত আলাওয়িরা যাযাবর বর্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। সুন্নিদের ওপর হামলা, তাদের সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়া, চুরি-ডাকাতি, হত্যা-ধর্ষণ ছিল তাদের নিত্যকার অভ্যাস। সুন্নি অধ্যুষিত সিরিয়াকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ফ্রান্সের প্রতি অনুগত থাকবে এমন একটা দলের দরকার ছিল। অধিকাংশ সময় পার্বত্য এলাকায় চরে বেড়ানো আলাওয়িদের জন্য প্রথমবারের জন্য ফ্রান্স স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে এবং ঢালাওভাবে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেয়। মোদ্দাকথা, বর্বর আলাওয়িদের সভ্য করে তুলতে যা কিছু দরকার ছিল তা ফ্রান্স করেছে। উদ্দেশ্য একটাই, সুন্নিদের প্রতি ওদের বহুকালের ঘৃণা কাজে লাগানো। দুঃখের বিষয় হলো, ফ্রান্সের রোপণ করা বিষবৃক্ষ এখনো ফল দিয়ে যাচ্ছে। হাফিজ আল আসাদ আর তার পুত্র বাশার আল আসাদের মতো আলাওয়িদের হাতে বইছে সুন্নিদের রক্তের বন্যা ।
অন্যদিকে, ব্রিটিশদের হাতে আসে তিনটি আলাদা অঞ্চল। প্রথম এলাকাটি হলো ট্রান্স-জর্ডান যেটা বর্তমান ফিলিস্তিন, ইসরায়েল আর জর্ডান নিয়ে গঠিত। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অঞ্চল দুটি যথাক্রমে ইরাক এবং হেজাজ তথা সৌদি আরব।
এর মধ্যে শরিফ হুসেনের পুত্র আলীকে হেজাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। ক্ষমতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলী নিজেকে হেজাজের সম্রাট ঘোষণা দেয়। এমনকি একবার খলিফা হিসেবেও নিজেকে দাবি করে বসে কিন্তু ১৯২৪ এর অক্টোবর হতে ১৯২৫ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র একবছরের ব্যবধানে ব্রিটিশ মদদপুষ্ট আরেকটি গ্রুপ আল-সৌদের হাতে ক্ষমতা হারায়। সম্পূর্ণ আরবকে একত্রিত করে সৌদি বংশ এখনও রাজ টিকিয়ে রেখেছে।
শরিফ হুসেনের অপর পুত্র আব্দাল্লাহ’র হাতে আসে বর্তমান জর্ডান। ক্ষমতা পাওয়ার পর আব্দাল্লাহ জর্ডানের হাশেমি রাজা উপাধি গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, তিন পুত্রের মধ্যে একমাত্র আব্দাল্লাহ সফলভাবে শাসন ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে তার পৌত্র হুসাইন ১৯৫২ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার পর এখন পর্যন্ত (২০২২ খ্রিষ্টাব্দ) হুসাইনের পুত্র অর্থাৎ শরিফ হুসেনের প্র-প্রপৌত্র দ্বিতীয় আব্দাল্লাহ জর্ডান শাসন করছেন।
শরিফ হুসেনের সর্বোকনিষ্ঠ পুত্র ফয়সালও ইরাকের গভর্নর হিসেবে নিয়োজিত হওয়ায় তার অন্য দুই ভাইয়ের মতো নিজেকে সম্রাট হিসেবে দাবি করেন। কিন্তু ইরাকিরা তাকে শাসক হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার এবং আক্ষরিক অর্থেই তাকে তাড়িয়ে দেয়। ব্রিটিশরা অন্যান্য হাশেমি বংশধরদের ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করলে শেষমেশ ১৯৫৮ সালে ইরাকি আর্মির একটা অংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং ওই সময় বাগদাদে অবস্থানকারী শরিফ পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করে। এই ঘটনার ১০ বছর পর ১৯৬৮ সালে ঘাতক দলের অন্যতম সদস্য সাদ্দাম হুসেইন ইরাকের শাসন ক্ষমতা দখল করে নেয়।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ