ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
মদিনা শরিফের জুমার খুতবা

আদম-হাওয়ার গল্প: শিক্ষা ও উপদেশ

প্রকাশনার সময়: ০৮ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:১৯
মসজিদে নববির খতিব ড. আবদুল বারি বিন আওয়াদ আছ-ছুবাইতি

পবিত্র কোরআনে অসংখ্য ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যাতে রয়েছে শিক্ষা, উপদেশ ও পাঠ। আল্লাহ তায়ালা আমাদের নিকট প্রথম সৃষ্টি আদম (আ.) ও তার স্ত্রী হাওয়া (আ.)-এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এই ঘটনাতে শয়তানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। আল্লাহর রীতি হলো, এ দ্বন্দ্ব যা শুরু হয়েছিল তা চলমান থাকবে। কেয়ামত অবধি যতদিন আদমসন্তান ও তাদের শত্রু ইবলিশ অবশিষ্ট থাকবে। এ ঘটনাটি কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় বর্ণিত হয়েছে, যাতে রয়েছে মহান লক্ষ্য ও গুরুত্বপূর্ণ উপদেশমালা।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর হে আদম তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর। অতঃপর সেখান থেকে যা ইচ্ছা খাও তবে এ বৃক্ষের কাছে যেও না ,তাহলে তোমরা জালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। অতঃপর শয়তান উভয়কে কুমন্ত্রণা দিল, যাতে তাদের অঙ্গ; যা তাদের কাছে গোপন ছিল তাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়। সে বলল, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করেননি; তবে তা এ কারণে যে, তোমরা না আবার ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা হয়ে যাও চিরকাল বসবাসকারী। সে তাদের কাছে কসম খেয়ে বলল, আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী। অতঃপর প্রতারণাপূর্বক তাদের সম্মত করে ফেলল। অনন্তর যখন তারা বৃক্ষ আস্বাদন করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের সামনে খুলে গেল এবং তারা নিজের ওপর বেহেশতের পাতা জড়াতে লাগল। তাদের প্রতিপালক তাদের ডেকে বললেন, আমি কি তোমাদের এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। তারা উভয়ে বলল, হে আমাদের পালনকর্তা আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৯-২৩)

আল্লাহ তাআলা আদম (আ.) ও তাঁর স্ত্রী উভয়কে জান্নাতে বসবাস করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আর হে আদম তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর।’ এটি ছিল আদম (আ.) এর সম্মানার্থে এবং উচ্চ মর্যাদা ও অবস্থানের কারণে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার আদেশসমূহ মেনে চলবে সে আল্লাহ তাআলার কাছে মর্যাদাবান ব্যক্তিতে পরিণত হবে। তার হৃদয় প্রশান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। অন্তর শান্তি লাভ করবে। তার জীবন-যাপন সুখের হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধিবিধান থেকে দূরে অবস্থান করবে এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে; সে সংকুচিত জীবন-যাপন করবে।

‘অতঃপর সেখান থেকে যা ইচ্ছা খাও।’ আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য সকল পবিত্র জিনিসকে বৈধ করেছেন এবং খাদ্য ও পানীয়ের ক্ষেত্রে প্রশস্ততা দান করেছেন। ফলে হালালের সীমারেখা বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং হারামের গণ্ডি সংকুচিত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও ব্যক্তির ওপর নফসে আম্মারাহ বিজয়ী হয়। ফলে সে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি দৃষ্টি দেয় এবং বৈধতা বা মুবাহের সীমানা পার হয়ে নিষিদ্ধের সীমানায় ঘোরাফেরা করে। তখন শয়তানের ষড়যন্ত্র ও তার কুমন্ত্রণা কঠিন হয়ে ওঠে, ফলে সে নিষিদ্ধ বস্তুতে জড়িত হয়ে পড়ে।

এ জন্য আল্লাহ তাআলা তাদের উভয়কে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তবে এ বৃক্ষের কাছে যেও না তাহলে তোমরা গোনাহগার হয়ে যাবে।’ গাছের কাছে থেকে নিষেধ করলেন তা থেকে ফল খাওয়ার সম্ভাবনা রোধ করতে। সেটাই ছিল নিষেধের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। শয়তান আদম (আ.) কে বিভ্রান্ত করতে থাকল, ধূর্ততার সঙ্গে কুমন্ত্রণা দিতে থাকল এবং বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গে শপথ করতে লাগল; অবশেষে তারা উভয়ে গাছের ফল ভক্ষণ করলেন।

হারাম বস্তুর সীমার নিকটবর্তী হওয়া থেকে সাবধান করার সঙ্গে সঙ্গে সতর্কতামূলক পন্থায় চলতে হকের দাওয়াত এসেছে এখান থেকেই। নিজের সুরক্ষা, চরিত্রের হেফাজত, সমাজের প্রতিরক্ষা এবং আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করার প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে।

যে ব্যক্তি শিরকে পতিত হয়েছে সে তো নিষিদ্ধ জিনিসের উপায়-উপকরণের নিকটবর্তী হওয়ার কারণেই পতিত হয়েছে এবং যে ব্যক্তি বিদআতে জড়িত হয়েছে সে তো বিদআতপন্থীদের সঙ্গে ওঠাবসায়, তাদের কিতাব অধ্যয়ন ও তাদের প্রতি নির্ভরতায় শীথিলতা প্রদর্শন করার কারণেই। আর কেউ সগিরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া এবং তাতে অনড় থাকা ছাড়া কবিরা গোনাহের দিকে ধাবিত হয় না। আধুনিক প্রযুক্তি তো উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের একটি মাধ্যম মাত্র— চাই তা ভালো হোক বা মন্দ। সুতরাং যে ব্যক্তি সীমানার কাছে ঘোরাঘুরি করবে, নিভৃতে অন্যায় কাজ সম্পাদন করবে; তার সালাত, চরিত্র ও সময় বরবাদ হয়ে যাবে। ইবাদতের সময়গুলো গোনাহের সময়ে এবং আল্লাহর সঙ্গে বন্ধুত্ব হৃদয়ের নিঃসঙ্গতায় পরিবর্তিত হয়ে যাবে।

আর হারাম ও নিষিদ্ধ জিনিসের মধ্যে স্বাধীনতা খর্ব করা হয়নি; বরং এর মাধ্যমে পরীক্ষা এবং আনুগত্যের প্রকৃতরূপ বের করে আনা হয়; যা অপেক্ষমান শত্রুর অপমান এবং নিভৃতে ও প্রকাশ্যে আল্লাহর নজরদারির দাবি রাখে। আমাদেরকে এই আয়াতগুলো শিক্ষা দেয়, আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তাতে জড়িত হওয়া তো দূরের কথা, যে ব্যক্তি তার নিকটবর্তী হয় সেও নিজের প্রতি জুলুমকারী। ‘তাহলে তোমরা জালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’

মানুষ অনেক সময় নিজের প্রতি জুলুম করে থাকে —সংশয়মূলক বস্তু যা তাকে হারামের দিকে নিয়ে যায়; তাতে নিপতিত হওয়ার মাধ্যমে— খাবার, পানীয়, পোশাক, পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের অধিকার এবং সম্পদ, লেনদেন ও এগুলোতে বিদ্যমান সুদ, ধোঁকা ও আত্মসাৎ ইত্যাদি ক্ষেত্রে।

‘অতঃপর শয়তান উভয়কে কুমন্ত্রণা দিল।’ এই কুমন্ত্রণা দানকারী শয়তান বনি আদমের প্রতিটি পথেই ওঁৎ পেতে থাকে এবং সে মানুষের সঙ্গে শত্রুতার সহজাত স্বভাব থেকে কখনো বিরত হয় না। সে বাতিলকে সুশোভিত করে, পাপকাজকে সহজ করে, নারী-পুরুষের মাঝে হারাম সম্পর্কে শিথিলতা প্রদর্শনকে ভালো কাজ হিসেবে উপস্থাপন করে, মানুষের চোখে এমন বিষয়কে তুচ্ছ করে দেখায় যা আল্লাহর কাছে গুরুতর, প্রতিষ্ঠিত বিষয় ও আক্বিদা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করে, মুসলিমদের মধ্যে বিবাদ তৈরি করে এবং তাদের দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বেড়ায় এবং পথভ্রষ্ট করার মাধ্যমগুলো ব্যবহারে কোনো ধরনের ত্রুটি করে না। এককথায় শয়তান প্রত্যেককে তার অবস্থা অনুসারে বিপথগামী করার চেষ্টা করে।

আর এর লক্ষ্য হলো, ‘যাতে তাদের অঙ্গ, যা তাদের কাছে গোপন ছিল, তাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়।’ সুতরাং পাপকাজ আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার পর্দা বিনষ্ট করে। আর যখন পর্দা দূরীভূত হয়ে যায় তখন লজ্জাস্থান প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এটি হলো প্রথম পদক্ষেপ যা পরবর্তীতে হারাম দর্শন, অতঃপর অশ্লীলতা, অবশেষে চারিত্রিক অবক্ষয়ের পথকে সুগম করে। শয়তান তার উদ্দেশ্য সাধনে সক্ষম হয়েছে যখন সে কিছু মানুষের মগজে একথা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে যে, বিশেষত নারীদের ক্ষেত্রে নগ্নতাই সভ্যতা ও অগ্রগতির প্রতীক। আর এর বিপরীত হলো পশ্চাৎপদতা ও সেকেলে!! মহান আল্লাহ বলেন, ‘শয়তান তোমাদের শত্রু; অতএব তাকে শত্রু রূপেই গ্রহণ কর। সে তার দলবলকে আহ্বান করে যেন তারা জাহান্নামি হয়।’ (সুরা : ফাতির, আয়াত : ০৬)

সবচেয়ে মারাত্মক কুমন্ত্রণা হলো, যখন তা নসিহতের ছদ্মাবরণে প্রকাশ পায়। ‘সে তাদের কাছে কসম খেয়ে বলল, আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী।’ তাদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য সে শপথ করেছে, যেহেতু সে জানে তারা উভয়ে কল্পনাও করবে না যে, কেউ আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করার স্পর্ধা দেখাবে। বিষয়টি আরো খারাপ ও ভয়ঙ্কর হয় যখন বন্ধুর বেশে শত্রু, সহানুভূতিশীলের আড়ালে ষড়যন্ত্রকারী এবং সহযোগীর সুরতে প্রতারকের আবির্ভাব হয়। ‘অতঃপর প্রতারণাপূর্বক তাদেরকে সম্মত করে ফেলল।’

চাকচিক্যময় কথা ও সুশোভিত বাতিলের মাধ্যমে সে সর্বদা ধোঁকা দিতে ও সংশয়ে নিপতিত করতে সচেষ্ট থাকে। এই বাক্যে ইঙ্গিত রয়েছে, আল্লাহ মানুষকে যে মর্যাদা দ্বারা সম্মানিত করেছেন, সে ওই মর্যাদাহানীর চেষ্টা অব্যাহত রাখবে; যেন সে তাদেরকে অবাধ্য, পথভ্রষ্ট ও আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করতে পারে। ফলে তারা সেই শাস্তির সম্মুখীন হবে যাতে সে পতিত হয়েছে।

গাছের ফল ভক্ষণ করার মাধ্যমে নির্দেশ অমান্য করার পরিণতি কী হয়েছিল? ‘অনন্তর যখন তারা বৃক্ষ আস্বাদন করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের সামনে খুলে গেল এবং তারা নিজের ওপর বেহেশতের পাতা জড়াতে লাগল।’ এটাই অবাধ্যতার পরিণতি— মর্যাদার পর অধঃপতন, সম্মানের পর লাঞ্ছনা এবং বন্ধুত্বের পর নিঃসঙ্গতা।

‘তাদের প্রতিপালক তাদেরকে ডেকে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের উভয়কে এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে যারা নিষিদ্ধ কাজে জড়িত হবে তাদের সকলের প্রতি আহ্বান।

এখানে আল্লাহ আমাদের জন্য কোনো অজুহাত পেশের সুযোগ রাখেননি; তিনি তো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন, প্রকাশ করে দিয়েছেন, সতর্ক করেছেন, অজুহাত খণ্ডন করেছেন এবং আমাদের কাছে পাপীদের পথ, শয়তানের পন্থা ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের অবস্থা বিশদভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। যেন আমরা কুমন্ত্রণা ও ধোঁকার শিকার না হই। তা সত্ত্বেও আদমসন্তান যদি এগুলোতে পতিত হয়, অতঃপর তওবা করে, তবে আল্লাহ তার তওবা গ্রহণ ও কবুল করেন।

কেননা আল্লাহ পরম করুণাময় ও দয়াশীল, ক্ষমাশীল ও স্নেহপরায়ণ। তিনি সেই ব্যক্তির দরজা খুলে দেন যে নিজেই তার দরজা বন্ধ করে; তাঁর রহমত সকল কিছুকেই বেষ্টন করে আছে। আমাদের আদি পিতামাতার অপরাধ স্বীকার থেকে আমাদের জন্য এটাই শিক্ষণীয় পাঠ। তাদের কাছে থেকে দ্রুত তওবা, ভুল স্বীকার, মহান স্রষ্টার কাছে অনুতপ্ত ও বিনয়ী হওয়ার শিক্ষা পাই। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তওবা করে তিনি তার তওবা কবুল করেন। যে দ্বীনের দক্ষতা অর্জন করেছে, সে অল্প বিচ্যুতির কারণে অধিক অনুতপ্ত হয়।

আদম (আ.) তার রবের পক্ষ থেকে যেসব বাক্য শিখেছেন তা কতই না সুমিষ্ট। তিনি কীভাবে তওবা করবেন তা আল্লাহই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন, যেন তিনি তার তওবা কবুল করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তারা উভয়েই এর ফল ভক্ষণ করল, তখন তাদের সামনে তাদের লজ্জাস্থান খুলে গেল এবং তারা জান্নাতের বৃক্ষ-পত্র দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করতে শুরু করল। আদম তার পালনকর্তার অবাধ্যতা করল, ফলে সে পথভ্রষ্ট হয়ে গেল। এরপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন, তার প্রতি মনোযোগী হলেন এবং তাকে সুপথে আনয়ন করলেন।’ (সুরা : তহা, আয়াত : ১২১-১২২)

০৮ জমাদাল উলা ১৪৪৪ হিজরি (২ ডিসেম্বর ২০২২) মদিনার মসজিদে নববিতে দেয়া জুমার খুতবার অনুবাদ

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ