একটি আধুনিক পরিবারে জন্ম আমার। পাঁচ ভাই-বোনের সবার ছোট আমি। শিশুকাল থেকেই সবার আদর-যত্নে বড় হয়েছি। বিশেষ করে আব্বুর আদর ছিল সীমাহীন। আম্মু অসুস্থ হওয়ার কারণে আব্বু সবসময় আমাকে সঙ্গে রাখতেন। যেখানে যেতেন সঙ্গে নিয়ে যেতেন। শিশু বয়স থেকে কিশোরী বয়সে উত্তীর্ণ হওয়ার পর বাড়িতে বেশ পরিবর্তন দেখতে পেলাম। বিভিন্ন বাহানায় আব্বু আমাকে এখন বাড়িতে রেখে যেতেন। পূর্বের মতো সঙ্গে নিতেন না। আব্বুর সঙ্গে ঘোরার জন্য কান্নাকাটি করতাম, কিন্তু কাজ হত না। অল্পদিনের ভেতরেই বুঝতে পারলাম, মেয়েরা বড় হলে বাইরে বের হওয়া যায় না। বাড়ির চৌহদ্দির ভেতরে থাকতে হয়!
অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর একদিন আম্মু বোরকা পরিধান করার কথা বললে আমি পরিষ্কার ভাষায় অস্বীকার করলাম। জানিয়ে দিলাম, বোরকা-পর্দা করতে আমি কোনোভাবেই প্রস্তুত নই। শিশুকাল থেকে মন-মর্জি মতো চলার মেজাজ হয়ে গিয়েছিল। একরোখা ও জেদি মানসিকতা ছিল আমার। এ কারণেই আম্মুর কথা আমি শুনতেই রাজি ছিলাম না।
এদিকে আম্মু বেশি পড়ালেখা জানা মানুষ ছিলেন না। ফলে ধর্মীয় বিষয়গুলো তিনি আমাকে তেমন সুন্দরভাবে প্রমাণসিদ্ধ করে গুছিয়ে বোঝাতে সক্ষম হতেন না। আমাদের পরিবারে ইসলাম পালনের সীমা ছিল নামাজ-রোজা পর্যন্তই। আম্মু আমাকে প্রথাগত পর্দা পালন করতে আদেশ-উদ্বুদ্ধ করতেন, শরয়ি পর্দা নয়। অথচ আমার হূদয়-মস্তিষ্ক তখন ইসলামি জীবন বিধানের বিষয়গুলো জানা-বোঝা ও মানার কথা কল্পনাও করেনি।
১৯৯২ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর ১৬ বছর বয়সে একজন সুযোগ্য আলেমের সঙ্গে আমার বিবাহ হয়। আমার স্বামী অত্যন্ত ভদ্র, জ্ঞানী ও সচেতন একজন মানুষ। একেবারে সাদামাটা বিবাহ হয় আমাদের। ব্যান্ড-বাদ্য, সিনেমা-ফটো ইত্যাদির ন্যায় কোনো গুনাহ আমাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে ছিল না। ছিল শুধু সুন্নাত মোতাবেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্টি করার কামনা। বিবাহের সময় আমার ফুফুসহ অন্যান্য আত্মীয়রা বারবার অভিযোগ করতে থাকল, এ কেমন বিবাহ। যেখানে কোনো গান-বাজনা, আনন্দ-ফূর্তি নেই! তারা বলতে লাগল, মনে হচ্ছে যেন কোনো কুমারী নারীর বিবাহ হচ্ছে না, বিবাহ হচ্ছে তালাকপ্রাপ্তা নারীর!
যাহোক, কোনো অসুবিধা ছাড়াই সুন্দরভাবে বিবাহ সম্পন্ন হলো। বিবাহের কিছুদিন পর স্বামী আমাকে বললেন, নিজের গাইরে মাহরাম আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে পর্দা পালন শুরু কর। কারণ, ইসলামি শরিয়ত আমাদেরকে পর্দা পালনের আদেশ দিয়েছে। আমরা মুসলমান। ইসলাম কোনো মুসলিম নারী-পুরুষকে এই অনুমতি দেয় না, তারা মহান আল্লাহ তায়ালা ও নবী করিম (সা.)-এর হুকুম অমান্য করবে।
আমার কাছে এসব নতুন ছিল, মান্য করা কঠিন ছিল। বাড়িতে যেখানে আমি প্রথাগত পর্দা পালন করতেই প্রস্তুত ছিলাম না, সেখানে এখন আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ শরয়ি পর্দা পালন করতে হবে! এটা ভাবতেই আমি বলহীন হয়ে যাচ্ছিলাম। বড় ভারি লাগছিল। বিবাহের পূর্বে বাড়িতে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করেছি। এখন পর্দা-বোরকা আমার দ্বারা কীভাবে সম্ভব! স্বামীর সঙ্গে পর্দা-বোরকা ইস্যুতে আমার তুমুল তর্ক-বিতর্ক হতে লাগল। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছিল।
স্বামী আলেম ছিলেন। তার একটি বড় গুণ ও বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি যুগসচেতন, সমসাময়িক বিষয়গুলোর খোঁজ-খবর রাখতেন। উদাহরণ, যুক্তি ও দরদ দিয়ে এমনভাবে কথা বলতেন, আমি পরাজিত হতাম। স্বামী আমাকে পবিত্র কোরআন খুলে-খুলে দেখাতেন, দেখ! পর্দা আল্লাহ তায়ালার হুকুম। তোমার-আমার ইচ্ছার কথা নয়। আমার তো অবশ্যই বিশ্বাস ছিল, পর্দা আল্লাহ তায়ালার ফরজ বিধান। কিন্তু দুর্বলতা ও অক্ষমতার কারণে নিজের ভেতর সাহস তৈরি করতে পারছিলাম না।
স্বামীর অব্যহত প্রচেষ্টায় এক পর্যায়ে আস্তে-আস্তে অন্তর নরম হতে লাগল। মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রাণ খুলে পর্দা পালনের তৌফিক চেয়ে কান্নাকাটি করতে লাগলাম। আল্লাহ তায়ালার দরবারে অঙ্গীকার করলাম, আমি পূর্ণাঙ্গ শরয়ি পর্দা পালন করব। আর কখনোই পর্দার বিধান লঙ্ঘন করব না। দুনিয়ার কারো কোনো কথা-ভয় পরোয়া করব না। এক সময় আল্লাহ তায়ালা আমাকে তৌফিক দান করলেন। পর্দার ওপর অটল থাকার মহানেয়ামত দান করলেন। আমার দোয়া কবুল করলেন। আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন, ‘আহ্বানকারীর আহ্বানে আমি সাড়া দেই।’ (সুরা বাকারা: ১৮৬)
আমার ছোট বোনের বিবাহের সময় আমি পরিপূর্ণ শরয়ি পর্দা পালন করেই বিবাহের সব কাজে শরিক হলাম। আমার অবস্থা দেখে পরিচিতজনেরা সমস্বরে হৈ হৈ করে উঠল, এই মেয়ের কী হলো, নিজেদের মানুষের সঙ্গে পর্দা করছে! জঘন্য কটুবাক্য ও তিরষ্কারের সম্মুখিন হলাম। সব রকমের অপমান-অপদস্থতা সহ্য করলাম। কারণ, এখন দুনিয়ার কারো ভয় অন্তরে নেই। একমাত্র আল্লাহ তায়ালার ভয় অন্তরে কাজ করে। ভগ্নিপতির সঙ্গে পর্দা শুরু করলে তিনি আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিলেন! আমার পর্দা পালনের কথা শুনে প্রিয় চাচাজান আমাদের বাড়িতে আসা পরিত্যাগ করলেন। তার বক্তব্য, আমার ছেলেদের সঙ্গে যারা পর্দা করে সে বাড়িতে আমি যাব না!
এসব বিষয় জানার পর আব্বু হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি আমার স্বামীর প্রতি মনক্ষুণ্ন হন। এভাবে জীবন চলতে পারে? আম্মু বিবাহের পূর্বে আমাকে বোরকা পরিধান করাতে কত চেষ্টা করেছেন, সে আম্মুই এই ঝড়ের সময় নিশ্চুপ! বোনেরা আমার প্রতি ক্ষিপ্ত, তাদের স্বামীর সঙ্গে আমি পর্দা করছি, তাহলে তারা আমাদের বাড়িতে কীভাবে আসে! আল্লাহ তায়ালার বড় অনুগ্রহ, এত ঝড়-ঝাপটার পরও আমি শরয়ি পর্দা পরিত্যাগ করিনি। কারোর রাগ-ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টির পরোয়া করিনি।
আত্মীয়স্বজনর বলতে লাগলেন, আমাকে একটি জেলখানায় আবদ্ধ রাখা হয়েছে! জোরপূর্বক আমাকে কারও সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে দেয়া হচ্ছে না! অথচ বিষয়টি মোটেও এরূপ নয়। বিয়ের পরেই আমি গণশিক্ষা ও ইংরেজি সাহিত্যে ডাবল এমএ সম্পন্ন করেছি। স্বামীর সমর্থন-সহযোগিতায় সবকিছু সম্ভব হয়েছে। পর্দা আমার কোনো কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। উল্টো আমাকে মর্যাদাবান ও সম্মানিত করেছে। পর্দার কারণেই সবাই আমাকে পরম শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে। সরকারি একটি স্কুলেও আমি শিক্ষকতা করেছি। আমার দুই কন্যার বড়টির বয়স নয় বছর। সে কোরআনে হাফেজ। ছোট কন্যা হিফজ করছে।
আমার সব মুসলিম মা-বোনদের নিকট বিনীত আবেদন করব, নারীদের সফলতা পর্দার বিধান পালন করার ভেতরেই। পর্দাহীন নারী আল্লাহ তায়ালার নিকট অপ্রিয়, অগ্রহণযোগ্য। দুনিয়া ও আখেরাতের সর্বপ্রকার সম্মান, কল্যাণ ও উন্নতি নারীর শরয়ি পর্দার ভেতরেই নিহিত।
‘ডেইলি ইসলাম’-এর সাপ্লিমেন্ট থেকে
অনুবাদ : আমিরুল ইসলাম লুকমান
নয়াশতাব্দী/এমএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ