বিশুদ্ধ আকিদার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এ মর্মে দৃঢ় ঈমান ও বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউই গায়েব জানে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বল, আকাশ ও পৃথিবীতে যারা আছে তারা কেউই অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না আল্লাহ ছাড়া, আর তারা জানে না কখন তাদেরকে জীবিত করে উঠানো হবে।’ (সুরা নামল : ৬৫)
হে মুমিন ব্যক্তি, আপনি এখান থেকে গণক, জ্যোতিষী ও রাশিফল গণনাকারী, হস্তরেখাবিদ এবং বাটি চালানে পারদর্শীরা যেসব অদৃশ্যের জ্ঞান রাখার দাবি করে- তাদের মিথ্যা ও প্রতারণার বিষয়টি জানতে পারবেন। আরও জানতে পারবেন, যেসব জিনিসের আশ্রয়ে ভবিষ্যতে যা ঘটবে এবং যা মানুষের থেকে অদৃশ্য, সে বিষয়গুলো তাদের সংবাদ দেয়ার মিথ্যা ও প্রতারণামূলক দাবির বিষয়টি। যেমন সংবাদ মাধ্যমে রাশিচক্রবিদ্যা এবং জ্যোতিষবিদ্যা বা অনুরূপ নামে এগুলো প্রচারের বিষয়টি স্পষ্ট। এগুলোর সবই বানোয়াট মিথ্যা ও বৈচিত্র্যময় কল্পকাহিনি এবং এগুলো গণকবিদ্যা ও জ্যোতিষবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত যার কোনো বাস্তব ও শরিয়তসম্মত ভিত্তি নেই।
জ্যোতিষবিদ্যার প্রতি বিশ্বাস করা এবং তা মেনে নেয়ার বিষয়টি ছাড়াও ইসলামি শরিয়ার বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম জ্যোতিষবিদ্যার মতো বিদ্যা শেখা, চর্চা করা এবং শোনা হারাম হওয়ার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জ্যোতিষবিদ্যার কিছু শিক্ষা করল, সে যেন জাদুবিদ্যার একটা শাখা আয়ত্ত করল। সুতরাং সে যত বেশি তা চর্চা করবে, ততই তার জাদু বিদ্যার চর্চা হবে।’ (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)
সহিহ বুখারি ও মুসলিমের বর্ণনায় হাদিসে কুদসিতে এসেছে, ‘আর যে ব্যক্তি বলে, অমুক অমুক নক্ষত্রের কারণে আমাদের ওপর বৃষ্টিপাত হয়েছে, সে আমার প্রতি অবিশ্বাসী হয়েছে এবং নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাসী হয়েছে।’
খোলাফায়ে রাশেদার অন্যতম খলিফা আমিরুল মুমিনিন আলি (রা.) যখন খারেজিদের সঙ্গে যুদ্ধের লক্ষ্যে যাত্রার মনস্থ করলেন, তখন সকল জ্যোতিষী একমত পোষণ করল যে, আলী (রা.) ও তার বাহিনী পরাজিত হবে। কেননা তিনি এমন সময়ে লড়াইয়ের লক্ষ্যে রওয়ানা দিয়েছেন যখন চন্দ্র বৃশ্চিকরাশিতে অবস্থান করছিল। আলী (রা.) তাদের ভবিষ্যতবাণী শুণে দ্বার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও পূর্ণ ভরসা রেখে এবং জ্যোতিষীদের বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে আমরা যুদ্ধের জন্য সফর অব্যাহত রাখব।’
সংকল্প অনুযায়ী তিনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে যাত্রা করলেন এবং আল্লাহ তাকে সাহায্য ও বিজয় দান করলেন। অনুরূপভাবে আমুরিয়ার যুদ্ধে জ্যোতিষীগণ ঐক্যমত পোষণ করল যে, আব্বাসি খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ কখনোই বিজয়ী হতে পারবে না। তিনি তাদের ভবিষ্যতবাণীর বিরোধিতা এবং তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা করলেন। ফলে ওই যুদ্ধে মুসলিমরা জয় লাভ করল।
এ প্রসঙ্গে কবি আবু তাম্মাম বলেন, গণকদের ভবিষ্যতবাণীর চেয়ে তরবারীই অধিক সত্য সংবাদদাতা .. তার ধারেই রয়েছে সত্য-মিথ্যার ফয়সালা।
তারপর তিনি তাদের মিথ্যা ও প্রতারণার বিষয়টি বর্ণনা করে বলেন, কোথায় কিচ্ছা-কাহিনি, বরং কোথায় তাদের নক্ষত্ররাজি?.. আর তারা চিত্তাকর্ষক ও মিথ্যা গল্প যা তৈরি করেছে?! অনুমাননির্ভর ও মিথ্যা রচনায় .. যা কোনো শক্ত ভিত থেকে উদ্গত নয় যদি সংঘটিত হওয়ার আগেই তা কিছু উদগত করতে পারত .. তাহলে এ বিজয়ের কথাই আগে প্রকাশ করত। আর এসব মূর্তি ও বেদীর পরিণতি গুপ্ত থাকত না।
বিদ্বানরা বলেন, ‘আমরা যদি জ্যোতিষীদের মিথ্যা ভবিষ্যতবাণীগুলো শুনে লিপিবদ্ধ করতাম তাহলে সেগুলো অনেক খণ্ডের পুস্তকে রূপ লাভ করত।’
যে কেউ এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে সে দাবির বিপরীতে পর্যায়ক্রমে আরো দুর্যোগের মধ্যে পতিত হবে। আর বান্দার সঙ্গে এটাই আল্লাহর রীতি, যে ব্যক্তি তাঁকে ব্যতীত অন্য কারো কাছে শান্তি খুঁজবে বা অন্যকে অবলম্বন করবে বা কোনো মাখলুকের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, এর কারণে তিনি তাকে তার চাহিদার বিপরীত বস্তু দান করবেন। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো কিছু লটকায়-তাবিজ-কড়ি জাতীয়- তাকে সেদিকেই ন্যস্ত করা হবে।’
ইসলাম তারকারাজির প্রকৃত জ্ঞান সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছে। তারকারাজি মূলত, আসমানের শোভা, দিকনির্ণয়, ফসলি মৌসুম, বার্ষিক ঋতুর সময়কাল ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান লাভের নিদর্শন। এগুলো ছাড়া যে ভ্রান্ত মতগুলো মানুষকে তাদের সৃষ্টিকর্তা, বিশ্বজগতের অধিপতি, সৃষ্টিজগত ও বস্তুজগতের একক পরিচালক আল্লাহকে ব্যতিরেখে ভিন্ন কারো সঙ্গে যুক্ত করতে চায়; তা সঠিক দ্বীন ও ত্রুটিমুক্ত আকিদা থেকে বিচ্যুতি ও ভ্রষ্টতা। জ্ঞানগত ভিত্তি ও শরয়ি দলিলের ওপর যা নির্মিত নয়, তা মানুষকে মিথ্যা ধ্যান-ধারণা এবং অজ্ঞতাপূর্ণ বিশ্বাসে নিপতিত করে।
এ জন্য সুস্পষ্ট কুফরি এবং বিশুদ্ধ দলিলের বিরোধিতার অন্তর্গত হলো, ‘প্রভাব বিজ্ঞান’ নামক বিদ্যার ওপর বিশ্বাস রাখা। অর্থাৎ এ বিশ্বাস লালন করা যে তারকারাজি যুদ্ধ-বিগ্রহ, অনিষ্ট-অকল্যাণের ন্যায় ঘটনাবলি সৃষ্টিতে কার্যকর প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখে। এ ধরনের বিশ্বাস লালন করা শিরকে আকবার (বড় শিরক) যা ব্যক্তিকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে দেয়।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তারকারাজিকে তার চলাচল, আবর্তন ও স্থানান্তরের দ্বারা বিভিন্ন জিনিস ঘটার সময় সম্পর্কে অবহিত হওয়ার কারণ হিসেবে নির্ধারণ করে, অতপর সে ব্যক্তি যা ঘটেনি বা ভবিষ্যতে যা ঘটবে এমন গায়েবি সংবাদ তারকারাজির উদয়স্থানের মাধ্যমে জানার দাবি করে; আলেমদের কাছে এটি আল্লাহর সঙ্গে কুফুরি হিসেবে স্বীকৃত। কেননা এটি অদৃশ্যের জ্ঞান রাখার দাবির নামান্তর -যে বিষয়ে এক আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। সুতরাং ইলমে গায়েবের দাবিদার ব্যক্তি হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-কে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী।
মুসলিম সম্প্রদায়! নিশ্চয় যেসব জ্যোতিষী ও গণক প্রতারণাপূর্ণ ও মিথ্যাশ্রয়ে ইলমে গায়েব সম্পর্কে জানার দাবি করে, সরলমনা ও প্রতারিতদের বুদ্ধি-বিবেক নিয়ে খেলা করে তাদের ধন-সম্পদ আত্মসাত ও আকিদা ধ্বংস করার লক্ষ্যে; তাদের নিকট গমণ করা, কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করা এবং তাদের কথা বিশ্বাস করা এসবই শরয়ি দলিল এবং অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে হারাম। সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গণকের কাছে গেল এবং তাকে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসা করল; তার চল্লিশ রাতের সালাত কবুল করা হয় না।’
সুতরাং হে মুসলিম! তাদের কাছে গমন করা, তাদেরকে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞেস করা থেকে সাবধান থাকুন; কেননা এগুলো নিশ্চিত হারাম ও ঘৃণ্য পাপের অন্তর্ভুক্ত। আর প্রত্যেক ওই ব্যক্তি যে অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞান রাখার দাবি করে সে গণক, জ্যোতিষী অথবা তাদের অনুরূপ ব্যক্তিদের অন্তর্গত এবং তাকে তাদের মধ্যেই গণ্য করা হবে -যেমনটি আলেমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
সহিহ মুসলিমে মুয়াবিয়া বিন হাকাম আস-সুলামি (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! কিছু কর্মকাণ্ড আমরা জাহেলি যুগে করতাম, তার মধ্যে একটি হলো আমরা জ্যোতিষীদের কাছে যেতাম। তিনি বললেন, ‘তোমরা আর জ্যোতিষীদের কাছে যেও না।’
সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, ‘লোকেরা রাসুল (সা.)-কে গণকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। রাসুল (সা.) তাদেরকে বললেন, ‘তারা কিছুই নয়।’ তারা বলল, হে আল্লাহর রাসুল! কখনো কখনো তারা এমন কিছুও বলে যা সত্য হয়। রাসুল (সা.) বললেন, ‘ওগুলো সত্য কথার অন্তর্ভুক্ত। জিনেরা এসব ছোঁ মেরে শোনে, পরে এদের দোসরদের কানে মুরগির মতো করকর রবে নিক্ষেপ করে। এরপর এসব জ্যোতিষী সামান্য সত্যের সঙ্গে শত মিথ্যার মিশ্রণ ঘটায়।’
নবী (সা.) এর সহধর্মিণী আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, ‘ফেরেশতামণ্ডলি মেঘমালার আড়ালে অবতরণ করেন এবং আকাশের ফায়সালাসমূহ আলোচনা করেন। তখন শয়তানেরা তা চুরি করে শোনার চেষ্টা করে এবং তার কিছু শুনেও ফেলে। অতঃপর তারা সেটা গণকের নিকট পৌঁছে দেয় এবং তারা তার সেই শোনা কথার সঙ্গে নিজেদের আরো শত মিথ্যা মিলিয়ে বলে থাকে।’ (সহিহ বুখারি)
সুতরাং যে ব্যক্তি কোনো গণক বা এরূপ কাউকে সত্যায়ন করবে, তা তাকে তার কর্মের কারণে মুশরিক বানিয়ে ফেলবে এবং তাদের কথার প্রতি তাকে বিশ্বাসী বানিয়ে দিবে। আর যে ব্যক্তি ভবিষ্যৎ জানার দাবি করবে তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে বিশ্বাস করা আবশ্যক। কেননা অদৃশ্যের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জ্যোতিষী অথবা জাদুকর অথবা গণকের নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করল। অতঃপর সে যা বলল তা সত্য হিসেবে বিশ্বাস করল; তাহলে সে মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি কুফরি করল।’ (মুসনাদে আহমদ, সুনানে আবি দাউদ, তিরমিজি)
২৪ রবিউল সানি ১৪৪৪ হিজরি (১৮ নভেম্বর ২০২২) মদিনার মসজিদে নববিতে প্রদত্ব খুতবার অনুবাদ
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ