বৃদ্ধাশ্রম মানবতার কলঙ্কিত কারাগার, বৃদ্ধাশ্রম বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি এক নির্মম উপহাস- এ কথাগুলো যেমন সত্য তেমনি এ কথাও সত্য যে, বৃদ্ধাশ্রম বর্তমান সময়ের এক তিক্ত বাস্তবতা। সামাজিক, মানসিক ও আদর্শিক নানা পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে একান্নবতী পরিবার বা যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ক্রমশই কমে যাচ্ছে। অবহেলিত হচ্ছেন বৃদ্ধ পিতা-মাতা।
এতে করে তারা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার অর্থাৎ আশ্রয় ও বাসস্থান হারাচ্ছেন। অবশেষে তাদের ঠাঁই নিতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে। তাই যারা সমাজের এই তিক্ত বাস্তবতাকে সামনে রেখে অসহায় বৃদ্ধ মানুষদের জন্য নিজের উদ্যোগে, নিজ খরচে বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করছেন, ভরণ-পোষণ ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে বৃদ্ধদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাদের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। এক্ষেত্রেও দীনদার বিত্তবানদের এগিয়ে আসা দরকার। সমাজে অবহেলিত ও অসহায় বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে তাদের জীবনের শেষ দিনগুলোতে একটু ভালোবাসা, মায়া-মমতা ও প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করে তারাও হতে পারেন অনেক বড় নেকির অধিকারী।
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের পার্থিব কষ্টসমূহের একটি দূর করে দেয়, আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন তার একটি কষ্ট দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীর অভাবের কষ্ট লাঘব করে, আল্লাহ তায়ালা তার দুনিয়া ও আখেরাতের অভাবের কষ্ট লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ তায়ালা বান্দার সহায়তায় থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সহায়তায় থাকে।’ (মুসলিম: ৪৮৬৭)
যারা অবহেলিত ও অসহায় বৃদ্ধদের পিছনে নিজের অর্থ-সম্পদ ও সময় ব্যয় করবে, এই হাদিসের মর্মের ব্যাপকতায় তারাও শামিল হবেন ইনশাআল্লাহ। যারা অসহায় বৃদ্ধদের কিংবা সন্তানদের কাছে অবহেলিত পিতা-মাতার সেবার উদ্দেশ্যে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করছেন তাদের উচিত, এক সন্তানের কাছে অবহেলিত বাবা-মায়ের শেষ দিনগুলো যেন বৃদ্ধাশ্রমে ‘আরেক সন্তানের ঘরের মতোই কাটে। বৃদ্ধাশ্রমগুলো যেন বাস্তব অর্থেই শেষ সময়ে তাদের আরাম-আয়েশের ভরসাস্থল হয়। সে দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার।
বৃদ্ধাশ্রমে যারা আসেন তারা যেহেতু জীবনের শেষ সময়টা এখানে কাটান, তাই তাদের এই শেষ সময়টা যেন দীনি পরিবেশে, ইবাদত-বন্দেগিতে ও তওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমেই কাটে সে দিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। বৃদ্ধাশ্রমে যদি দীনি পরিবেশ কায়েম করা যায় তাহলে এর মাধ্যমে তারা আত্মিক প্রশান্তিও লাভ করবেন। আত্মিক প্রশান্তি মানুষকে হতাশা, দুঃখ ও বেদনা থেকে মুক্তি দেয়। মানুষ কষ্টের মাঝেও এক অনাবিল সুখ খুঁজে পায়। এজন্য বৃদ্ধাশ্রমকে যদি দীনি তালিম ও ইবাদতের উপযোগী করে তোলা যায় তাহলে অন্তত শেষ জীবনে হলেও তারা নিজেদেরকে আখেরাতমুখী করে ঈমান-আমল নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারবেন। এতো একজন মুসলমানের জন্য মহা সফলতা।
আল্লাহ তায়ালা সুরা নাছরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জীবনের শেষ সময়ে আল্লাহ তায়ালার হামদ ও তাসবিহ এবং বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফারের আদেশ করে উম্মতকে এ শিক্ষা দিয়েছেন, তারা যেন জীবনের শেষ সময়ে বেশি বেশি আল্লাহ তায়ালার হামদ ও তাসবিহ, জিকির-আজকার করেন, ইবাদত-বন্দেগিতে রত থাকেন। আল্লাহ তায়ালার দরবারে বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা কর ও তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল।’ (সুরা নাছর: ৩)।
বৃদ্ধ বয়সের অশুভ পরিণতি থেকে রক্ষা পেতে নিম্নের দোয়া পাঠ করা জরুরি। মুস‘আব ইবনু সা‘দ ও আমর ইবনু মায়মুন হতে বর্ণিত, তারা উভয়ে বলেন, ‘সাদ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রা.) তার সন্তানদেরকে নিম্নোক্ত বাক্যগুলো এমনভাবে শিক্ষা দিতেন, যেমনভাবে মক্তবে শিক্ষক শিশুদেরকে শিক্ষা দেন। আর তিনি বলতেন, রাসুল (সা.) সালাতের পর এগুলো দ্বারা আল্লাহ তায়ালার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতেন, ‘হে আল্লাহ! তোমার কাছে আমি ভীরুতা হতে আশ্রয় চাই, তোমার কাছে কৃপণতা হতে আশ্রয় চাই, তোমার কাছে অতি বার্ধক্যে পৌঁছার বয়স হতে আশ্রয় চাই এবং তোমার কাছে দুনিয়ার ঝগড়া-বিবাদ ও কবরের শাস্তি হতে আশ্রয় চাই। (বুখারি: ২৮২২)
বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবা শিশুদের মতো হয়ে যান। শিশুসুলভ আচরণ করেন। তারা যেমন করে আমাদেরকে শৈশব থেকে শুরু করে শত ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে মানুষ করেছেন। আমাদেরও কতর্ব্য সেই মানুষগুলোকে জীবনের শেষ সময়টুকুতে বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে না রেখে নিজের কাছে রেখে সেবা করা। মনে রাখা সমীচিন যে, আমরাও একদিন বৃদ্ধ হব। আমরা যদি আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি, আমাদের সন্তানরাও হয়তো একদিন আমাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে।
সুতরাং আমাদের উচিত বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে না রেখে নিজেদের কাছে রাখা, তাদেরকে ভালোবাসা, আমাদের শৈশবে তারা যেমনটি করেছিলেন। অতএব বৃদ্ধাশ্রম নয় নিজ আবাসস্থলই হোক মা-বাবার শেষ আশ্রয়স্থল।
পিতা-মাতার মত এত অকৃত্রিম বন্ধু ও পরম দয়াবান আর কেউ নেই পৃথিবীতে। অন্যদের বন্ধুত্ব ও দয়ায় কোন স্বার্থ থাকলে থাকতেও পারে; কিন্তু পিতা-মাতার স্নেহ-মায়া ও দান-দয়ায় কোন স্বার্থ নেই। কোন কৃত্রিমতা ও লৌকিকতা নেই। সন্তানের প্রতি তাদের দরদ স্নেহ ও দয়া হয় নিখাঁদ, নির্মল, নিষ্কলুষ ও খাঁটি। সৃষ্টির মধ্যে তাদের মত দরদি আর কেউ থাকার প্রশ্নই আসে না। তারা নিজেদের খাওয়া-পরা, আরাম-আয়েশের চিন্তা না করে সন্তানের খাওয়া-পরা, আরাম-আয়েশের ফিকির করেন। এজন্য পরিশ্রম করেন। জীবনবাজি রাখেন। আমাদের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে ও জীবনের পরতে পরতে তাদের এত বিপুল অনুগ্রহ ও অবদান বিদ্যমান, যা কখনো শোধ করা সম্ভব নয়। এর দাবী এটাই যে- আমরা তাদের ভালোবাসব, সম্মান করব, খেদমত করব। আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা করব। পবিত্র কুরআন-সুন্নাহও সেবা-যত্ন করে তাদের মন জয় করতে বলেছে। সন্তান তার পিতা-মাতার খেদমত করবে, তাদের ভরণ-পোষণ ও দেখভাল করবে, সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে- এটাই স্বভাব ও প্রকৃতির চাহিদা। মানবতার দাবী। ইসলামের বিধান ও স্রষ্টার নির্দেশ।
সন্তান যত বড় শিক্ষিত, জ্ঞানীগুণী আধুনিক আর প্রগতিশীলই হোক- সে যদি তার পিতা-মাতাকে মর্যাদা না দেয়, খেদমত না করে, খোঁজ-খবর না রাখে সে তো মানুষ নামের কলঙ্ক। অন্যান্য বহুবিধ গুণ তার থাকলেও মনুষ্যত্ব বা মানবতার গুণ থেকে সে বঞ্চিত। সন্তানের কাছে এমন অসদগুণ থাকা অবাঞ্ছিত ও অপ্রত্যাশিত। সন্তান কর্তৃক জনক-জননীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধামিশ্রিত খেদমতই মূল বিষয়। যে সেবার মধ্যে স্নেহ-মমতা আছে, সম্মান-শ্রদ্ধা আছে, সংবেদনশীল দরদ আছে- সেটিই খেদমত। সেটিই প্রত্যাশিত। যে সেবা এসব থেকে মুক্ত, সেটা খেদমত নয়। এমন খেদমতে পিতা-মাতা শান্তি পান না। সন্তুষ্ট হন না। নিজেদের বরং পরনির্ভরশীল, অন্যের ঘাড়ে বোঝা মনে করে কষ্ট পান। সন্তানের কাছ থেকে বর্ণিত অর্থে খেদমত পাওয়া- এ তো সন্তানের ওপর মা-বাবার অধিকার, হক্কুল ইবাদ। এটা সন্তানের কোন অনুগ্রহ নয়, দয়া-দাক্ষিণ্য নয়। এটা আদায় না করলে আল্লাহর আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করতে হবে।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ