ঢাকা, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আবহমান ঐতিহ্যের ওয়াজ-মাহফিল

প্রকাশনার সময়: ১৮ নভেম্বর ২০২২, ১০:২৬

শীতকালে আমাদের দেশের গ্রামে-গঞ্জে শহরে-নগরে ওয়াজ মাহফিলের ধুম পড়ে যায়। তীব্র শীতে লেপ-কম্বলের তলে মুটিয়ে যাওয়া শরীরটাকে ঈমানি জযবায় চাঙা করে তুলতে ওয়াজ-মাহফিলের ভূমিকা অনন্য। আর ওয়াজ-মাহফিল এদেশের গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের অংশ। আবহমানকাল ধরে বাঙালি মুসলিম সমাজে এটি প্রচলিত।

কোরআন কারিমের ৭৭টি নামের এক নাম হলো ‘ওয়াজ’ বা উপদেশ। মহান আল্লাহ হলেন প্রথম ওয়ায়েজ বা ওয়াজকারী। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন দ্বিতীয় ওয়ায়েজ। এই সূত্রে নবী করিম (সা.)-এর উত্তরাধিকারী আলেমরা ওয়ায়েজিন। এই উম্মতের দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করবেন ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া তথা নবীদের উত্তরাধিকারী উলামায়ে কিরাম। আর উলামায়ে কিরামের দায়িত্ব হলো এই দাওয়াতি কাজ কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত রাখা। ওয়াজ, নসিহত, বয়ান, খুতবা, তাফসির ইত্যাদি দাওয়াতের প্রচলিত মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’ (সুরা নাহল: ১২৫)

দাওয়াতি আলোচনার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। যেমন: ওয়াজ, নসিহত, বয়ান, খুতবা, তাফসির ইত্যাদি। ‘ওয়াজ’ হলো সুন্দর, আকর্ষণীয়, যুক্তিপূর্ণ ও হূদয়স্পর্শী আবেদনময় আলোচনা। আর দেশ-বিদেশের সমকালীন খ্যাতিসম্পন্ন ওলামায়ে কেরাম তাতে উপস্থিত থেকে কোরআন-হাদিসের আলোকে সারগর্ভ নসিহত পেশ করেন। মুসলমানদের ঈমান-আকিদা ও আমলি সংশোধন, আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং যুগসচেতন হওয়ার আহ্বান করেন। ওলামা ও বুজুর্গানে দীনদের মাঝে ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতের কোনো ঘাটতি নেই। সামাজিক সংগঠন থেকে নিয়ে ব্যক্তি উদ্যোগে আয়োজিত মাহফিলগুলোর ইতিবাচক ফায়েদা কিন্তু একেবারে কম নয়।

মদ-জুয়া, যাত্রা, নর্তকী ও গানের কনসার্টের বিপরীতে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন সত্যিই খুব প্রশংসার দাবি রাখে। তবে মাহফিলগুলো যাতে করে রেওয়াজ ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। ইলম ও আমলওয়ালা আলেম ও বুজুর্গদের মাহফিলে দাওয়াতের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শুধু সুন্দর সুর-কণ্ঠ, মাঠ কাঁপানো ও কন্টাক্টওয়ালা বক্তাদের দিয়ে আজীবন ওয়াজ করালেও একজন মানুষেরও হেদায়াত হবে না। অযথা টাকা খরচ ও সময় নষ্ট এবং বিনোদন বৈকি।

আজ আমরা একথা স্বীকার করতে বাধ্য, আমাদের বর্তমানের মাহফিলগুলো আগের মতো এত প্রভাব রাখতে পারছে না। আগে বক্তাদের ইলম যাই ছিল, আমল ছিল ততধিক। ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতেরও কোনো ঘাটতি ছিল না। পক্ষান্তরে এখনকার ওয়াজ-মাহফিলগুলোতে ইখলাসের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। শ্রোতাদের নিবেদন রক্ষার্থে বেশিরভাগ মাহফিলে চুক্তি করা বক্তাদের আমন্ত্রন জানানো হচ্ছে। আসলে এটা সমাজেরই দোষ। সমাজ যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তেমনি মানুষের ভেতরের খুলুছিয়ত ও লিল্লাহিয়ত হ্রাস পাচ্ছে।

ওয়াজের উদ্দেশ্যে কী হবে, ওয়াজ কী ও কেন এটা অনেকেরই অজানা। হাদিসের আলোকে বলা যায়, ওয়াজের উদ্দেশ্যে হবে মানুষকে ইহ-পরকালীন কল্যাণের পথনির্দেশ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করা। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ শুধু ওই আমল কবুল করেন, যা তার সন্তুষ্টির জন্য করা হয়।’ (সুনানে বায়হাকি)

আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে ভাষার প্রাঞ্জলতা শেখে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার কোনো ফরজ ও নফল ইবাদত কবুল করবেন না।’ (মিশকাত : ৪১০) সুতরাং আল্লাহর সন্তুষ্টি, দীনের দাওয়াত ও মানুষের হেদায়াতকে লক্ষ্য না বানিয়ে যতই ওয়াজ হোক তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে না এবং এর দ্বারা মানুষের কোনো উপকারও সাধিত হয় না। অর্থ-কড়ি, যশ-খ্যাতি ও দুনিয়াবি কোনো স্বার্থ হাসিলের জন্য যারা ওয়াজ করে বা ওয়াজের আয়োজন করে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

ইমাম গাজালি (রহ.) তার লিখিত গ্রন্থ ‘আইয়্যুহাল ওয়ালাদ’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ওয়াজকারীদের ওয়াজ দ্বারা উদ্দেশ্যে যেন হয় মানুষকে দুনিয়া থেকে আখেরাতের প্রতি, গোনাহ থেকে নেকির প্রতি, লোভ থেকে পরিতুষ্টির প্রতি আহ্বান করা। এরই ভিত্তিতে বক্তাগণ শ্রোতাদেরকে পরকালীনমুখী ও দুনিয়াবিমুখ করে গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো। ইবাদত-বন্দেগি ও তাকওয়ার দীক্ষা দান করা। সর্বোপরি আত্মিক অবস্থা পরিবর্তনের সাধনা করা। এটাই প্রকৃত ওয়াজ। আর যে বক্তা এরূপ উদ্দেশ্যে ব্যতিরেকে ওয়াজ করবে তার ওয়াজ মানুষের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। দীনদার মুসলমানগণ যেন এ রকম বক্তা ও ওয়াজ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে।’ (মাজালিসুল আবরার: ৪৮২)

বক্তাদের জন্য পাঁচটি জিনিস অত্যাবশ্যক: সেগুলো হলো— ১. ইলম। কেননা ইলমহীন ব্যক্তি সঠিক ও বিশুদ্ধ বয়ান করতে অক্ষম। ২. আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর দীন প্রচারের উদ্দেশ্যে। ৩. যা বয়ান করবেন তা আমল করা। ৪. শ্রোতাদের ওপর দয়ার্দ্র ও বিনম্র হয়ে বক্তার কথা বলা। ৫. বক্তা ধৈর্যশীল ও সহনশীল হওয়া। (ফাতওয়ায়ে আলমগীরি : ৪/১১০)

ওয়াজকারি ব্যক্তির জন্য দুটি গুণ থাকা অপরিহার্য। যদি দুই গুণ না থাকে তাহলে মানুষের হেদায়াত হবে না। কোরআনুল কারিমে আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘তোমরা তাদেরকে অনুসরণ কর যারা দীনি বিষয়ে কোনো পারিশ্রমিক চায় না এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত।’ (সুরা ইয়াসিন: ২১)

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘শেষ জামানায় একদল লোক বের হবে, যারা হবে বয়সে অল্প, বিদ্যায় অপরিপক্ব। তারা কোরআনের কথা বলবে কিন্তু এর প্রভাব নিজ কণ্ঠনালি অতিক্রম করবে না। (অর্থাৎ বাস্তব জীবনে এর ওপর আমল করবে না।) তারা দুনিয়াবাসীর মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার চমৎকার কথা বলবে। অথচ ধনুক থেকে তীর ছোটার গতিতে তারা দীন থেকে বেরিয়ে যাবে।’ (তিরমিজি)

এ হাদিসে আমলহীন আলোচকের ব্যাপারে সতর্ক করার পাশাপাশি তাদের ভয়াবহ পরিণামের কথাও বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং, দীনি আলোচক নির্বাচনে অবশ্যই তার ইলম ও জ্ঞানের বহরের সঙ্গে সঙ্গে আমলি হালচাল জেনে নেয়া আবশ্যকীয়। আর চারিত্রিক সৌন্দর্য এমন একটি বিষয় যা ছাড়া কেউ ইসলামের প্রকৃত দাঈ বা মুবাল্লিগ হতে পারে না। ওয়াজ-মাহফিলের আলোচকও প্রকৃতপক্ষে একজন দাঈ ও মুবাল্লিগ। বাস্তবিক অর্থে যিনি ওয়াজ-নসিহত করেন, হেদায়াতের কথা বলেন তিনি হলেন নবীওয়ালা কাজের উত্তরাধিকারী। সুতরাং অবশ্যই তাকে চারিত্রিক মাধুর্য ও আদর্শিক গুণাবলির অধিকারী হতে হবে।

রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রশংসনীয় গুণাবলিতে পূর্ণতার রূপ দেয়ার জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি।’ মুয়ায (রা.) বর্ণনা করেন, আমি যখন উটের পাদানিতে পা রাখি তখন রাসুল (সা.) সর্বশেষ যে নসিহত করেছিলেন তা হলো, হে মুয়াজ! তুমি মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ করবে।’ (মুয়াত্তা মালেক)।

পরিশেষে বলতে চাই, কেউ নিজেকে রাসুলের অনুসারী ও উত্তরাধিকারী বলে দাবি করবে অথচ চারিত্রিক গুণাবলিতে তার আনুগত্য করবে না, তা হতে পারে না। সুতরাং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক চলাফেরায় সর্বত্র নববী আদর্শের বাস্তবায়ন অপরিহার্য। আর ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজকদের কাছে আরও প্রত্যাশা থাকবে, ওয়াজ-মাহফিলে কোরআন-হাদিসভিত্তিক আলোচনার জন্য বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ আলেম নির্বাচন করবেন। তাহলে জাতি আরও বেশি উপকৃত হবে এবং ওয়াজ মাহফিলের উদ্দেশ্য হাসিল হবে। বস্তুত এমন ওয়াজের মাধ্যমে পরকালে নাজাতের আশা করা যায়।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ