ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মহানবী (সা.)-এর কালজয়ী শিক্ষাদর্শন

প্রকাশনার সময়: ১৬ নভেম্বর ২০২২, ১০:৫১

একটি শিক্ষিত দেশ ও জাতি গঠনে মহানবী (সা.) যেমন গুরুত্বারোপ করেছেন, অন্য কোনো বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ এমনকি অন্য কোনো নবীও স্বজাতিকে শিক্ষিত করতে তেমন গুরুত্বারোপ করে যাননি।

শিক্ষাকে প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে তিনি ঘোষণা করেছেন বিজ্ঞানসম্মত দর্শনও সময়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কর্মসূচি। তাঁর ঘোষিত শিক্ষাদর্শন এতটাই ফলপ্রসূ ছিল যে, তাঁর প্রতিটি শিষ্য সোনার মানুষে পরিণত হয়ে যায়। তার ঘোষিত শিক্ষাদর্শনে যারা শিক্ষা গ্রহণ করে বিশ্ব শাসন করেছে, বিশ্ব ইতিহাস তাদের সেই শাসনামলকে আজো সোনালি যুগ বলে স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছে।

মানুষ যেসব গুণে অন্যান্য মাখলুকের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, শিক্ষা তন্মধ্যে অন্যতম। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়— কোন শিক্ষা মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মাখলুকাতের স্থান পাইয়ে দেয়? তা কি তথাকথিত পুঁথিগত শিক্ষা, নাকি ইলমে অহি তথা আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষা? কোন যোগ্যতা মানুষকে পশু হতে পার্থক্য করে দিয়েছে?

এসব প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো মহানবী (সা.)-এর ঘোষিত শিক্ষাদর্শন মোতাবেক যে শিক্ষা, সেটিই মূলত প্রকৃত শিক্ষা। আর সেটি হলো কোরআনি শিক্ষা। যাকে বলা হয় ইলমে অহি। এ জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা মহান আল্লাহ একমাত্র মানুষকেই দান করেছেন। অন্য কোনো মাখলুককে তা দেননি।

বিশ্বনবী (সা.)-এর আনিত শিক্ষাদর্শন গ্রহণ করার গুরুত্বারোপ করে মহান আল্লাহ কোরআনে কারিমে ঘোষণা করেন: ‘বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান?’ (সুরা জুমার: ৩৯) অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞানদান করা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তাদের মর্যাদায় উন্নত করবেন।’

বিশ্ব সভ্যতার নির্মাতা রাসুল (সা.) জ্ঞানার্জনকে প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ ঘোষণা করেন। হাদিস শরিফে এসেছে, ইলমে অহি অন্বেষণ করা প্রতিটি মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য।

রাসুল (সা.) আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যে ঐশী বিধান নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন এবং সমাজে যে বাণী প্রচার করেন তার মর্মকথা উপলব্ধি করার জন্যও জ্ঞান আহরণ করা ছিল অপরিহার্য। তাই তিনি সমাজের নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও শিক্ষাকর্মসূচি বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন এবং যৌক্তিক শিক্ষাদর্শন ও সময়োপযোগী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। শিক্ষা বিস্তারে তিনি যে দর্শন পেশ করেন তা আজও অন্য কোনো শিক্ষাব্যবস্থা পেশ করতে পারেনি। তার মুখনিঃসৃত প্রতিটি বাণী জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল্যবান তথ্য উপকরণ হিসেবে গণ্য।

প্রিয়নবী (সা.) আরবদের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে নিরক্ষরতামুক্ত সমাজ গঠনে কিছু ফলপ্রসূ শিক্ষাদর্শন প্রদান করেন এবং কর্মসূচি হাতে নেন। মক্কি জীবনেই তিনি এসব শিক্ষাদর্শন ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং আরকাম ইবনে আবুল আরকামের বাড়িতে একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন। রাসুল (সা.) নিজেই ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক। আর নবদীক্ষিত সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র।

মদিনায় হিজরতের পর রাসুল (সা.) হজরত আবু উসামা বিন জুবায়েরের (রা) বাড়িতে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মুসআব বিন উমায়ের (রা.)-কে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিযুক্ত করেন। মদিনায় হজরত আবু আইয়ুব আনসারীর বাসভবনে রাসুল (সা.) আরও একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে দীর্ঘ আট মাস শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করেন। শিক্ষার আলো আরও সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে রাসুল (সা.) মসজিদভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন।

সাহাবায়ে কেরাম শিক্ষার আলো আহরণের জন্য মসজিদে নববীতে সমবেত হতেন। সেখানে নিয়মিত ধর্মীয় আলোচনা হতো। মসজিদে নববীর আঙ্গিনায় বসবাসকারী ছাত্রদের ‘আসহাবুস সুফফা’ বলা হতো। তারা সব সময় রাসুল (সা.)-এর সান্নিধ্যে থেকে দীনি জ্ঞান আহরণ করতেন। রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর তারাই মুসলিম বিশ্বের শিক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করেন।

মহানবী (সা.) শিক্ষা অর্জনের প্রতি সাহাবায়ে কেরামকে এতটাই অনুপ্রাণিত করেন, দূরবর্তী গোত্রগুলো থেকে অনেক নওমুসলিম শিক্ষা গ্রহণের জন্য মদিনায় আসতে থাকেন। তারা কিছুদিন রাসুল (সা.)-এর সাহচর্যে থেকে দীনি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে আবার স্বগোত্রে ফিরে যেতেন।

এক হাদিসে উল্লেখ আছে, মালিক ইবনে হুওয়াইরিস (রা.) একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মদিনায় আগমন করেন এবং বিশ দিন সেখানে থেকে দীনের মৌলিক বিষয়ে জ্ঞানলাভ করেন। ফিরে যাওয়ার সময় রাসুল (সা.) তাকে ও তার সঙ্গীদের বলেন: ‘তারা যা কিছু শিখেছে তা যেন তার গোত্রের লোকদের শিক্ষা দেয়।’

বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত মহানবী (সা.) নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজনে জীবনের চরম শত্রুকেও শিক্ষকের মর্যাদায় সমাসীন করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি। বদরের যুদ্ধে কাফেরদের ৭০ জন মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। রাসুল (সা.) তাদের অনেককে এই শর্তে মুক্ত করে দেন যে, তাদের প্রত্যেকেই দশজন করে নিরক্ষর মুসলমানকে অক্ষরজ্ঞান দান করবে। দূরবর্তী এলাকার যেসব নওমুসলিম মদিনায় আসতে পারতো না, তাদের জন্য নিজ এলাকায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থাও করা হয়। এজন্য বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষকদের পাঠানো হয়।

তাছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত গভর্নরদের প্রতি নির্দেশ ছিল— তারা যেন নিজ নিজ এলাকার অধিবাসীদের ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষাদান করেন।

মোটকথা রাসুল (সা.) তাঁর অনুসারীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে নিরক্ষরতামুক্ত একটি আলোকিত সমাজ গড়ে তোলেন। পর্যায়ক্রমে যা বিশ্বসভ্যতা বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যায়।

শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী যত অনিয়ম, অন্যায়, হানাহানি, খুনাখুনি, লুটপাট, অস্ত্রবাজি চলছে তা এই তথাকথিত শিক্ষিত নামধারীদের মাধ্যমেই সংঘটিত হচ্ছে। শিক্ষিতের লেবেলধারীরাই হিরোশিমা-নাগাসাকিতে লাখো বনি আদমকে হত্যা করেছে।

যার নেতিবাচক প্রভাব আজো বিশ্ববাসী অসহায়ভাবে বয়ে চলেছে। বিশ্বশিক্ষিত দাবিদাররাই ইরাক-আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনে রক্তের হোলিখেলায় সমানতালে মেতেছে। কথিত শিক্ষিতরাই গাজায় পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে দানবোন্মাদনায় মেতেছে, সভ্যতার ধ্বজাধারীরাই আরাকানে, মিয়ানমারে, বার্মায় জীবন্ত মানুষকে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মেরেছে। চেয়ারধারী শিক্ষিতের কলমের খোঁচায়ই দেশ ও জাতি আজ ক্ষতবিক্ষত।

তাই এ কথা অকপটেই স্বীকার করতে হবে যে, শুধু পুঁথিগত বিদ্যাই জাতির মেরুদণ্ড- নয়; বরং সুশিক্ষাই জাতির প্রকৃত মেরুদণ্ড। আর এই সুশিক্ষাই একটি দেশের প্রকৃত মানবসম্পদ গড়ে তোলে। তাই আজও যদি সর্বস্তরে মহানবী (সা.)-এর শিক্ষাদর্শন বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে মানুষে মানুষে পার্থক্যের অসভ্যতা ও নোংরামি থেকে জাতি মুক্তি পাবে।

লেখক: আলোচক, বাংলাদেশ বেতার

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ