ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে

প্রকাশনার সময়: ০৯ অক্টোবর ২০২২, ১৪:০৭ | আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২২, ১৪:৩১
মসজিদে নববির সবুজ গম্বুজ; যেখানে শুয়ে আছেন প্রিয় নবী (সা.)। মদিনা মুনাওয়ারা, সৌদি আরব - ছবি - সংগৃহীত

আরবের চারদিক তখন ঘোর অন্ধকার, অন্যায় অরাজকাতা। প্রতিদিনই ভেসে আসে বিধবার বিলাপ। কন্যাহারা মায়ের আর্তনাদ। থেমে থেমে শোনা যায় হায়েনাদের অট্টহাসি। কখনো সে হায়েনারা মেতে উঠে রক্তের খেলায়। এমনি এক সময় আকাশ থেকে নেমে আসে এক পবিত্র আলোর বাতি। যার আলোয় আলোকিত হয়ে যায় পৃথিবী।

হুমায়ূন আহমেদ তার অসমাপ্ত উপন্যাস নবিজীর ভূমিকায় রাসুলের আগমনকে এইভাবে উল্লেখ করেছেন- ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’। বিখ্যাত এই গানের কলি শুনলেই অতি আনন্দময় একটি ছবি ভেসে ওঠে। মা মুগ্ধ চোখে নবজাতক শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর কোলে পূর্ণিমার স্নিগ্ধ চাঁদ। তাঁর চোখ-মুখ আনন্দে ঝলমল করছে।

শিশুটির বাবা নেই। জন্মের আগে বাবা আবদুল্লাহ মারা যান। মা আমিনার হৃদয় সেই দুঃখেই কাতর। আরবের শুষ্ক কঠিন ভূমিতে পিতৃহীন একটি ছেলের বড় হয়ে ওঠার কঠিন সময়ের কথা মনে করে তাঁর শঙ্কিত থাকার কথা। শিশুর জন্মলগ্নে মা আমিনার দুঃখ-কষ্ট যে মানুষটি হঠাৎ দূর করে দিলেন, তিনি ছেলের দাদাজান।

আবদুল মোতালেব; তিনি ছেলেকে দু’হাতে তুলে নিলেন। ছুটে গেলেন কাবার দিকে। কাবার সামনে শিশুটিকে দু’হাতে ওপরে তুলে উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘আমি এই নবজাতক শিশুর নাম রাখলাম, ‘মুহম্মদ!’ সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। নতুন নাম। আরবে এই নাম রাখা হয়নি কারও। একজন বলল, এই নাম কেন? বললেন, মুহম্মদ শব্দের অর্থ প্রশংসিত; একদিন এই সম্মানিত শিশু জান্নাত ও পৃথিবী; দুই জায়গাতেই প্রশংসিত হবেন।

শিশুর জন্ম উপলক্ষে (জন্মের সপ্তম দিনে) দাদা আব্দুল মোতালেব বিশাল ভোজের আয়োজন করলেন। শিশুর চাচারাও আনন্দিত। এক চাচা আবু লাহাব তো আনন্দের আতিশয্যে একজন ক্রীতদাসী আজাদ করে দিলেন। ক্রীতদাসীর নাম সুয়াইবা ।

হঠাৎ করেই বদলে যায় সবকিছু। আরব থেকে আজম, পূর্ব থেকে পশ্চিম, সর্বত্র ছড়িয়ে যায় সে ঐশী ধ্বনি ও ধ্বনির বাহকের গুণগান। সেই বাহক, সেই নুর; আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.)। ‘ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউসাল্লুনা আলান্নাবিয়্য’। ইয়া আইয়ু হাল্লাজিনা আমানু সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা।’

রাসুল (সা.) পৃথিবীতে আগমন করেই মানবজাতিকে শান্তির পথে ডাকতে লাগলেন। এক আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিলেন। তখন শুরু হয়ে গেল তাঁর ওপর জুলুম-নির্যাতন। তিনি তাঁর জাতিকে বললেন, ‘তোমরা সবাই এক আল্লাহর আনুগত্য কর, সততা ও ইনসাফের অনুসারী হও, আমানতকারীর আমানত ফিরিয়ে দাও। এবং এতিমকে সাহায্য করো। বেশিরভাগ মানুষ তাঁর দাওয়াত অস্বীকার করল। তাঁর ওপর ক্ষেপে গেল। বিভিন্নভাবে জুলুম নির্যাতন শুরু করে দিল। দাওয়াতের পথ রুদ্ধ করতে লাগল। তাঁর পিঠে উটের ভূড়ি চাপিয়ে দিয়ে তারা ভাবল, ‘এখন আর সত্য মাথা তুলতে পারবে না।’

এসব ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আরবের জ্ঞানপাপীরা ভেবেছিল, এবার তাওহিদের আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে যাবে। যাকে কাঁটা বিছিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হলো, তিনি সবসময় ফুল বর্ষণ করতে লাগলেন। মানুষ তাঁর সততা, জীবনাদর্শ দেকে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করতে লাগল। তাঁর চরিত্রের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে শত্রুদের দল থেকেও দলে দলে লোকেরা ইসলাম গ্রহণ শুরু করলেন। এভাবে ইসলামের বিজয় হতে লাগল। যে রাসুল আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য নির্যাতনের শিকার হলো। সে রাসুলকে আমরা কতটুকু জানি? রাসুলের জীবনাদর্শ কতটুকু নিজেদের জীবনে মেনে চলি?

একদিন মা আয়েশা (রা.) নবীজির সঙ্গে ছিলেন। নবীজিকে বেশ উৎফুল্ল দেখে আয়েশা (রা.) বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। তিনি তাঁর জন্য দোয়া করলেন, হে আল্লাহ, আয়েশাকে মাফ করে দাও। তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দাও, তার আগামীর গুনাহ মাফ করে দাও, তার গোপনে করা গুনাহ মাফ করে দাও, তার প্রকাশ্যে করা গুনাহও মাফ করে দাও। আয়েশা হাসলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার এই দোয়া কি তোমাকে আনন্দিত করেছে?’ বললেন, ‘কি করে এমন দোয়া কাউকে সন্তুষ্ট করতে না পারে!’ বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি আমার উম্মতের জন্য আমার প্রতিটি নামাজে এই একই দোয়া করি।’

যে দোয়া রাসূল তাঁর প্রিয়তম স্ত্রীর জন্য করেছেন, সেই একই দোয়া প্রতি নামাজে তিনি তাঁর উম্মতের জন্য করেছেন, আপনার জন্য, আমার জন্য করেছেন। অথচ আমরা সে প্রিয় রাসুলকে ভুলে গেছি। তার জীবানার্দশ থেকে দূরে সরে গেছি। একদিন চলার পথে রাসুল (সা.) কেঁদে উঠলেন। সাহাবারা কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি আমার ভাইদের জন্য কাঁদছি। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমরা কি আপনার ভাই নই? তিনি বললেন, তোমরা তো আমার সাথী। আমার ভাই হলো তারা, যারা আমার পরে আসবে আর আমাকে না দেখেই আমার ওপর ঈমান আনবে।

রাসুল আমার জন্য আপনার জন্য কেঁদেছেন, আমাদেরকে স্মরণ করেছেন, আমরা এই দুনিয়াতে আসার আগেই। আমরা কতটুকু স্মরণ করি প্রিয় নবীজিকে? কেঁদেছি ক’ফোটা চোখের পানি ফেলে? যে নবী আমাদের জন্য প্রতি ওয়াক্ত নামাজে দোয়া করতেন, সেই নবীর নামে আমরা দিনে ক’বার দরুদ পড়ি? ভালোবেসে তার সুন্নাহ নিজের জীবনে কতটা পালন করি? একজন মুসলিম হিসেবে আমরা সবচেয়ে বেশি ভালবাসি আল্লাহকে, তারপর রাসুলকে (সা)। রাসুলকে (সা.) নিয়ে আমরা যত জানব, তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসা ততই বাড়তে থাকবে। তত নিজেদের ঈমান বৃদ্ধি করতে পারব। তাঁর জীবন আদর্শকে আঁকড়ে ধরতে পারব।

সবশেষে একটি জাগরণী গানের এক চরণের মাধ্যমে শেষ করি-

‘রাসুল আমার ভালোবাসা,

রাসুল আমার আলো আশা,

রাসূল আমার প্রেম-বিরোহের মূল আলোচনা,

রাসূল আমার কাজে-কর্মে অনুপ্রেরণা।

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ