ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬
ঈমানের পথে আসা নারীর গল্প—৫

তোমার প্রেমে ব্যাকুল হে দয়াময়

প্রকাশনার সময়: ২৮ আগস্ট ২০২২, ২২:৫৭

জীবনের শুরুতে আমি পূর্ণাঙ্গ শরয়ি পর্দা পালন করতাম না। যারা শরয়ি পর্দা মেনে জীবনযাপন করত, তাদেরকে তুচ্ছ ও তিরস্কারের চোখে দেখতাম। এভাবেই এসএসসি পাস করি। আমাদের পরিবারে টিভি-বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদির মতো গুনাহের অনেক উপকরণ ছিল। আমার অনেক ছবিও ফ্রেমে বন্দি অবস্থায় সংরক্ষিত ছিল। পর্দাহীনতা ও নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা আমাদের কাছে ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার।

এসএসসির পর ‘এফএ’ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আমি চাচার বাড়ি মিয়ানাওয়ালিতে চলে যাই। স্থানীয় একটি গার্লস কলেজে ভর্তি হই। চাচার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে থাকি। চাচাদের বাড়ির পাশে একটি সুন্দর মসজিদ ছিল। মসজিদে কিছুদিন পর পরই স্থানীয় জ্ঞানী আলেমদের তরবিয়তি ও ইসলাহি মজলিস হতো। আমার চাচা অত্যন্ত ভদ্র ও দ্বীনদার ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সর্বদা আলেম-উলামাদের সান্নিধ্যে থাকতেন। তাদের থেকে শরিয়তের বিধি-বিধান জেনে যথাযথ পালনের চেষ্টা করতেন। বাড়ির সবাইকে রুটিন মাফিক কোরআন-হাদিসের বিধানাবলি শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করতেন। ইসলাহি মজলিসে আলেমরা সব সময় দুটি বিষয়ের ওপর বেশ জোর দিতেন; অন্তরে আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা সৃষ্টি ও দৈনন্দিন জীবনে শরিয়তের প্রত্যেকটি হুকুম সঠিকভাবে জেনে-বুঝে পালন করা।

চাচার কাছে এসব শুনতে শুনতে আমার হূদয়েও আল্লাহ তায়ালার ভয় জাগ্রত হতে থাকে। আমার অন্তরে কেমন যেন ভিন্ন রকম অনুভূতি তৈরি হতে শুরু করে। চাচা একদিন খুব গুরুত্বারোপ করে পর্দা পালন সম্পর্কে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আমার অন্তরও তখন অল্প-বিস্তর পর্দা পালনের প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠছিল। হূদয়ে আল্লাহ তায়ালার ভয় প্রোথিত হচ্ছিল। কিন্তু আশপাশের মানুষের কটূক্তি, রাগ ও অসন্তুষ্টির কথা মাথায় আসলে পরক্ষণেই শরয়ি পর্দা পালনের প্রতি আগ্রহ কমে যেত। একদিন চাচা আমাকে শোনালেন, ‘আল্লাহ তায়ালাকে অসন্তুষ্ট করে মাখলুকের সন্তুষ্টি অর্জন জায়েজ নেই।’ শরিয়তের এই মূলনীতি শ্রবণের পর আমি শরয়ি পর্দা পালনের দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, মানুষ যত বিরূপ মন্তব্যই করুক না কেন, আমি এখন থেকে শরয়ি পর্দা পালন করব, ইনশাআল্লাহ!

এর মধ্যে আমার প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষে দ্বিতীয় বর্ষ শুরু হয়েছে। কিন্তু এখানে একটি বড় অসুবিধা সৃষ্টি হলো যে আমাদের গার্লস কলেজে ১০-১৫ জন সিকিউরিটি গার্ড ছিল। দায়িত্ব হিসেবে তারা সব সময় কলেজের ভেতর টহল দিত। তারা যখন তখন সব জায়গায় ঘোরাফেরা করার কারণে আমাদের পর্দা পালনে ভীষণ বিঘ্নতা দেখা দিচ্ছিল। ফলে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। কলেজের পড়াশোনা বন্ধ করা আমার জন্য মোটেও সহজ ছিল না। মনে খারাপ লাগা ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করলেও এক পর্যায়ে কলেজে পড়াশোনার ইতি ঘটে। চাচার পরামর্শে স্থানীয় একটি মহিলা মাদরাসায় ভর্তি হই। মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার সময় অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছিল সামনে। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা অনেকে অনেক আপত্তিকর কথাবার্তা বলেছিল। কিন্তু আমি কারো কোনো কথায় কান দিইনি।

আমার আপন খালু একদিন বাড়িতে বেড়াতে আসলে তার সঙ্গে পর্দা করার কারণে তিনি আমার ওপর খুব রাগান্বিত হলেন। এরপর থেকে তিনি আর আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেননি! আলহামদুলিল্লাহ, এসব সত্ত্বেও আমি শরয়ি পর্দা পালনের ওপর অটল থাকার চেষ্টা করেছি। শরয়ি পর্দা পালনের ফলেই অনেক ভয়াবহ গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পেরেছি। বাড়ি থেকে টিভি বিতাড়ন করেছি। আমার সমস্ত ছবি পুড়িয়ে ফেলেছি। গানবাজনার উপকরণ ভেঙে দিয়েছি। শরয়ি পর্দা পালনের পর থেকে নিজের ইচ্ছায় কোনো গাইরে মাহরাম পুরুষকে দেখিনি। আমার দেখাদেখি এখন আমার আদরের ছোট বোন ও এক কাজিন পূর্ণাঙ্গ শরয়ি পর্দা পালন শুরু করেছে। আরো কয়েকজন কাজিন শরয়ি পর্দা পালনের পথে আছে। কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হলে আমি দেশের হক্কানি উলামায়েকেরামের কিতাবাদি পাঠ করে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করি।

বিখ্যাত আলেম মুফতি রশিদ আহমদ (রহ.)-এর নিম্নোক্ত কথাগুলো আমার খুব উপকারে এসেছে। তিনি লিখেছেন, ‘যেসব সম্মানিত মা-বোনেরা শরয়ি পর্দা পালন করতে চান, কিন্তু পরিবার-পরিবেশের কারণে সাহস পান না, তাদের কাছে আমার সবিনয় নিবেদন, প্রথমে আপনারা অন্তরে মহান আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা তৈরি করুন। কারণ, ভালোবাসা তৈরি হয়ে গেলে কোনো সমস্যা বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। কিন্তু যদি অন্তরে আল্লাহ তায়ালার মহব্বত না থাকে, আল্লাহ তায়ালার রাজি-খুশির তড়পা না থাকে, তাহলে বাহানার কোনো অভাব থাকবে না। অসংখ্য অজুহাত এসে ভিড় করবে। যার অন্তরে খোদাপ্রেমের ব্যাকুলতা আছে, সে নষ্ট ও খারাপ পরিবেশ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। কুখ্যাত কাফের ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া (আ.) ফেরাউনের মতো বর্বর কাফেরের পরিবেশে অবস্থান করেও ঈমান আনয়ন করেছিলেন। আপনাদের পরিবেশ কি ফেরাউনের পরিবেশ থেকেও খারাপ? নবীজি (সা.)-এর কন্যা ফাতেমা (রা.) পরিপূর্ণ শরয়ি পর্দা পালন করেই কূপ থেকে পানি উত্তোলন করতেন। উটের জন্য খাবার জোগাড় করতেন। সে তুলনায় এখনকার কাজ কত হালকা! আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করি, তিনি সমস্ত মুসলমান বোনদের পরিপূর্ণ শরিয়ত মেনে জীবনযাপন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।’

ডেইলি ইসলাম-এর সাপ্লিমেন্ট থেকে অনুবাদ

আমিরুল ইসলাম লুকমান

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ