ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পদার্থবিজ্ঞানী আল-খাজিনি

প্রকাশনার সময়: ২০ জুলাই ২০২২, ০৯:১৮

দ্বাদশ শতাব্দীর জ্যোতির্বিদ আবুল ফাতহ আবদুর রহমান আল-খাজিনি (১৬০৮-১৬৪৭)। যিনি আল-খাজিনি নামে প্রসিদ্ধ। আল-খাজিনি ছিলেন ইরানি। সুলতান সানজারির জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের একজন সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব। তার মাধ্যমে বিশেষত গতিবিদ্যা ও স্থির তরল পদার্থের স্থিতি বিজ্ঞানের বিষয়ে এমন সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে, খাজিনির পরে আসা গবেষকরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যান। তার গতিবিদ্যার তত্ত্বগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো শেখানো হয়। ‘কাত ও গড়িয়ে পড়া ও বেগে ধাবিত হওয়া’— এ তথ্য দুটি গতিবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

অনেক ইতিহাসবিদ খাজিনিকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে সমস্ত যুগের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। খাজিনি তাঁর বেশিরভাগ সময় স্থির তরলের বিষয় অধ্যয়ন করার পেছনে ব্যয় করেন। তিনি নির্দিষ্ট তরলের নির্দিষ্ট ওজন জানতে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। ‘বস্তু যখন কোনো তরলের মধ্যে ডুবে যেতে থাকে, তখন যে প্রতিরোধ শক্তি তাকে নিচ থেকে ওপরের দিকে চালিত করে’ তা নিয়ে তিনি তার গবেষণায় আলোচনা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি সে ডিভাইস ব্যবহার করেন, যা তার মহান শিক্ষক আবু রায়হান আল-বিরুনি কিছু শক্ত ও তরল পদার্থের নির্দিষ্ট ভর নির্ধারণে ব্যবহার করেছিলেন।

আল-খাজিনি পরিমাণে যথার্থতার দিক দিয়ে এমন সূক্ষ্ম পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে, যা তার সমসাময়িক ও পরবর্তীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। রবার্ট হল বিজ্ঞানের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অভিধানে আল-খাজিনির ওপর লিখিত একটি নিবন্ধে তার শক্ত ও তরল বস্তুর ঘনত্ব আবিষ্কারের পদ্ধতি, বায়ু এবং পানিতে বস্তুর ওজন সম্পর্কে অবগতির ডিভাইস আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করেন। যে ডিভাইসে পাঁচটি স্তর রয়েছে, এর মধ্যে একটি ভাঁজ করা বাহুতে চলে। হামিদ মুরানি ও আবদুল হালিম মুনতাসির তাদের লিখিত কিরাআতুন ফি তারিখিল উলুমি ইনদাল আরব গ্রন্থে বলেন, ‘আল-খাজিনি এর আগে বাতাসের উপাদান ও ওজনের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘তরলের মতো বাতাসেরও ওজন ও উত্তোলনকারী ক্ষমতা রয়েছে। বায়ুতে নিমজ্জিত বস্তুর ওজন তার প্রকৃত ওজনের চেয়ে কম। আর সেই ঘাটতির পরিমাণ বাতাসের ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে। তিনি বর্ণনা করেন, আর্কিমিডিসের নিয়মটি কেবল তরলের ক্ষেত্রেই নয়, বরং গ্যাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আল-খাযিনির এই সব যুগান্তকারী তথ্য ব্যারোমিটার, বায়ু ভ্যাকুয়াম ও পাম্পের আবিষ্কারকে সহজ করে দেয়। এই কৃতিত্বের মাধ্যমে অন্যদের চেয়ে অগ্রসর হয়ে যান বিজ্ঞানী আল-খাজিনি।

পদার্থবিজ্ঞানে গতি ও মধ্যাকর্ষণ বিধিগুলো মুসলিম বিজ্ঞানীদের কৃতিত্বের অংশ বিশেষ। গতিবিদ্যার গুরুত্ব সম্পর্কে বলাইবাহুল্য। শুধু মাত্র বিজ্ঞান নয়; বরং পৃথিবীর ইতিহাসে গতিবিদ্যার গুরুত্ব এত অপরিসীম যে, এটাকে বর্তমান সভ্যতার মূল থিওরি ধরা হয়। উদাহরণস্বরূপ গাড়ি, ট্রেন, বিমান থেকে মহাকাশ রকেট, স্যাটেলাইট, ক্ষেপণাস্ত্র পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় গতিশীল যন্ত্রপাতি এই থিওরির ওপর প্রতিষ্ঠিত। গতিবিদ্যার ওপর ভিত্তি করেই মানুষ মহাকাশে অভিযান ও চাঁদে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি গতিতত্ত্বের ওপরই নির্ভরশীল।

অপটিক্স বা দৃষ্টিশক্তি হলো আলোর গতি। শব্দ হলো আলোক তরঙ্গের গতি। আর বিদ্যুৎ হলো ইলেকট্রনের গতি। অথচ বিশ্বের মানুষের কাছে সুবিদিত যে, এই তত্ত্বগুলোর আবিষ্কারক ইংরেজ বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন। ধারণার কারণ, আইজ্যাক নিউটন তার Philosophiae- অর্থাৎ আল উসুলুর রিয়াযিয়্যাহ লিল ফালসাফাতিল তবিইয়্যা গ্রন্থে এই তত্ত্বগুলো প্রকাশ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত মুসলিম বিদ্যালয়সহ বিশ্বজুড়ে এটি স্বীকৃত বিষয় ছিল। যখন সমসাময়িক মুসলিম প্রাকৃতিক বিজ্ঞানীদের একদল গবেষণার ধারাবাহিকতায় মুসলিম বিজ্ঞানীদের পাণ্ডুলিপি অধ্যয়ন শুরু করেন, তখন এই সত্যটি বেরিয়ে আসে যে, গতির সূত্র আবিষ্কারের মূল কৃতিত্ব মুসলিম বিজ্ঞানীদের।

মূলত বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন এ সকল তথ্য একত্রিতকরণ, পদার্থবিজ্ঞানের কলেবরে সংজ্ঞায়িত ও নির্দিষ্টকরণের চাইতে বেশি আর কিছু করেননি। মূলত নিউটন পদার্থবিজ্ঞানকে উৎকর্ষতার রূপ দেন। আবেগ ও তাত্ত্বিক বক্তৃতামুক্ত বাস্তবতা হলো, নিউটনের জন্মের সাতশো বছর আগে লিখিত মুসলিম বিজ্ঞানীদের পাণ্ডুলিপির নির্ভরযোগ্য অনেক সুস্পষ্ট বর্ণনা দ্বারা এক্ষেত্রে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়।

পদার্থবিজ্ঞানে মুসলমানদের ধারাবাহিক অবদানগুলোর অন্যতম হলো গতিবিদ্যার তিনটি সূত্র। যে সূত্রগুলোকে এমন ব্যক্তিদের আবিষ্কার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যারা তাদের বহু শতাব্দী পর আগমন করেন। এ ধরনের একটি সূত্র হলো মধ্যাকর্ষণ সূত্র। এই মধ্যাকর্ষণের সাহায্যেই নভোমণ্ডলীয় বস্তুগুলো নিয়ন্ত্রত হয়। এবং এগুলোর ঘূর্ণনের ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে। এই সূত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে মুসলিম বিজ্ঞানীরা কোনো বস্তুর শূন্যে ভেসে না থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়ার কারণ এবং গ্রহগুলোর সূর্যের চারিদিকে প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হন। এই বৃত্তাকারে ঘূর্ণনের কারণ হিসেবে অনুমান করা হয়েছে- ‘সূর্য ও নক্ষত্রগুলোর পারস্পরিক আকর্ষণ।’

কিন্তু মানুষের ধারণা, এই মধ্যাকর্ষণ সূত্রের আবিষ্কারক স্যার আইজ্যাক নিউটন। এক্ষেত্রে চমকপ্রদ একটা গল্প বলা হয়ে থাকে যে, একদিন নিউটন গাছের নিচে বসে ছিলেন। তখন আপেল গাছ থেকে একটি আপেল পড়লে তিনি এর অনুসন্ধান করতে করতে এই সূত্র আবিষ্কার করেন। বলা হয়ে থাকে যে, তিনি আরেকটি সূত্রও আবিষ্কার করেন। তাহলো ‘প্রত্যেক জড় পদার্থ অন্যান্য জড় পদার্থকে এমন এক শক্তি দিয়ে আকর্ষণ করে, যে শক্তি তাদের ভর ও দূরত্ব অনুযায়ী হ্রাস পায়।’ কিন্তু প্রকৃত সত্য কি এমনই যে, মধ্যাকর্ষণ সূত্রের আবিষ্কারক নিউটন? বরং বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান প্রকৃতি এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, যদি নিউটন পূর্ববর্তী মুসলিম বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলাফল জানতে না পারতেন, তাহলে তার জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ সূত্র আবিষ্কার করা সম্ভব হতো না।

এই বাস্তবতা ড. আহমদ ফুয়াদ পাশার লেখায় উঠে এসেছে। তিনি গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের ‘বস্তুসমূহের অবাধ পতন’ তত্ত্বের ব্যাখ্যা আলোচনার পর বলেন, ‘মুসলমানেরা তাদের সঠিক ধর্মের বদৌলতে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার এক নিরাপদ পদ্ধতির দিশা পান। এছাড়াও আলোকবিদ্যা, জ্যামিতি, ভূগোলবিদ্যা, দ্রাঘিমাংশ ও অক্ষাংশের আবিষ্কার, আমেরিকা আবিষ্কার, কুমেরুতে ষষ্ঠ মহাদেশ আবিষ্কার, স্পেন থেকে ভারত-রুটের আবিষ্কার, জ্যোতির্বিজ্ঞান আবিষ্কার, রসায়ন শাস্ত্রে অবদান, ওষুধ প্রস্তুত ও ব্যবহারে নিয়মকানুনে অবদান, ফার্মেসি বিষয়ে মুসলিম বিজ্ঞানীদের রচনাবলি, খনিজ এবং শিলার ধারণা, শিলা পাথরের গঠন প্রক্রিয়া, আবহ-বিদ্যা, জীবাশ্ম, বীজগণিত, প্রকৌশলবিদ্যাসহ অসংখ্য সৃষ্টিশীলকাজের আবিষ্কারক ছিলেন মুসলিমবিজ্ঞানীরা।’

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ