বিদায় হজে আরাফার দিনে আল্লাহ তায়ালা একটি মহান আয়াত নাযিল করেছেন। যা এই উম্মতের জন্য বিরাট নেয়ামত হিসেবে গণ্য। ‘আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।’ (সূরা মায়েদা:৩)
আরাফার দিনে আল্লাহ তায়ালা এই দ্বীনকে পরিপূর্ণ করার ৮১ দিন পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেছেন। অতএব, এরপর থেকে মুসলমানদের জন্য অন্য আর কোনো ধর্মের প্রয়োজন নেই। নবীজি ছাড়া অন্য আর কোনো নবীর অনুসরণের দরকার নেই। আল্লাহ তায়ালা ইসলামকে পরিপূর্ণ করেছেন এবং পূর্ণাঙ্গতা দান করেছেন। সুতরাং, এতে অতিরিক্ত কিছু সংযোজনের সুযোগ নেই। আল্লাহর রাসুল ঘোষণা করেছেন, ‘আমাদের এই দ্বীনের ভিতর দ্বীন নয়— এমন কিছু কেউ উদ্ভাবন করলে তা প্রত্যাখ্যাত।’ (বুখারি, মুসলিম)
ইসলাম এমন একটি দ্বীন ও ধর্ম। যার রীতিনীতি, বিধিবিধান ও আচার-আচরণ সম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণ। এমন একটি দ্বীন যা চিরস্থায়ী, চিরন্তন ও বিশ্বজনীন। সময় যতই পরিবর্তন হোক, যুগ যতই আধুনিক হোক ইসলামের প্রতিটি নিয়ম-শৃঙ্খলা জীবন ঘনিষ্ঠ ও সময় সাপেক্ষ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আমার সুন্নত ও সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদ্বিনের রীতিকে আঁকড়ে ধরবে এবং তা দাঁত দিয়ে মজবুত করে ধরে থাকবে। আর তোমরা দ্বীনে নব উদ্ভাবিত কর্মসমূহ (বিদআত) থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ, প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা।’ (আবু দাউদ)
আল্লাহ তায়ালা ইসলামের ব্যাপারে মুসলমানদের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সুতরাং, তিনি কখনোই তাদের থেকে এ ধর্ম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করবেন না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম তালাশ করে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সূরা আলে ইমরান: ৮৫)
সবসময় সবখানে সর্বাবস্থায় সবার জন্য ইসলামি শরিয়ত হলো একটি জাতি প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে মজবুত ভিত্তি এবং মানুষের মধ্যে বিবাদ মীমাংসায় সবচেয়ে বড় সমাধানকারী। তাই তো যুগ যতই অগ্রগামী হয়েছে, মানুষ যতই অগ্রগতি লাভ করেছে, সবসময় ইসলামের বিশুদ্ধতা ও উন্নত অবস্থা অনুধাবন করতে নতুন নতুন দলিল-প্রমাণ প্রকাশ পেয়েছে।
ইসলামের পূর্ণাঙ্গতার পরিচায়ক হলো এর কোনো অংশকে বিছিন্ন করা যায় না এবং এর একতা ও ঐক্যকে বিভক্ত করা যায় না। দ্বীনের কোনো বিধি-বিধানে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া যায় না এবং শরিয়তের অকাট্য বিষয়ে কোনো মতানৈক্যও পাওয়া যাবে না।
ইসলাম হলো একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। শান্তি-সংঘাত, রাজনীতি-অর্থনীতিসহ দুনিয়া-আখেরাতে প্রতিটি প্রয়োজনে মানুষ ইসলামের সাড়া পেয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তোমার ওপর এমন বিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে রয়েছে প্রতিটি জিনিসের বর্ণনা।’(সূরা নাহল : ৮৯)
ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত বিধান। এটি যেমন বাহ্যিক বিষয়ে সংশোধন করেছে অনুরূপ অন্তরীণ বিষয়ে সতর্ক করেছে। ইসলাম সকল দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে। তাই মানুষ এতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু খুঁজে পাবে না। দুনিয়া ও আখেরাতের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ ধর্ম। সুতরাং, একেবারে দুনিয়াবিখুতা এ ধর্মে যেমন নিন্দনীয়, অনুরূপ দুনিয়ার ভোগবিলাসে পরিপূর্ণরূপে নিমজ্জিত হওয়াও দুষণীয়। বরং ইসলাম বলে দুনিয়া হলো আখেরাতের খেতস্বরূপ।
ইসলামধর্ম সকল জাতি ও উপজাতিকে কাছে টেনে নিয়েছে। স্বজনপ্রীতি ও বর্ণবাদকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। পুরো বিশ্বের মানুষকে এক করেছে। বিদায় হজে নবীজির বাণী, ‘মনে রেখো! অনারবের ওপর আরবের ও আরবের ওপর অনারবের এবং শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের ও কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনোই বিশেষত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শুধু আল্লাহভীতি ও ধর্মপালনের দিক দিয়েই এ বিশেষত্ব বিবেচিত হতে পারে।’ (মুসনাদে আহমাদ)
ইসলামধর্ম যুগের পরিবর্তনকে অনুধাবন করেছে। মানুষের চাহিদা পূরণে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। জীবনের নিত্যনতুন বিষয়ের শরিয়তের উদ্দেশ্য বজায় রেখে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করেছে এবং এমন কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যাতে কোনো সঙ্কীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতার অবকাশ নেই।
ইসলাম আমাদের মেধা-মস্তিষ্কের হেফাজত করেছে। এজন্য মদ, গাঁজাসহ সব ধরনের মাদকদ্রব্য ও মস্তিষ্ক বিকৃতকারী জিনিসকে হারাম ঘোষণা করেছে। ইসলাম আমাদের অর্থ-সম্পদের হেফাজত করেছে। একারণে আমানতের প্রতি উৎসাহিত করেছে এবং চুরি, ডাকাতি হারাম করেছে। আমাদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার হেফাজত করেছে। ইসলাম আমাদের জানের নিরাপত্তা প্রদান করেছে। তাই গুম, খুন আর অবৈধ হত্যা হারাম ঘোষণা করেছে। ইসলাম আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক সংরক্ষণ করেছে। পারিবারিক ব্যবস্থা প্রণয়ন ও বৈবাহিক জীবনের মাধ্যমে
আমাদের মানসম্মান হেফাজত করেছে। এক্ষেত্রে প্রবৃত্তিকে এতটা স্বাধীনতা দেয়নি যে, কোনো সীমাবদ্ধতা ও সতর্কতা না মেনে লাগামহীনভাবে মনোবাসনা চরিতার্থ করবে। সুতরাং, ইসলাম বংশের পরিচয় হেফাজত করেছে। নারীর সম্মান সম্ভ্রম রক্ষা করেছে। পারিবারিক অবকাঠামো সংরক্ষণ করেছে।
ইসলাম আমাদেরকে বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত, অপরিচিত, কাছের, দূরের এমনকি শত্রুর সঙ্গেও ইনসাফ করতে বলেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনো ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার করো এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা যা করো, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত।’ (সূরা মায়েদা: ৮)
ইসলাম শক্তি, সবল পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ধর্ম। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর নিকট শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিন অপেক্ষা অধিক উত্তম ও প্রিয়। তাদের সবার মধ্যে রয়েছে কল্যাণ।’ (মুসলিম)
ইসলাম অন্তরসমূহকে একত্র করেছে। এটি সম্প্রীতি, সমাবেশ, হূদ্যতা ও আন্তরিকতার ধর্ম।
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা, ঈদ তো এসেছে, ইসলামের এই বৈশিষ্ট্যগুলো আবার নতুন করে আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে। পারস্পরিক সম্পর্ক ও আন্তরিক বন্ধন মজবুত করতে।
ইসলাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও বিশ্বাসই শান্তি ও নিরাপত্তার নিয়ামক। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘অতএব, তারা যেন এবাদত করে এই ঘরের পালনকর্তার। যিনি তাদেরকে ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং যুদ্ধভীতি থেকে তাদেরকে নিরাপদ করেছেন।’ (সূরা কুরাইশ: ৩-৪)
ইসলাম আমাদের সচ্চরিত ও সুন্দর আমলে উৎসাহিত করেছে। আদেশ দিয়েছে অন্যের দোষ গোপন করতে, অপর মুসলমানের প্রয়োজনে সাড়া দিতে, অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করতে, জানাজাকে বিদায় জানাতে এবং নিজের জন্য যা পছন্দ করি অপর ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করতে।
ইসলাম আমাদের আদেশ করেছে, পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে, স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের সকলের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করতে, আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখতে, পশুপাখির প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসংগত কাজ এবং অবাধ্যতা করতে বারণ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা স্মরণ রাখ। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসংগত কাজ এবং অবাধ্যতা করতে বারণ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা স্মরণ রাখ।’ (সূরা নাহল: ৯০)
হে মুসলমানগণ, ঈদের আগমনে আনন্দ প্রকাশ করুন। কারণ আনন্দ-উৎসব অন্তরে প্রশান্তি আনে। উদ্যমতাকে নবায়ন করে। চিন্তা পেরেশানি দূূর করে। মনে রাখতে হবে আমরা আনন্দ-উৎসব করব শরিয়তের গণ্ডির ভেতর থেকে এবং আখলাক চরিত্রের শুচিতা বজায় রেখে। তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম সালিহাল আমাল। আল্লাহ আমাৃদর এবং আপনাদের যাবতীয় নেক আমল কবুল করুন।
১০ জিলহজ ১৪৪৩ (৯ জুলাই ২০২২) হিজরি মসজিদে
নববিতে ঈদুল আজহায় প্রদত্ত খুতবার বাংলা
অনুবাদ- মুহাম্মদ ইশরাক বিন ফরিদ
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ