হজের সবচেয়ে বড় আমল আরাফায় অবস্থান। হাজিদের আরাফায় গমন ও অবস্থানের নিয়ম এভাবে:
১. সুন্নত হলো ৯ জিলহজ ভোরে ফজরের সালাত মিনায় আদায় করা। সূর্যোদয়ের পর ‘তালবিয়া’ পড়া অবস্থায় ধীরে সুস্থে আরাফার দিকে রওনা হওয়া। তাকবির পড়লেও কোনো অসুবিধা নেই। আনাস (রা.) বলেন, ‘তালবিয়া পাঠকারী তালবিয়া পাঠ করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাতে কোনো দোষ মনে করেননি। আবার তাকবির পাঠকারী তাকবির পাঠ করতেন। তাতেও তিনি দোষ মনে করেননি।’
২. সুন্নত হলো সূর্য হেলে পড়ার পরে মসজিদে নামিরায় জোহর-আসর একসঙ্গে হজের ইমামের পিছনে আদায় করে আরাফার ময়দানে প্রবেশ করা। রাসলুুল্লাহ (সা.) জোহরের সময়ের পূর্বে নামিরায় অবস্থান করেছেন। এতে তাঁর জন্য নির্মিত তাঁবুতে তিনি জোহর পর্যন্ত বিশ্রাম নিয়েছেন। নামিরা আরাফার বাইরে। তবে আরাফার সীমানায় অবস্থিত। অতঃপর সূর্য হেলে পড়লে তিনি জোহর ও আসরের সালাত জোহরের প্রথম ওয়াক্তে আদায় করে আরাফায় প্রবেশ করেন।’
বর্তমান সময়ে এ সুন্নতের ওপর আমল করা প্রায় অসম্ভব। তবে যদি কারো পথঘাট ভালো করে চেনা থাকে; একা একা আরাফায় সাথিদের কাছে ফিরে আসতে পারবে বলে নিশ্চিত থাকে, অথবা একা একাই মুজদালিফা গমন, রাত্রিযাপন ও সেখান থেকে মিনার তাঁবুতে ফিরে আসার মতো শক্তি-সাহস ও আত্মবিশ্বাস থাকে তবে তার পক্ষে নামিরার মসজিদে এ সুন্নত আদায় করা সম্ভব।
৩. সুন্নত হলো হজের ইমাম হাজিদের উদ্দেশে সময়োপযোগী খুতবা প্রদান করবেন। তিনি এতে তাওহিদ ও ইসলামের প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান সম্পর্কে আলোচনা করবেন। হাজিদেরকে হজের আহকাম সম্পর্কে সচেতন করবেন। তাদেরকে তাওবার কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন, কোরআন-সুন্নাহর ওপর অটল থাকার আহ্বান জানাবেন। যেমনটি করেছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) আরাফাতে তাঁর বিদায় হজের খুতবার সময়।
৪. সুন্নত হলো জোহর-আসর কসর করে একসঙ্গে জোহরের সময়ে আদায় করা এবং সুন্নত বা নফল কোনো সালাত আদায় না করা। এ নিয়ম সব হাজি সাহেবের জন্যই প্রযোজ্য। মক্কাবাসী বা আরাফার আশপাশে বসবাসকারী কিংবা দূরের হাজি সাহেবের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে জোহর-আসর কসর করে একসঙ্গে জোহরের সময়ে আদায় করেছিলেন। উপস্থিত সকল হাজি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে কসর করে সে দুই ওয়াক্তের সালাত একসঙ্গে আদায় করেছেন। তিনি কাউকে পূর্ণ সালাত আদায় করার আদেশ দেননি। অবশ্য কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কাবাসীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘হে মক্কাবাসী, তোমরা (সালাত) পূর্ণ করে নাও। কারণ আমরা মুসাফির।’ কিন্তু বিদায় হজের সময় তা বলেননি। তাই বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, এ সময়ের সালাতের কসর ও দুই সালাত জমা তথা একত্র করা সুন্নত। কসর ও জমা না করা অন্যায়। বিদায় হজ সম্পর্কে জাবের (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.) উপত্যকার মধ্যখানে এলেন। তিনি লোকজনের উদ্দেশে খুতবা দিলেন। অতঃপর (বিলাল) আজান ও ইকামত দিলেন এবং তিনি (সা.) জোহরের সালাতের ইমামত করলেন। পুনরায় (বিলাল) ইকামত দিলেন এবং তিনি (সা.) আসরের সালাত আদায় করলেন। এ দুয়ের মাঝখানে অন্য কোনো সালাত আদায় করলেন না।
৫. ইবনে উমর (রা.) হজের ইমামের পেছনে জামাত না পেলেও জোহর-আসর একসঙ্গে জমা করতেন, সহিহ বুখারিতে একটি বর্ণনা এসেছে, ‘ইবনে উমর (রা.) ইমামের সঙ্গে সালাত ছুটে গেলেও দুই সালাত একসঙ্গে পড়তেন।”
প্রসিদ্ধ হাদিস বর্ণনাকারী নাফে‘ (রহ.) বলেন, ‘ইবনে উমর (রা.) আরাফা দিবসে ইমামকে সালাতে না পেলে, নিজ অবস্থানের জায়গাতেই জোহর-আসর একত্রে আদায় করতেন।’
হানাফি মাজহাবের প্রসিদ্ধ দুই ইমাম, ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) ও ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)ও একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন:
‘ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) বলেন, (ইমাম) আবু হানিফা (রহ.) আমাদেরকে হাম্মাদ-ইবরাহিম সূত্রে অবহিত করেছেন। তিনি বলেন, আরাফার দিন যদি তুমি নিজের অবস্থানের জায়গায় সালাত আদায় করো তবে দুই সালাতের প্রত্যেকটি যার যার সময়ে আদায় করবে এবং সালাত থেকে ফারেগ হয়ে নিজের অবস্থানের জায়গা থেকে প্রস্থান করবে। (ইমাম) মুহাম্মাদ (রহ.) বলেন, (ইমাম) আবু হানিফা (রহ.) এ মত গ্রহণ করেন। তবে আমাদের কথা এই যে, (হাজি) তার উভয় সালাত নিজের অবস্থানের জায়গায় ঠিক একইরূপে আদায় করবে যেভাবে আদায় করে ইমামের পেছনে। উভয় সালাতকে এক আজান ও দুই ইকামাতের সঙ্গে একত্রে আদায় করবে। কেননা সালাতুল আসরকে উকুফের স্বার্থে এগিয়ে আনা হয়েছে। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আতা ইবন আবী রাবাহ ও মুজাহিদ (রহ.) থেকে এরূপই আমাদের কাছে পৌঁছেছে।”
তাই হজের ইমামের পেছনে জামাতের সঙ্গে সালাত আদায় সম্ভব হোক বা না হোক, সর্বাবস্থায় জোহর-আসর একত্রে পড়া সুন্নত।
৬. হাজিরা সালাত শেষে আরাফার ভেতরে প্রবেশ না করে থাকলে প্রবেশ করবেন। যারা মসজিদে নামিরাতে সালাত আদায় করবেন তারা এ বিষয়টি অবশ্যই লক্ষ রাখবেন। কেননা মসজিদে নামিরার কিবলার দিকের অংশটি আরাফার সীমারেখার বাইরে অবস্থিত। মনে রাখবেন, আরাফার বাইরে অবস্থান করলে হজ হবে না।
৭. অতঃপর দোয়া ও মুনাজাতে লিপ্ত হবেন। দাঁড়িয়ে-বসে-চলমান তথা সর্বাবস্থায় দোয়া ও জিকির করতে থাকবেন। সালাত আদায়ের পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত দুহাত তুলে অনুচ্চস্বরে বেশি করে দোয়া, জিকির ও ইস্তেগফারে লিপ্ত থাকবেন। উসামা ইবন জায়েদ (রা.) বলেন, ‘আমি আরাফায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পেছনে উটের পিঠে বসা ছিলাম। তখন তিনি তাঁর দুহাত তুলে দোয়া করছিলেন। অতঃপর তাঁর উষ্ট্রী তাঁকে নিয়ে ঝুঁকে পড়ল। এতে তাঁর উষ্ট্রীর লাগাম পড়ে গেল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর এক হাত দিয়ে লাগামটি তুলে নিলেন এবং তাঁর অন্য হাত উঠানো অবস্থায়ই ছিল।’
রাসুলূল্লাহ (সা.) আরো বলেন, ‘উত্তম দোয়া হচ্ছে আরাফার দিনের দোয়া; আর উত্তম সেই বাক্য যা আমি ও আমার পূর্ববতী নবীগণ বলেছি, তা হচ্ছে, (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর।) ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো শরিক নেই, রাজত্ব ও সমস্ত প্রশংসা তাঁর জন্য। তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’
কোরআন তেলাওয়াত, ওয়াজ নসিহতের বৈঠকে শরিক হওয়া ইত্যাদিও আরাফায় অবস্থানের আমলের মধ্যে শামিল হবে। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে কেবল বসে বসে নিম্নস্বরে দোয়া-জিকির ও কোরআন তিলাওয়াতের নির্দেশ রয়েছে। দিনের শেষ সময়টিকে বিশেষভাবে কাজে লাগাবেন। পুরোপুরিভাবে দোয়ায় মগ্ন থাকবেন।
৮. আরাফার পুরো জায়গাটাই হাজিদের অবস্থানের জায়গা। মনে রাখবেন, উরনা উপত্যকা আরাফার উকুফের স্থানের বাইরে। নবী (সা.) বলেছেন, ‘আরাফার সব স্থানই অবস্থানস্থল। তবে বাতনে উরনা থেকে তোমরা উঠে যাও।’
বর্তমান মসজিদে নামিরার একাংশ ও এর পার্শ্বস্থ নিম্ন এলাকাই বাতনে উরনা বা উরনা উপত্যকা। সুতরাং কেউ যেন সেখানে উকূফ না করে। মসজিদে নামিরায় সালাত আদায়ের পর মসজিদের যে অংশ আরাফার ভেতরে অবস্থিত সে দিকে গিয়ে অবস্থান করুন। বর্তমানে মসজিদের ভেতরেই নীল বাতি দিয়ে আরাফা নির্দেশক চিহ্ন দেয়া আছে। অতএব, এ সম্পর্কে সচেতন থাকুন।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ