কোরবানি মুসলিম জাতির জন্য আল্লাহর প্রিয় হওয়ার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। আল্লাহর খুশি অর্জন করার সেরা ইবাদত। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে অনন্ত ত্যাগ— যা প্রকাশ পেয়েছিল মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে। এর দ্বারা যেমন আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়, তেমনিভাবে নিজের মধ্যে আত্মত্যাগের এক বৈপ্লবিক চেতনার উন্মেষ ঘটানো যায়। কোরবানি অর্থই নৈকট্য লাভ করা, কষ্ট স্বীকার করা। অর্থাৎ যে বস্তুর দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় তাই কোরবানি।
জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ঈদের নামাজের পর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ম মাফিক নির্দিষ্ট পশুসমূহ (উট, গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষের মধ্য হতে যে কোনো একটি) আল্লাহর নামে জবাই করাই কোরবানি।
যুগে যুগে কোরবানি: কোরবানির ইতিহাস মানব সৃষ্টির মতোই অতি প্রাচীন। সকল জাতির জন্যে কোরবানি নির্ধারিত ছিল। আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্য (কোরবানির) নিয়ম করে দিয়েছি। তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু থেকে যে রিজিক দেয়া হয়েছে সেগুলোর ওপর তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ: ৩৪)
পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম (আ.)-এর দুই পুত্রের মাধ্যমে পৃথিবীতে কোরবানির ধারা চালু হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আদমের দুই পুত্রের খবর তাদের সঠিকভাবে জানিয়ে দাও। উভয়ে যখন একটি করে কোরবানি হাজির করেছিল তখন তাদের একজনের কাছ থেকে কবুল করা হলো...।’ (সুরা মায়েদা: ২৭)
ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নতের অনুসরণ: আমাদের কোরবানি ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত। তাঁর প্রতিও কোরবানির নির্দেশ ছিল। আল্লাহ বলেন, ‘অতপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন ইবরাহিম (আ.) বলল, ‘বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি, এখন বলো, তোমার অভিমত কী? সে বলল, ‘হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন।’ (সুরা সফফাত: ১০২)
১০ জিলহজ পিতা-পুত্র চললেন আল্লাহর হুকুম পালনে। হুকুম পালনে ছুরি চালানোর পর দেখলেন, ইসমাইলের তদস্থলে দুম্বা জবাই হয়েছে। দূরে দাঁড়িয়ে আছেন ইসমাইল। আল্লাহর কাছে পিতা-পুত্রের ত্যাগ পছন্দ হয়। আল্লাহ এই কোরবানিকে কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্বাসী মানুষের জন্য স্থায়ী করেন। এরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমার এ সুমহান আদর্শকে পরবর্তীদের জন্যে চির স্মরণীয় করে দিলাম।’ (সুরা সফফাত: ১০৮)
আল্লাহর জন্য কোরবানি: আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে কোরবানির নির্দেশ দেয়া হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি আপনার প্রভুর শানে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাওসার: ০২)
কোরবানি যে কেবল আল্লাহর জন্য, এ শিক্ষা নবীজিকে দিতে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সেই কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন এবং আমার মরণ সবকিছুই আল্লাহর জন্য।’ (সুরা আনয়াম: ১৬২)
কোরবানিকৃত পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে আছে সওয়াব। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, কোরবানি কী? রাসুল (সা.) বলেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিমের (আ.) সুন্নত। তারা বললেন, এতে আমাদের লাভ কী? তিনি বললেন, প্রত্যেক পশমের পরিবর্তে একটি করে সওয়াব দেয়া হবে। তারা আবার বললেন, অধিক পশমওয়ালা জীবের ক্ষেত্রে কী হবে? তিনি বললেন, সেক্ষেত্রেও প্রতিটি পশমের পরিবর্তে একটি করে সওয়াব দেয়া হবে।’ (ইবনে মাজাহ: ৩১২৭)
পশুই কোরবানি করতে হবে: ঈদুল আজহার দিন পশুর রক্তপাত ঘটানো হলো শ্রেষ্ঠ ইবাদত। নবীজি (সা.) বলেন, ‘ঈদুল আজহার দিন পশুর রক্তপাত ঘটানো ছাড়া কোনো ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দনীয় কাজ করতে পারে না। কিয়ামাতের দিন ওই পশু তার শিং, পশম ও খুর নিয়ে হাজির হবে। আর কোরবানিকৃত পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা কোরবানি করে নিজেদের মনকে তৃপ্ত করো।’ (তিরমিজি)
কোরবানিকৃত পশুর গোস্ত, রক্ত কোনোটিই আল্লাহর দরবারে পৌঁছে না, শুধু পৌঁছে তাকওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর কাছে ওগুলোর না গোশত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ: ৩৭)
রাসুল (সা.) প্রতি বছর কোরবানি করেছেন। এমনকি সফরে থাকাবস্থায়ও। হাদিসে আছে, ইবনে উমর বলেন, ‘নবী মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেন এবং প্রতি বছর কোরবানি করেন।’ (তিরমিজি)
সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য প্রতিবছর কোরবানি করা আবশ্যক। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে আর্থিক ক্ষমতা থাকার পরও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।’ (ইবনে মাজাহ: ৩১২৩)
আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ: কোরবানি কেবল আল্লাহর নামে করতে হবে। আল্লাহকে উৎসর্গ করে কোরবানির পশু জবাই করতে হবে। আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে অংশীদার করা যাবে না। আল্লাহ ছাড়া ভিন্ন কারো নামে পশু কোরবানি করা হারাম। আল্লাহর নামে কোরবানি করা তাঁর প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ