ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

নবীজি যেভাবে অর্থনীতি কর্মসূচি প্রণয়ন করতেন

প্রকাশনার সময়: ১১ জুন ২০২২, ১০:১১ | আপডেট: ১১ জুন ২০২২, ১০:২৩

রাসুল (সা.) যখন মদিনায় আগমন করেন, মদিনার মানুষেরা তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও শ্রেণি-বৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট। বিত্তশালীরা বিত্তহীনদের গোলাম বানিয়ে নিপীড়ন করছে। সুদের কবলে জড়িয়ে পড়া মানুষ ভিটে-মাটি ছাড়া হচ্ছে। নারী হচ্ছে সম্পদ থেকে বঞ্চিত। এতিম অধিকার থেকে বিতাড়িত। সর্বনাশা জুয়ার খপ্পরে পড়ে মানুষ হচ্ছে সহায় সম্বলহীন। ব্যবসায়িক অসাধুতার কারণে জনসাধারণ হচ্ছে জিম্মি। হারাম উপার্জনের তোড়জোড়ের কাছে মেহনতি শ্রমজীবী মানুষ হচ্ছে অবহেলিত। মহানবী (সা.) মদিনায় প্রবেশ করে মানুষের মধ্যে মুক্তির আলো জ্বালিয়ে দেন। সমাজ থেকে কুফুরি সংস্কৃতি দূর করে উপহার দেন নতুন বিভাময় সভ্য সংস্কৃতি। মানুষের প্রয়োজন উপলব্ধি করে অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব দেন।

মানুষের বেঁচে থাকা এবং একটা সমাজ-রাষ্ট্রকে পৃথিবীর পাড়া-মহল্লায় বুক উঁচু করে দাঁড়াতে হলে অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত হতে হয়। কারণ, একটা রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ও সমৃদ্ধির বুনিয়াদ নির্ভর করে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীর ওপর। বিশ্ববাসীর কল্যাণ চিন্তা করে মানবতার নবী মুহাম্মদ (সা.) অর্থনীতিতে এক দিগন্তকারী নতুন কর্মসূচির সূচনা করেন। সে কর্মসূচির আলোকে মদিনা শহর অর্থনীতিতে উন্নতি করেছে। তখনকার সময়ে নবীজির কর্মসূচির আদলে মদিনা সভ্যতায়-সৃজনে নির্মাণে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল পৃথিবীর বুকে। তাঁর কর্মনীতি অনুসরণ করে সুদূর স্পেন থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত-বিশাল মুসলিম বিশ্বে শোষণমুক্ত ও কল্যাণধর্মী নতুন এক অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল।

রাসুল (সা.)-এর কর্মসূচি ছিল কোরআনের দেখানো পথে। তার দেয়া কর্মসূচি অনুযায়ী দেশ, সমাজ ও ব্যক্তিজীবন গঠন করতে পারলে মানুষের অর্থনীতির চাকা সচল সবল ও কল্যাণকর হবে। কোরআনের আলোকে রাসুল (সা.)-এর দেয়া কর্মসূচি হলো—

এক. হালাল পন্থায় উপার্জন ও হারাম পথ বর্জন: ইসলামি বিধানে ব্যবহারিক জীবনে কিছু কাজ হালাল এবং কিছু কাজ হারাম করা হয়েছে। উৎপাদন, ভোগ, বণ্টনের ক্ষেত্রেও এই বিধান প্রযোজ্য। ইসলাম মানুষকে উপার্জনের প্রতি উৎসাহিত করেছে। উপার্জন-অর্জনে দিয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা। ব্যক্তি পছন্দ মতো উৎপাদন, উপার্জন, ভোগ, বণ্টন করবে। রিজিক অন্বেষণ করবে। কিন্তু হারামপন্থায় তিল পরিমাণ উপার্জন করা যাবে না।

ইসলাম কখনো হারাম পন্থাকে সমর্থন করে না। পৃথিবীর অন্য সব অর্থনৈতিক মতবাদে হালাল-হারামের পার্থক্য নেই। মানুষের বিপন্ন জীবনের প্রতি ভ্রুক্ষেপ নেই। অর্থনীতিতে স্বাবলম্বী হওয়া তাদের প্রধান লক্ষ ও স্বপ্ন। তবে ইসলামে সবকিছুর মতো এখানেও রয়েছে নীতি, আদর্শ ও বিধি-বিধান। হালাল পন্থায় উপার্জনকে ইবাদত ও হারাম পন্থাকে নিষিদ্ধ এবং গুনাহের কাজ বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ কর। যা হালাল তাই গ্রহণ কর এবং যা হারাম তা বর্জন কর।’ (ইবনে মাজাহ: ২১৪৪)

দুই. সুদ উচ্ছেদ: শুদ্ধ পবিত্র ও সৃজনশীল সমাজ গঠনের বড় অন্তরায় হলো সুদ। রাসুল (সা.) যখন দেখলেন, সমাজে সুদের মহামারি এবং গণমানুষ সুদের কবলে পড়ে সর্বহারা হচ্ছে। তিনি তখন সমাজে সুদ মুক্তির স্লোগান তুলেন। সমাজ থেকে দুর্নীতির অবসান ও জুলুমতন্ত্রকে নিঃশেষ করার প্রয়োজনে তিনি সুদ প্রথাকে উচ্ছেদ করেন। সুদভিক্তিক সব কারবার-লেনদেন হারাম ঘোষণা করেন। পবিত্র কোরআনে ঘোষণা হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যবসা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা: ২৭৫)

অর্থনীতির সবচেয়ে অসৎ ও জঘন্য কাজ হলো সুদ। এটি সমাজ শোষণের শক্তিশালী হাতিয়ার। সুদের অভিশপ্ত কবলে পড়ে একমাত্র সম্বল বস্তুভিটা হারায় মানুষ। দরিদ্র হয় আরো হতদরিদ্র। দ্রব্যমূল্য ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর নবীজি মানুষকে সুদ প্রথার বিলুপ্ত ঘটিয়ে নতুন সহায়ক অর্থনীতির ছায়ায় আশ্রয় দিয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা সুদ খায়, সুদ দেয়, সুদের হিসাব লেখে ও সুদের সাক্ষ্য দেয় তারা সবাই সমান পাপী।’ (তিরমিজি: ১২০৬)

তিন. ব্যবসায়িক অসাধুতা দমন: ইসলামি অর্থনীতিতে সর্বপ্রকার ব্যবসায়িক অসাধুতা নিন্দনীয় ও কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ব্যবসায়িক অসাধুতার ফলে মানুষ, সমাজ, গোত্র ও মহল্লায় লেগে থাকে অশান্তি। খেটে খাওয়া মানুষ ও দিনমজুরদের কষ্টের সীমা থাকে না। বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ব্যবসায়িক অসাধুতা কোনো অশোভন ও মন্দ মনে করা হয় না। এতেই যেন তাদের অর্থব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে। ব্যবসায়িক অসাধুতা শুধু কালোবাজারি চোরাকারবারি নয়; মজুদদারি, ওজনে কম দেয়া, ভেজাল ও নকল প্রভৃতিও জঘন্য অপরাধ।

মহানবী (সা.) তখন মানুষের কাজ-কর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অসাধু কার্যক্রম নিষেধ করেন। অর্থব্যবস্থা থেকে কঠোর হাতে অসাধুতা দমন করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা মাপে ঠিক দাও এবং কারো ক্ষতি করো না, সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ঠিক মতো ওজন কর। লোকদের পরিমাপে কম বা নিকৃষ্ট কিংবা দোষযুক্ত জিনিস দিও না এবং দুনিয়াতে অশান্তি সৃষ্টি করো না।’ (সুরা শুয়ারা: ৮১-৮৩)

মজুদদারী প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেবল পাপী ব্যক্তিই মজুদদারি করে।’ (মুসলিম: ১৬০৫)

চার. জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন: জাকাত ইসলামের ভিত্তি। কোরআনে নামাজ কায়েমের পর জাকাত আদায়ের আদেশ করা হয়েছে। রাসুল (সা.)-এর আদেশে সম্পদশালী সাহাবি কেরাম (রা.) জাকাত আদায়ে প্রতিযোগিতা করতেন। জাকাতের মাধ্যমে সমাজে সাম্য-সৌহার্দ্য তৈরি হয়। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ কমে আসে। গরিবের মুখে হাসি ফোটে। এতিমের উদরে আহার প্রবেশ করে। জাকাত আদায়ে সমাজের কাঠামো, মানুষের জীবন যাপন সুখকর হয়। মানুষের অর্থনীতিতে গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং জাকাত দাও।’ (সুরা হজ: ৭৮)

পাঁচ. বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা: বিভিন্ন উৎস থেকে অর্জিত এবং রাষ্ট্রের কোষাগারে জমাকৃত ধন-সম্পদকেই বায়তুল মাল বলে। ইসলামি রাষ্ট্রের সব ব্যক্তির এতে সম্মিলিত মালিকানা রয়েছে। রাসুল (সা.) মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা করেন। বায়তুল মালে সঞ্চিত ধন সম্পদের ওপর সব সাধারণ অধিকার স্বীকৃত করেন। রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক যেন মৌলিক মানবিক প্রয়োজনীয় চাহিদা থেকে বঞ্চিত না হয়, সেজন্য তিনি বায়তুল মাল গড়েন। গরিব-এতিম ও দুস্থ-অসহায় মানুষের জন্য তাদের জীবন বাঁচাবার জন্য এ উদ্যোগ। পৃথিবীর অবহেলিত বঞ্চিত মানুষের জন্য মহানবী (সা.)-এর এ অভূতপূর্ব কর্মসূচি। ইসলামের আগে মানবতার কল্যাণে এমন ব্যবস্থা কেউ প্রণয়ন করেনি।

ছয়. মানবিক শ্রমনীতির প্রবর্তন: বিশ্বের ইতিহাসে মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (সা.) প্রথম শ্রমনীতির প্রবর্তন করেন। সঠিক সময়ে তাদের বেতন-ভাতা দিতে উৎসাহিত করেন। ইসলামের নবী (সা.) বলেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ কর।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)

সাত. উত্তরাধিকার ব্যবস্থার যৌক্তিক রূপদান: রাসুল (সা.) আবির্ভাবের আগে পৃথিবীতে ভূমির উত্তরাধিকারের আইন ছিল অস্বাভাবিক। পুরুষানুক্রমে পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তানই সব সম্পদ পেত, অন্যরা হতো বঞ্চিত। অথবা পরিবারের সব ছেলেরা সম্পদের অধিকারী হতো; কিন্তু নারীরা পেত না সম্পদের কিছুই। বরাবর ছিল তারা অবহেলিত বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত। এ নীতিতেই চলছিল বিশ্বের উত্তরাধিকার ব্যবস্থা। অতপর রাসুল (সা.) সমাজের দুরাবস্থা ও মানবতাবিবর্জিত আইন ধূলিসাৎ করে মানবাধিকারের স্লোগান তুলেন। সাম্য ও সংহতির ডাক দেন। বঞ্চিত মানুষ ও নারীর অধিকার নিশ্চিত প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লাহ বলেন, ‘পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদের অংশ আছে; অল্প হোক কিংবা বেশি। এ অংশ নির্ধারিত।’ (সুরা নিসা: ০৭)

আট. রাষ্ট্রের ন্যায়সঙ্গত হস্তক্ষেপের বিধান: সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা ইসলামের বড় লক্ষ। সমাজের জুলুম, অত্যাচার, দুর্নীতি, অর্থনীতিতে শোষণ, শাসন, সুদ, ঘুষ, মুনাফাখোরি, মজুদদারি বন্ধ করতে রাসুল (সা.) ন্যায়সঙ্গত হস্তক্ষেপের বিধান আরোপ করেন। এতে রাষ্ট্র ও তার অর্থনীতির বাঁক পরিবর্তন হয়। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে। তিনি সমাজের মানুষের জন্য কায়েম করেন সামাজিক নীতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জনকল্যাণে রাখেন জোরালো ভূমিকা।

নয়া শতাব্দী/এডি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ