ইলমুল ফিকহের উৎপত্তি, প্রচার ও প্রসারে যারা মুসলিম ইতিহাসে চিরস্মরণীয় ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর নামটি তাদের শীর্ষে। তিনি ছিলেন ফিকহ জগতের প্রদীপ্ত সূর্য ও ইমামুল আইম্মাহ। যুগের ক্লান্তিলগ্নে যার জন্ম ও জীবনকর্ম ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতের জন্য বিশেষ রহমতস্বরূপ। তার কঠোর সাধনা ও বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য ফিকহশাস্ত্রের ইতিহাসে নন্দিত, আলোচিত ও সমাদৃত হয়ে আছেন।
একজন আবু হানিফা
তার নাম নোমান। উপনাম আবু হানিফা, উপাধি ইমাম আজম। পিতার নাম সাবেত, দাদার নাম জুতা আলকুফি। তিনি বিশিষ্ট সাহাবি সালমান ফারসি (রা.)-এর বংশধর ছিলেন।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) হিজরি ৮০ সন মোতাবেক ৬৯৯ মতান্তরে ৭০০ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকের বিখ্যাত কুফা নগরে জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, তার পিতা সাবেত ছোটবেলায় আলী (রা.) এর খেদমতে আগমন করেন। অতপর আলী (রা.) তার ও তার বংশধরের জন্য দোয়া করেন। যার ফসল হলো ইমাম আবু হানিফা (রহ.)।
তার শৈশবকাল
শৈশবেই ইমাম আবু হানিফা (রহ)-এর পিতা ইন্তেকাল করেন। সন্তান লালনপালন ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তার মাতা ইমাম জাফর আসসাদেকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ফলে সেখানে তার শৈশবকাল অতিবাহিত হয়।
পিতার কাপড়ের ব্যবসার মধ্য দিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। নগরে-বন্দরে বিভিন্ন স্থানে তিনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। সেকালে তার সমপর্যায়ের ধনী খুব কমই ছিল। নিজস্ব ও অর্থানুকূল্যের দরুণ তিনি সে সময়ে সামাজিক ও কল্যাণমূলক এবং বিভিন্ন সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর জ্ঞানার্জন
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বাল্যকালে ও কৈশোরে যথেষ্ট জ্ঞানচর্চা করেন। যৌবনে তিনি বিদ্যাশিক্ষার চেয়ে ব্যবসার প্রতি অধিক অনুরাগী ছিলেন। তিনি কাপড়ের ব্যবসা করতেন। একদিন ইমাম সাবি (রহ.) বললেন, তোমার মধ্যে প্রতিভা আছে, তুমি ওলামায়ে কেরামদের সঙ্গে উঠাবসা কর। এ উপদেশের পর তিনি বিদ্যানুরাগী হন এবং কঠোর সাধনার মাধ্যমে জ্ঞানসিন্ধুর অমূল্য রত্ন অর্জন করেন।
জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় দক্ষতা
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ফিকহশাস্ত্রে অদ্বিতীয় পণ্ডিত ছিলেন। ফিকহশাস্ত্র ছাড়াও ইলমুল হাদিস, ইলমুল কালাম, ইলমুল বালাগাত, ইলমুল ফাসাহাত, ইলমুল তাসাউফ, ইলমুন নাহু, ইলমুস সরফ, ইলমুত তাফসির প্রভৃতি বিষয়ে তিনি গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।
শিষ্যবৃন্দ
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) হতে যারা ইলমুল ফিকহ ও হাদিসের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তাদের সংখ্যা অনেক। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন: ক. আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহ.)। খ. ওয়াকি ইবনুল জাররাহ (রহ.)। গ. ইয়াজিদ ইবনে হারুন (রহ.)। ঘ. কাজি আবু ইউসুফ (রহ.)। ঙ. মুহাম্মদ ইবনে হাসান আল শায়বানি (রহ.) প্রমুখ।
সাহাবিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ১২/১৩ বছর বয়সে প্রথম আনাস (রা.) এর খেদমতে হাজির হন এবং তার থেকে ইলমে দীনের শিক্ষা লাভ করেন। আনাস (রা.) তার ধীশক্তি ও মেধার পরিচয়ে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে তার জন্য দোয়া করেন। কারো কারো মতে, ইমাম মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মোট তিনজন সাহাবি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে ইবনে খাল্লিখান বলেছেন যে, তিনি চারজন সাহাবির যুগ পেয়েছেন; কিন্তু সাক্ষাত পাননি। এ চারজন সাহাবি হলেন: ক. বসরার শাসনকর্তা আনাস (রা.)। খ. কুফার শাসনকর্তা আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আলফা (রা.)। গ. মদিনার শাসনকর্তা সাহল ইবনে সাদ (রা.)। ঘ. মক্কার শাসনকর্তা আবু তোফায়েল (রা.)।
পেশা হিসেবে শিক্ষকতা
১২০ হিজরিতে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) যখন ৪০ বছর বয়সে উপনীত হন, তখন তার উস্তাদ হাম্মাদ (রহ.) ইন্তেকাল করলে তিনি তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি তখন বুঝতে পারেন যে, উস্তাদের অপূর্ণ কাজ তাকে সমাপ্ত করতে হবে। আর তাই শিক্ষাদানকে কর্মজীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। জীবনের আসল ঠিকানা তিনি এ পেশার মাধ্যমেই পেয়ে যান।
ফিকহশাস্ত্রের প্রথম ও প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা
হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর সূচনালগ্নে মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রসারের ফলে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইসলামি শরিয়তের বিধি-বিধানে অনেক বাদ-বিসংবাদ পরিদৃষ্ট হয়। ইসলামি মতাদর্শে অনেক ভ্রান্ত মতের অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে। এমনি এক ক্রান্তিলগ্নে সত্যের মশালস্বরুপ ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সর্বপ্রথম ফিকহশাস্ত্র রচনা ও সংকলনে হস্ত প্রসারিত করে সমস্যার সমাধান পূর্বক ইসলামি বিধি-বিধান ও তাহজিব তমদ্দুনকে অম্লান ও অক্ষত রাখেন।
আবু হানিফা (রহ.) কর্তৃক ফিকহ সংকলন
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) মাসআলার সমাধানকল্পে তার ৪০ জন প্রধান শিষ্য নিয়ে মজলিসু তাদবিনুল ফিকহি তথা ফিকহ সম্পাদনা বোর্ড গঠন করেন। সুদীর্ঘ ২২ বছরের অক্লান্ত সাধনাবলে ৮৩ হাজার মাসআলা সংবলিত কুতুবু হানাফিয়া নামে একটি বিশাল পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করেন।
বিচারকের পদ প্রত্যাখ্যান ও কারাবরণ
উমাইয়া খলিফা আল মনসুর তাকে কুফার প্রধান বিচারপতির পদ অলংকৃত করার জন্য আমন্ত্রণ জানালে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন। এতে খলিফা আল মনসুর তাকে কারাগারে বন্দি করে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনে জর্জরিত করেন।
হানাফি মাজহাবের প্রতিষ্ঠা
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) প্রথম ইলমুল ফিকহ সংকলনের মাধ্যমে এবং তা সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত ও শক্তিশালী দলিলের ভিত্তিতে স্থাপন করায় দলে দলে লোকজন তার অনুসরণ ও অনুকরণ করতে থাকে। তার মাজহাবের নাম হয় হানাফি মাজহাব। উল্লেখ্য, এ মাজহাব শক্তিশালী ও যুক্তিযুক্ত বলেই বিশ্বের তিন চতুর্থাংশ মুসলিম মাজহাবের অনুসারী।
মুসলিম জাতির শ্রেষ্ঠ আইনজ্ঞ
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তীক্ষ মেধা, অনন্য প্রতিভা, অসাধারণ ধীশক্তি, সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত, দ্বীনের গভীর জ্ঞান, অতুলনীয় বাগ্মিতা ও বিরল গুণাবলির জন্য বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আইনজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। ইমাম জুহরি (রহ.) এর ছাত্র ইয়াসিন জিয়াত কুফী (রহ.) মক্কায় চিৎকার করে ঘোষণা করেন, হে লোকগণ! আবু হানিফা (রহ.)-এর দরবারে গিয়ে বস, তার মর্যাদা দাও, এমন লোক আর মিলবে না। তার কাছ থেকে জ্ঞানাহরণ কর। হালাল ও হারাম সম্পর্কিত জ্ঞানের এমন আলেম আর পাবে না। যদি তাঁকে হারাও, তবে এক বিরাট জ্ঞানভাণ্ডার হারাবে।
ইমাম আবু হানিফা (রহ)-এর ইন্তেকাল
এ মহামানব সত্যের জয়গান গেয়ে অবশেষে লৌহ শলাকার চার দেয়ালে নির্জন সেলে নির্মম কারাবরণকারী সৈনিক হিসেবে জীবনের শেষ সময় অতিবাহিত করেন। ১৫০ হিজরি মোতাবেক ৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা আল মনসুর কর্তৃক বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে এ মহান ব্যক্তির জীবনাবসান ঘটে। বাগদাদের খাইজরান নামক স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) মুসলিম জাতির জন্য মহান আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত। মুসলিম সর্বসাধারণের সামনে ইসলামি শরিয়তকে তিনি সাবলীলভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা শররি বিধানবলিকে সহজে অনুধাবন এবং বাস্তব জীবনে অনুসরণ করার সুযোগ পাচ্ছি।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ