এক যুবক ইসলাম শেখার জন্য দামেস্ক যান। তিনি সদ্য মুসলমান হয়েছেন। তার নাম আবু ইদরিস আল-খাওলানি। পরবর্তীতে তিনি উমাইয়া খেলাফতের প্রধান বিচারপতি হন।
যুবক অবস্থায় তিনি যখন দামেস্কের গ্র্যান্ড মসজিদে যান, তিনি দেখতে পান একটি মজলিশে অনেকেই বসে আছেন, একজন শায়খ সেখানে পড়াচ্ছেন। শায়খ অল্প বয়সী। শায়খকে তার ভালো লাগে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘উনি কে?’ তাকে বলা হলো, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবি মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)। আবু ইদরিস আল-খাওলানি (রহ.) মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-এর সঙ্গে দেখা করার জন্য পরদিন আগে আগে মসজিদে যান। গিয়ে দেখতে পান মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) নামাজ পড়ছেন। নামাজ শেষে তাকে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহর জন্য আপনাকে ভালোবাসি।’
মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহর কসম?’ অর্থাৎ, এতোটা নিশ্চিত হয়ে বলছ যে, তুমি আমাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাস?
‘জি, আল্লাহর কসম।’
‘আল্লাহর কসম?’
‘জি, আল্লাহর কসম।’
অতঃপর মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) তার চাদরের আচল ধরে টেনে বললেন, ‘তাহলে সুসংবাদ গ্রহণ করুন।’ এই বলে মুয়াজ ইবনে জাবাল (রহ.) আবু ইদরিস আল-খাওলানি (রহ.)-কে নবীজির (সা.) একটি হাদিস শুনান। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তাদেরকে ভালোবাসা আমার জন্য অপরিহার্য হয়ে যায়, যারা আমার জন্য একে অপরকে ভালোবাসে, যারা আমার জন্য একসঙ্গে বসে, যারা আমার জন্য পরস্পর সাক্ষাৎ করে, যারা আমার জন্য একে অন্যের জন্য ব্যয় করে।’ (মুসনাদে আহমাদ: ২১৫২৫)
মুমিনের আখলাক নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্য কী? কেন একজন মুমিন আরেকজনের সঙ্গে ভালো আচরণ করবে? এটার মূল কারণ হতে হবে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। একজন মুমিন আরেকজনকে ভালোবাসলে তবেই তার সঙ্গে উত্তম আচরণ করতে পারবে। আরেকজনের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে কীভাবে তার প্রতি দানশীল আচরণ করতে পারে? তাকে উত্তম পরামর্শ দিতে পারে? দোষ গোপন রাখতে পারে? ক্ষমা করে দিতে পারে?
তার মানে বুঝা গেল, সব উত্তম আখলাকের মূল হলো ভালোবাসা। অন্যের প্রতি ভালোবাসার কারণে মানুষ অন্যের সঙ্গে উত্তম আচরণ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঈমানদার ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না একে অন্যকে ভালোবাসবে।’ (মুসলিম: ৯৮)
অন্য মুমিনকে ভালোবাসা নফল কোনো ইবাদত নয়, এটা ঈমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আপনি অন্য মুমিনকে যদি না ভালোবাসেন, প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবেন না। প্রকৃত ঈমানদার না হলে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন না। জান্নাতে যাবার আকাঙ্ক্ষা করলে আপনাকে অবশ্যই মুমিনদের ভালোবাসতে হবে।
এটা তখন আর ‘আখলাক’ থাকে না, এটা হয়ে যায় ‘আকিদা’।
রাসুলুল্লাহ (সা.) একজন সাহাবির কথা বললেন, যিনি জান্নাতে প্রবেশ করবেন। অন্য একজন সাহাবি জানতে চাইলেন তার আমল কী। তিনি তার সঙ্গে দেখা করলেন তার আমল সম্পর্কে জানতে। গিয়ে দেখতে পেলেন তিনি অতিরিক্ত নামাজ পড়েন না, ইবাদত করেন না। তাহলে কিসের জন্য তিনি জান্নাত লাভ করবেন? তিনি জানালেন যে, তিনি অন্য মুসলিমের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন না। এই কারণে তিনি জান্নাত লাভ করবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১২২৮৬)
পূর্ববর্তী যুগের এক লোক একবার তার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য আরেক গ্রামে যায়। আল্লাহ মানুষ রূপে ফেরেশতা প্রেরণ করেন। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ ‘আমি অমুক গ্রামে আমার এক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।’
‘তার কাছে কি তোমার কোনো আবদার আছে? তুমি কোনো কিছু পাবার জন্য তার কাছে যাচ্ছ?’
‘না, আমি তো শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য তাকে ভালোবাসি।’
ফেরেশতা তাকে জানালেন: ‘আমি আল্লাহর ফেরেশতা, তোমাকে অবহিত করার জন্য এসেছি যে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসেন, যেমন তুমি তোমার ভাইকে তার সন্তুষ্টির জন্য ভালোবেসেছ।’ (মুসলিম :৬৪৪৩)
লোকটি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার ভাইকে পছন্দ করত, ফলে আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেন, তাকে তার প্রিয় বান্দার অন্তর্ভুক্ত করেন। আল্লাহর জন্য ভালোবাসলে এরচেয়েও বেশি মর্যাদা রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ বলেন: ‘আমার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য যারা পরস্পরকে ভালোবাসে, তাদের জন্য রয়েছে আলোর মিম্বার। নবী ও শহিদগণ পর্যন্ত তাদের মর্যাদা দেখে ঈর্ষান্বিত হবে।’ (তিরমিজি: ২৩৯০)
এই একটি আমলের ফলে নবী-শহিদগণ মুমিনদের ওপর ঈর্ষান্বিত হবে। আর তা হলো- আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসা। আপনার ঈমানের পূর্ণতা পাবে, আপনি যদি কাউকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসেন। আপনি ঈমানের মিষ্টতা অনুভব করতে পারবেন, আপনি যদি কাউকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসেন, তাহলে অটোম্যাটিক জান্নাতে তার সঙ্গে থাকতে পারবেন। আপনার জান্নাতে থাকার মর্যাদা হয়তো নিচু স্তরে হতে পারে, কিন্তু কাউকে ভালোবাসার কারণে, তার প্রতি দয়া-মমতার জন্য আল্লাহ আপনাকে তার সঙ্গে রাখবেন।
একবার এক বেদুঈন রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কিয়ামত কখন হবে?’
তিনি পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিয়ামতের জন্য তুমি কী প্রস্তুত করেছ?’
সে বলল, ‘আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসি।’
এটা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘যাকে তুমি ভালোবাস, তাঁর সঙ্গেই তোমার কিয়ামত হবে (অর্থাৎ তোমার সঙ্গী)।’
এই হাদিসটি আনাস ইবনে মালিক (রা.) শুনেন টিন-এইজে। পরবর্তীতে হাদিসটি বর্ণনার সময় তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এই হাদিসের চেয়ে প্রিয় আর কোনো হাদিস নেই। আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে, আবু বকর, উমর (রা.)-কে ভালোবাসি। আমি আশা করি, তাদের ভালোবাসি বলে আমি তাদের সঙ্গ জান্নাতে বসবাস করতে পারব; যদিও তাদের আমলের মতো আমি আমল করতে পারিনি।’ (বুখারি: ৩৬৮৮)
আপনি যদি আবু বকর (সা.)-কে ভালোবাসেন, তাহলে তার মতো ইবাদাত না করেও জান্নাতে তার সঙ্গী হতে পারেন। এটা হলো অন্যকে ভালোবাসার সবচেয়ে বড় ফজিলত। আপনি একজন আলেমকে ভালোবাসেন? তার মতো আমল না করেও জান্নাতে তার সঙ্গী হতে পারেন; শুধুমাত্র তার প্রতি ভালোবাসার কারণে। আমরা অনেক সময় শুধুমাত্র ইবাদাত (নামাজ, রোজা, জিকির) নিয়ে কথা বলি, কিন্তু আখলাক নিয়ে কথা বলি না। ইসলাম যেমন ইবাদতের নাম, তেমনি আখলাকেরও নাম। আমল ও আখলাকের সমন্বয়ে ইসলাম।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ