১৯৯০ সালে আলবেনিয়ায় ক্রমাগত বিক্ষোভের পর পতন ঘটেছিল পৃথিবীর শেষ স্ট্যালিনবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার— দেশটির কমিউনিস্ট সরকার স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি দিয়েছিল। লেইয়া উপি ছিলেন সে সময় ১১ বছরের স্কুলপড়ুয়া মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই তাকে স্কুলে কমিউনিজমের যে শিক্ষা দেয়া হয়েছিল— তাতে তার ছিল পূর্ণ বিশ্বাস। তিনি ছিলেন স্ট্যালিনেরও একজন ভক্ত। কিন্তু কমিউনিস্ট শাসনের অবসানের পর তিনি জানতে পারেন তার পরিবারের অতীতের গোপন কাহিনি— যা ১৯৯০ সালের আগে লেইয়াকে কখনো বলা হয়নি। লেইয়া উপি তার আলবেনিয়ায় কাটানো শৈশবের কথা বলেছেন বিবিসির রব ওয়াকারকে— যা নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্ব।
আলবেনিয়ায় ১৯৯০ সালে দীর্ঘ বিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ চার দশকের কমিউনিস্ট শাসনের পতন হয়েছিল। ‘এটি হচ্ছে বিশ্বের শেষ স্ট্যালিনিস্ট রাষ্ট্র। রাস্তায় পথচারীদের ভিড়। তবে মাঝে কখনো কখনো একটি-দুটি বাস, সেকেন্ডহ্যান্ড আমদানিকৃত বাস দেখা যায়। এ দেশে প্রাইভেট কার নিষিদ্ধ, বাইসাইকেলও নিষিদ্ধ। চার দশক ধরে আলবেনিয়া বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন একটি সমাজ।’ ১৯৮৯ সালের বিবিসির সংবাদদাতা এভাবেই বর্ণনা করেছিলেন আলবেনিয়াকে। সে সময় এই রিপোর্টটি ছিল আলবেনিয়ার ভেতর থেকে করা একটি বিরল প্রতিবেদন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আলবেনিয়া পরিণত হয়েছিল একটি কঠোর একনায়কতান্ত্রিক কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে। সেদেশের স্বৈরশাসক আনোয়ার হোজা ৪০ বছর ধরে ক্ষমতাসীন ছিলেন। তিনি মারা যান ১৯৮৫ সালে। তার মৃত্যুর পরও দেশটিতে অনেকদিন তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
আলবেনিয়ানদের দেশের বাইরে যেতে দেয়া হতো না, আর খুব কম সাংবাদিকই সেদেশে যেতে পেরেছিলেন। সবক্ষেত্রেই ছিল রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ। লেইয়া উপি ১৯৮৯ সালে ছিলেন ১১ বছরের স্কুলপড়ুয়া মেয়ে। রাষ্ট্র তাকে যা শেখাতো, তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন তিনি। ‘স্কুলগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল ব্যাপক। আমরা নৈতিক শিক্ষাসংক্রান্ত ক্লাসে যেতাম। সেগুলোতে আমাদের বলা হতো, আলবেনিয়ার সমাজতন্ত্রের কথা এবং তা কোন কোন দিক থেকে অন্য দেশের সমাজতন্ত্রের চেয়ে আলাদা। আমি বেড়ে উঠেছিলাম ধনতান্ত্রিক সমাজগুলোর সম্পর্কে এই ধারণা নিয়ে যে সেগুলো খুবই বিভক্ত এবং সেখানে কিছু লোকের অনেক সুযোগসুবিধা আছে, আর অন্যদের কিছুই নেই। সেখানে বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না।’
বিবিসির রিপোর্টার ১৯৮৯ সালে আলবেনিয়ার একটি স্কুল দেখতে গিয়েছিলেন। ‘একটা বড় পার্থক্য হচ্ছে অব্যাহত রাজনৈতিক শিক্ষাদান। স্কুলের করিডোরে দেখা যাচ্ছে পোস্টার— তাতে পার্টির নবম কংগ্রেসের খবর লেখা ছিল। একটি ক্লাসে দেখা গেল এনভার হোজার স্মৃতিতে কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে।’
লেইয়া উপি বলছিলেন, ‘এটা ছিল খুব তীব্র প্রতিযোগিতামূলক একটা অনুষ্ঠান। এর জন্য আমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল। আমরা যে পাড়ায় থাকতাম— সেখানে বাড়ির বাইরে আমরা যে খেলা খেলতাম, তাতে দুই পক্ষের নাম হতো ফ্যাসিস্ট আর পার্টিজান।’
তবে ১৯৯০ সাল নাগাদ পরিস্থিতিতে একটা পরিবর্তন দেখা যেতে লাগল। তখন পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশে কমিউনিজমের পতন হচ্ছিল। আলবেনিয়াতেও শুরু হলো নজিরবিহীন বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ। সাংবাদিকরা খবর দেন, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে প্রায় ৪০০ বিক্ষোভকারীর সংঘর্ষ হয়েছে, এবং দু’পক্ষেই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে সরকার স্বীকার করেছে। এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে যে, কিছু বিক্ষোভকারী এ সময় নিহত হয়। ‘একটা বিক্ষোভের কথা আমার মনে আছে। আমি ভুল করে ওই মিছিলের সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি শুনছিলাম লোকে চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছিল স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের দাবিতে। আমি কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনতে পাচ্ছিলাম— আর পুলিশ সেগুলোকে তাড়া করছিল। আমি খুবই ভয় পেয়ে পালাতে লাগলাম।’
‘কীভাবে যেন আমি স্ট্যালিনের একটা মূর্তির সামনে পৌঁছে গেলাম। আমি মূর্তিটার পেছনে লুকাতে চেষ্টা করলাম যাতে পুলিশ আমাকে দেখতে না পায়। আমার মনে আছে স্কুলে আমরা সবসময়ই স্ট্যালিন এবং তার গোঁফ নিয়ে কথা বলতাম। আমরা বলতাম স্টালিন চোখ দিয়ে হাসেন, কারণ দুই ঠোঁটই তার সেই বিশাল গোঁফ দিয়ে ঢাকা। ক্লাসে যিনি আমাদের নৈতিক শিক্ষা পড়াতেন— তার সঙ্গে আমরা স্ট্যালিনের হাসি নিয়ে কথা বলতাম।’
‘তো বিক্ষোভের মধ্যে— সেই আতংকের পরিবেশেও আমার মনে হলো, আমাকে মাথা তুলে স্ট্যালিনের মূর্তির মুখটা দেখতে হবে যে সত্যিই তিনি চোখ দিয়ে হাসেন কিনা। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে, আমি মাথা তুললাম এবং উপলব্ধি করলাম যে মূর্তিতে স্ট্যালিনের মাথাটা নেই। আমি বুঝতে পারলাম না স্ট্যালিনের মাথাটা কেউ কেটে নিয়ে গেল কেন? বলতে পারেন, আমি স্ট্যালিনকে ভালোবাসতাম, সব সময়ই মনে করতাম যে তিনি একজন মহান লোক। এই যে এত লোকে মিলে ‘স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র’ বলে চিৎকার করছে— আমি এটারও কারণ বুঝতে পারছিলাম না। কারণ আমার ধারণা ছিল যে স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র তো আমাদের আছেই।’
আলবেনিয়ায় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ সেই বিক্ষোভ এবং পরিবর্তনের দাবি এত তীব্র হয়ে উঠল যে, বোঝা যাচ্ছিল তা থামানো সম্ভব হবে না। সংস্কারের প্রথম আভাস দেখা গিয়েছিল এক মাস আগে। প্রেসিডেন্ট রমিজ আলিয়া সীমিত ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং ভোটারদের সীমিত নির্বাচনি অধিকারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
কিন্তু যখন ছাত্ররা ধর্মঘট করতে শুরু করল তখন তিনি অবধারিত পরবর্তী পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করলেন যে, স্বাধীন রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অবাধ নির্বাচন হবে। এভাবেই ইউরোপে সবশেষ কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন হলো। আমরা বাড়ির লিভিংরুমে বসে টিভি দেখছিলাম। টিভিতে পার্টির সাধারণ সম্পাদক রমিজ আলিয়া বললেন, দেশে অবাধ নির্বাচন হবে এবং রাজনৈতিক বহুত্ববাদের কথা বলার জন্য আর কাউকে শাস্তি পেতে হবে না।’
‘আমার অভিভাবকরা তো খুবই উল্লসিত হয়ে উঠলেন। এটা তাদের জন্য এবং আমার জন্যও ছিল একটা সত্য প্রকাশের মুহূর্ত। পার্টির নেতা যখন বলছেন যে, মতপ্রকাশে স্বাধীনতা দেয়া হবে তখন তারা দেশ সম্পর্কে, সরকার সম্পর্কে আসলে যা ভাবতেন, তা আমাকে মন খুলে বলতে পারলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে, এসব কী হচ্ছে। তখন তারা আমাকে বুঝিয়ে বললেন যে, আমরা যা ভাবতাম আলবেনিয়া আসলে তা ছিল না। আমার পরিবার সম্পর্কেও তারা এমন অনেক কিছু বললেন যা আমার জানা ছিল না।’
‘তারা আমাকে বললেন, যদিও তুমি একজন ভালো কমিউনিস্ট হিসেবে গড়ে উঠছিলে, কিন্তু তোমাকে ওরা কখনো পার্টিতে বা যুব আন্দোলনে গ্রহণ করত না। লেইয়া সেই সময়টায় তার পরিবার সম্পর্কে এমন কিছু জানতে পারলেন, যাতে আলবেনিয়ার শাসক চক্র এবং তার পরিবারকে নিয়ে তার এত দিনের ধারণা পাল্টে যাওয়ার উপক্রম হলো। আমার বাবা ও মা উভয় দিকের পরিবারই ছিল ভিন্নমতাবলম্বী পরিবার। তবে ভিন্ন ভিন্ন কারণে।’
‘আমার বাবার দিকে, আমার প্রপিতামহ একসময় ছিলেন আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী। ফ্যাসিস্ট ইতালি যখন আলবেনিয়া দখল করে, এবং দেশের সার্বভৌমত্ব যখন ইতালির হাতে তুলে দেয়া হয়, তখন তিনি ছিলেন সরকারের প্রধান। তাকে আলবেনিয়ার ইতিহাস বইয়ে সব সময়ই একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে তুলে ধরা হয়— যিনি দেশকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন, আলবেনিয়ার জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছিলেন। আর আমি সেই বয়স পর্যন্ত যে লোকটিকে ঘৃণা করেই বড় হয়েছিলাম, ১৯৯০ সালে এসে জানতে পারলাম তিনি আমারই পরিবারের একজন।’
‘এই লোকটির পুত্র অর্থাৎ আমার পিতামহ যে সময়টা জেল খেটেছিলেন, সেই সময়টার কথা আমাকে বোঝানো হতো যে, তিনি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে গেছেন। আসলে আমার পিতামহ এই কমিউনিস্ট সরকারের সময় রাজনৈতিক কারণে ১৫ বছর জেল খেটেছেন।’
‘অন্যদিকে আমার মায়ের দিকে পরিবার ছিল অনেক ভূসম্পত্তির মালিক, আলবেনিয়ার অন্যতম ধনী পরিবার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের সম্পত্তি নিয়ে নেয়া হয়। এই ইতিহাস তারা গোপন রেখেছিলেন— ১৯৯০ সালের আগে তারা এসব গোপন রেখেছিলেন, আমাকে জানতেই দেননি। কাজেই আমি যে শ্রেণি সংগ্রাম করছিলাম, ভাবছিলাম, আমি সবসময়ই বুর্জোয়াদের বিপক্ষে এবং প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারাদের পক্ষেই আছি। কিন্তু এখন আমি জানতে পারলাম বুর্জোয়া এবং অভিজাততন্ত্র আসলে আমার পরিবারের মধ্যেই আছে। কাজেই আমি যখন আলবেনিয়ান কমিউনিজমে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলাম— তখন আসলে আমি আমার নিজেই পরিবারের বিরুদ্ধেই লড়াই করছিলাম।’
‘তারা যে আমাকে এসব কখনো বলেনি, তার ভিন্ন ভিন্ন কারণ ছিল। একটা হলো তাদের নিজেদের বিপন্মুক্ত রাখা— কারণ আমি কাউকে এসব বলে দিলে তা পার্টির কানে যাবে, তাদের হয়তো জেলে যেতে হবে। তা ছাড়া আরেকটা কারণ হয়তো এই যে তারা চেয়েছিলেন আমার শৈশব যেন আর দশটা শিশুর মতোই স্বাভাবিক হয়। ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারটা আমার শৈশবে বার বার ঘুরে ফিরে আসত। তারা বিশ্ববিদ্যালয় কথাটা ব্যবহার করতেন একটা কোড হিসেবে। কেউ বিশ্ববিদ্যলয়ে গেছে মানে হলো তার জেল হয়েছে।’
‘তারা যখন বিভিন্ন ডিগ্রির কথা বলতেন, তার আসল অর্থ ছিল সেই কারাদণ্ডের মেয়াদ কতদিনের । কাজেই আমার মায়ের পরিবারের সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়তে গেছেন, এর মানে আসলে ছিল তারা হয় সোনাদানা লুকিয়ে রাখার দায়ে জেলে গেছেন, অথবা তাদের বাড়ি বা জমি নিয়ে নেয়া হয়েছে বা তার হস্তান্তর নিয়ে কোনো সমস্যা তৈরি হয়েছে।’
‘যখন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কথা বলা হতো তার মানে ছিল কেউ দেশদ্রোহিতার জন্য জেলে গেছে বা কাউকে হত্যা করা হয়েছে। এই রকম। যখন তারা বলাবলি করত যে কেউ পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে— তার আসল মানে হচ্ছে কেউ কারাগারে আত্মহত্যা করেছে। আলবেনিয়ায় যখন বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তখনো এই স্বাধীনতা ও পরিবর্তনের ফল মানুষের পেতে অনেক দেরি হয়েছিল।
আলবেনিয়ায় অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। সর্বত্র অভাব-অনটন ছিল। রাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। লোকে চাকরি হারাচ্ছিল। আমার মনে আছে সে সময় আলবেনিয়ায় সবাই বলত দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা’, বলেন লেইয়া উপি।
আলবেনিয়ায় কমিউনিজমের পতনের পর লেইয়া সেকেন্ডারি স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন। তার পর বিদেশ যান উচ্চ শিক্ষার জন্য। এখন লেইয়া লন্ডনে থাকেন এবং তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স রাজনৈতিক তত্ত্বের অধ্যাপক। আলবেনিয়ায় তার শৈশবের স্মৃতি নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম ফ্রি। সূত্র : বিবিসি
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ