নবী করিম (সা.) মদিনার জীবনে নিয়মিত প্রতি রমজানে ইতিকাফ করতেন। এক রমজানে কোনো কারণে ইতিকাফ ছুটে গেলে পরবর্তী রমজানে ২০ দিন ইতিকাফ করে তা পূরণ করে নিয়েছেন। (আবু দাউদ: ২৪৬৩)
ইতিকাফের ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির নিয়তে যে ব্যক্তি মাত্র একদিন ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তাআলা তার ও জাহান্নামের মধ্যে তিনটি পরিখার সমান দূরত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। প্রতিটি পরিখার দূরত্ব হবে আসমান-জমিনের মধবর্তী দূরত্বের সমান।’ (শুআবুল ঈমান: ৩৯৬৫) ইতিকাফ শুধু পুরুষের জন্য নয়। নারীদের জন্যও ইতিকাফের বিধান রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র স্ত্রীরা ইতিকাফ করতেন। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবীজি (সা.) মৃত্যু পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন।’ (বুখারি: ২০৩৬)
আমাদের দেশে নারীরা খুব কমই ইতিকাফ করেন। অথচ ইতিকাফ অত্যন্ত সওয়াব ও ফজিলতের কাজ এবং নারীদের জন্য তা খুব সহজও বটে। কারণ তারা ঘরেই ইতিকাফ করবেন। ফলে নিয়ম মেনে সংসারের খোঁজখবরও নিতে পারবেন। সংসার ঠিক রেখে তাদের ইতিকাফও হয়ে যাবে। সুতরাং এমন সুযোগ হাতছাড়া করা মোটেই উচিত নয়।
নারীদের মধ্যে ইতিকাফের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি হওয়া উচিত। পুরুষদের উচিত নারীদের ইতিকাফের জন্য উদ্বুদ্ধ করা এবং সুযোগ তৈরি করে দেয়া। তাহলে পুরুষরাও সওয়াব পাবেন। এখানে নারীদের ইতিকাফ সম্পর্কিত কিছু প্রয়োজনীয় মাসয়ালা উল্লেখ করা হলো—
নারীর ইতিকাফের বিধান: রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ পুরুষের জন্য সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া। অর্থাৎ মহল্লার মসজিদে পুরুষদের মধ্যে একজনও যদি ইতিকাফ করে তাহলে পুরো মহল্লাবাসী দায়মুক্ত হয়ে যাবে। আর নারীদের জন্য ইতিকাফ করা মুস্তাহাব।
নারীর ইতিকাফের স্থান: মহিলাদের নামাজের স্থান তাদের ঘরের অন্দরমহল; মসজিদ নয়। তারা ঘরে নামাজ পড়েও পুরুষদের মসজিদে নামাজ আদায়ের সমপরিমাণ সওয়াবের অধিকারী হন বলে সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেন নারী বেশি সওয়াব হাসিল করার আশায় মসজিদে আসার জন্য উদগ্রীব না হয়। এ অর্থে নারীদের ঘর মসজিদের সদৃশ বলে পরিগণিত। তাই নারী ঘরে তাদের নামাজ আদায়ের জন্য নির্ধারিত স্থানে ইতিকাফ করবেন। যদি আগে থেকেই ঘরে নামাজের জন্য কোনো স্থান নির্ধারিত না থাকে, তাহলে ইতিকাফের জন্য একটি স্থান নির্ধারিত করে নেবেন। এরপর সেখানে ইতিকাফ করবেন। (হেদায়া ১/২৩০, ফাতাওয়া দারুল উলুম জাকারিয়া: ৪/৬৯৯)
ইতিকাফের স্থান পর্দায় আবৃত করা: নারীরা তাদের ইতিকাফের স্থান পর্দা দিয়ে ঢেকে নেবেন। যেন ঘরে কোনো বেগানা পুরুষ লোক আসলে তাদের স্থান পরিবর্তন করতে না হয়।
নারীর ইতিকাফ পুরুষের জন্য যথেষ্ট নয়: রমজানের শেষ দশকে মসজিদে গিয়ে ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা— এর বিধান পুরুষদের জন্য, নারীদের জন্য নয়। সুতরাং মহিলারা চাই ঘরে ইতিকাফ করুক কিংবা মসজিদে— পুরুষদের দায়িত্ব আদায় হবে না। এজন্য মহল্লার মসজিদে পুরুষদের মধ্য হতে একজনও যদি ইতিকাফ না করে তাহলে পুরো মহল্লাবাসী সুন্নতে মুআক্কাদা ছেড়ে দেয়ার কারণে গুনাহগার হবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ২/১১৩, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া: ১৩/১৪৫)
স্বামীর অনুমতি গ্রহণ : বিবাহিত নারী ইতিকাফ করতে চাইলে স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। স্বামীর অনুমতি ছাড়া ইতিকাফ করা অনুচিত। আর স্বামীদের উচিত, যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া স্ত্রীদের ইতিকাফে বাধা না দেয়া। তাদের ইতিকাফের সুযোগ করে দেয়া। এতে উভয়ই সওয়াব পাবেন। (রদ্দুল মুহতার: ২/৪৪১, ফাতাওয়া আলমগিরি : ১/২১১)
মাসয়ালা: স্বামী স্ত্রীকে ইতিকাফের অনুমতি দেয়ার পর আর বাধা দিতে পারবেন না। বাধা দিলেও সে বাধা গ্রহণযোগ্য নয় এবং স্ত্রীর জন্য তা মানাও জরুরি নয়। (রদ্দুল মুহতার: ২/৪৪১, ফাতাওয়া আলমগিরি : ১/২১১)
স্বামী ও সন্তানের দেখাশোনার প্রয়োজন হলে: যে নারীর স্বামী বৃদ্ধ বা অসুস্থ কিংবা তার ছোটছোট ছেলে-মেয়ে রয়েছে এবং তাদের সেবা-শুশ্রূষা করার কেউ নেই, সে মহিলার জন্য ইতিকাফ করার চেয়ে তাদের সেবাযত্ন করা উত্তম।
ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রী-সম্ভোগ: ইতিকাফ অবস্থায় রাতেও স্ত্রী-সহবাস করা যাবে না। করলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। তদ্রূপ স্ত্রীকে চুম্বন, আলিঙ্গন ও উত্তেজনার সঙ্গে স্পর্শ করাও বৈধ নয়। যদি এসবের কারণে বীর্যপাত ঘটে তাহলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে। (সুরা বাকারা: ১৮৭, বাদায়েউস সানায়ে: ২/২৮৫)
ঋতুস্রাব অবস্থায় ইতিকাফ: মহিলাদের ঋতুস্রাব অবস্থায় ইতিকাফ করা ঠিক নয়। কেননা এ অবস্থায় রোজা রাখা যায় না। আর সুন্নত ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। (বাদায়েউস সানায়ে : ২/২৭৪)
মাসয়ালা: নারীদের ইতিকাফে বসার আগেই তাদের ঋতুস্রাবের দিন-তারিখ হিসাব করে বসা উচিত। যাতে ইতিকাফ শুরু করার পর পিরিয়ড শুরু হয়ে না যায়। তবে কারো রমজানের শেষ দশকে পিরিয়ড হওয়ার নিয়ম থাকলে তিনি পিরিয়ড শুরু হওয়া পর্যন্ত নফল ইতিকাফ করতে পারবেন।
ওষুধের মাধ্যমে ঋতুস্রাব বন্ধ রেখে ইতিকাফ করা: মহিলারা ওষুধ-বড়ি খেয়ে ঋতুস্রাব বন্ধ রেখে রোজা রাখলে এবং ইতিকাফ করলে রোজা ও ইতিকাফ সহিহ হবে। তবে এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বিধায় অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
ইতিকাফ অবস্থায় ঋতুস্রাব শুরু হলে: ইতিকাফ শুরু করার পর ঋতুস্রাব শুরু হয়ে গেলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে। পরে শুধু একদিনের ইতিকাফ রোজাসহ কাজা করতে হবে। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৫০২)
ইতিকাফের স্থান থেকে বের হওয়া: মহিলারা ঘরের যে স্থানটিকে ইতিকাফের জন্য নির্ধারিত করবেন, তা তাদের ক্ষেত্রে মসজিদের মতোই গণ্য হবে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া তারা সেখান থেকে বের হতে পারবেন না। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া সে স্থানের বাইরে ঘরের অন্যত্র গেলেও ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ২/২৮২)
মাসয়ালা: প্রাকৃতিক প্রয়োজন বলতে বুঝায়, প্রস্রাব-পায়খানা। সুতরাং ইতিকাফ অবস্থায় মহিলারা প্রস্রাব-পায়খানার জন্য ইতিকাফের স্থান থেকে বের হতে পারবেন। অজুর জন্য বাইরে যেতে পারবেন। আর যদি এসবের জন্য ইতিকাফ-কক্ষের ভেতরেই রুচিসম্মত সংযুক্ত বাথরুম থাকে তাহলে এর জন্য বাইরে যেতে পারবেন না।
মহিলাদের ইতিকাফের সুযোগ না হলে : মহিলাদের ইতিকাফের কারণে যদি সন্তান প্রতিপালন, ঘর-সংসারের নিরাপত্তা এবং তার ওপর অর্পিত অপরিহার্য কাজ পালনে ব্যাঘাত না ঘটে তবেই তারা স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে ইতিকাফ করতে পারবেন। অন্যথায় তাদের জন্য ইতিকাফ না করে নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন, সংসার দেখা-শোনা, স্বামীর সেবা ইত্যাদিতেই অগণিত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তারা কাজের ফাঁকে যথাসাধ্য দোয়া-জিকির, তাসবিহ, কোরআন তেলাওয়াত, নফল নামাজ, দীনি বইপত্র পাঠ ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করবেন।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ