রমজানের ইবাদতের মধ্যে ‘সদকাতুল ফিতর’ আদায় করা অন্যতম ইবাদত। সদকাতুল ফিতর—এ দুটি আরবি শব্দ রয়েছে। সদকা মানে দান, আর ফিতর মানে রোজা ভঙ্গ বা সমার্পন। অর্থাৎ রোজার মাসের সমাপ্তির পর ঈদুল ফিতরের দিন আদায় করা সদকাকেই সদকাতুল ফিতর বলা হয়। এটিকে জাকাতুল ফিতর বা ফিতরাও বলা হয়ে থাকে। সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করেছেন। এর পরিমাণ হলো, এক সা জব বা এক সা খেজুর। ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন সবার ওপরই এটি ওয়াজিব।’ (বুখারি: ১৫১২)
যে কারণে সদকাতুল ফিতর
রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষমা ও ঈদের আনন্দ ধনী-গরিব সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সদকাতুল ফিতর আবশ্যক করা হয়েছে। রোজা পালন করতে গিয়ে মানুষের ভুল-ভ্রান্তি হয়। মনের অগোচরে গুনাহ হয়। জবান থেকে অনর্থক ও অশ্লীল কথা বের হয়। সদকার মাধ্যমে ব্যক্তি এসব গুনাহ থেকে পরিত্রাণ পায়। রোজা পবিত্র হয়। পাশাপাশি ফিতরা আদায়ের মাধ্যমে গরিবকে সহযোগিতা করা হয়। তার মুখে হাসি ফোটানো হয়।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) রোজা পালনকারীর জন্য সদকাতুল ফিতর আদায় অপরিহার্য করে দিয়েছেন, যা রোজা পালনকারীর অনর্থক, অশ্লীল কথা ও কাজ পরিশুদ্ধকারী এবং অভাবী মানুষের জন্য আহারের ব্যবস্থা। যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের আগে এটা আদায় করবে, তা সদকাতুল ফিতর হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে। আর যে ঈদের সালাতের পর আদায় করবে তা অপরাপর (নফল) সদকা হিসেবে গৃহীত হবে।’ (আবু দাউদ : ১৬০৯)
ইমাম ওয়াকি ইবনুল জাররাহ বলেন, ‘রমজান মাসের জাকাতুল ফিতর নামাজের সিজদায়ে সাহুর সমতুল্য। অর্থাৎ নামাজে ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে যেমন সিজদায়ে সাহু দিলে এটা পূর্ণ হয়ে যায় তেমনি রোজার মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে সাদকাতুল ফিতর দিয়ে এর প্রতিকার হয়। তা ছাড়া ধনী-গরিব উভয়ে যেন অন্তত ঈদের দিন উত্তম পোশাক ও উন্নতমানের খাবার খেতে পারে এ জন্যই ফিতরার ব্যবস্থা।’
ফিতরার পরিমাণ
ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর আবশ্যক করেছেন। এর পরিমাণ হলো, এক সা জব বা এক সা খেজুর। ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন সবার ওপরই এটা আবশ্যক।’ (বুখারি: ১৫১২)
রাসুল (সা.)-এর যুগে মোট চারটি পণ্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা হতো। খেজুর, কিশমিশ, জব ও পনির। সাহাবি মুয়াবিয়া (রা.) এর সঙ্গে গম সম্পৃক্ত করেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন আমরা এক সা’ পরিমাণ খাদ্য, জব, বা খেজুর অথবা এক সা পরিমাণ পনির বা কিশমিশ দিয়ে সদকায়ে ফিতর আদায় করতাম।’ (বুখারি: ১৫০৬)
ফিতরার পরিমাণ সম্পর্কে শরিয়তে দুটি মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা হচ্ছে ‘এক সা’ বা ‘নিসফে সা’। খেজুর, পনির, জব ও কিশমিশ দ্বারা আদায়ের ক্ষেত্রে এক ‘সা’=৩২৭০.৬০ গ্রাম (প্রায়)— অর্থাৎ তিন কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি। এ ছাড়া গম দ্বারা আদায় করতে চাইলে ‘নিসফে সা’=১৬৩৫.৩১৫ গ্রাম, অর্থাৎ এক কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি প্রযোজ্য হবে। (আওজানে শরইয়্যাহ, পৃ. ১৮)
এ পাঁচটি দ্রব্যের যে কোনো একটি দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের সুযোগ দেয়া হয়েছে যেন প্রত্যেকে নিজ নিজ সামর্থ্যানুযায়ী আদায় করতে পারে। তবে সবার জন্য সবচেয়ে কম দামের দ্রব্য দিয়ে সদকায়ে ফিতর আদায় করা অনুচিত; বরং যে ব্যক্তি খেজুর, কিশমিশ দিয়ে সদকায়ে ফিতর আদায় করার সামর্থ্য রাখে, সে তা দিয়েই আদায় করবে। রাসুল (সা.)-এর সময়ে সামর্থ্যানুযায়ী সবাই উত্তম পণ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করতেন। সর্বোত্তম দান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, দাতার কাছে যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি। (বুখারি: ১৯৭৪)
ফিতরা আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা অদ্ভুত মানসিকতার পরিচয় দেই। আমাদের দেশে সাধারণত সর্বনিম্ন পরিমাণ অর্ধ সা’ গম এর মূল্য হিসেবে জনপ্রতি ৭৫ টাকা হিসেবে সবাই আদায় করতে চান। কোটিপতি হতে মধ্যবর্তী সবাই সর্বনিম্ন ৭৫ টাকা দিয়েই দায়মুক্ত হতে চান। বিষয়টি রাসুল (সা.)-এর শিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়; বরং এটা তো সর্বনিম্ন সম্পদের মালিকের জন্য চলে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যাদের তাওফিক দিয়েছেন, তাদের অন্যান্য দ্রব্য দিয়ে সর্বোচ্চ সদকায়ে ফিতর আদায় করা উচিত। তাই সামর্থ্যানুযায়ী বেশি মূল্যের পণ্য দিয়ে ফিতরা আদায়ের চেষ্টা করতে হবে।
যার ওপর ওয়াজিব
সদকাতুল ফিতরের নিসাব জাকাতের নিসাবের সমপরিমাণ। যার মালিকানায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ও ঋণ ছাড়া সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা কিংবা এর সমমূল্য কোনো সম্পদ বা টাকা থাকে, তাহলে তার ওপর সদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব। যার ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব, তিনি নিজের পক্ষ থেকে যেমন আদায় করবেন, তেমনি নিজের অধীনদের পক্ষ থেকেও আদায় করবেন। তবে এতে জাকাতের মতো বর্ষ অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়। এমনকি পবিত্র রমজানের শেষ দিনেও যে নবজাতক দুনিয়ায় এসেছে কিংবা কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে, তার পক্ষ থেকেও সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী তার নিজের পক্ষ থেকে এবং নাবালেগ সন্তানের পক্ষ থেকে সদাকাতুল ফিতর আদায় করবেন।
যেহেতু ফিতরা একটি ইবাদত, তাই যারা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নন, তাদেরও ফিতরা আদায় করা সুন্নত ও নফল। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আমাদের মধ্যে ছিলেন, তখন আমরা ছোট, বড়, মুক্ত, ক্রীতদাস সবার পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্য অর্থাৎ এক সা পনির বা এক সা জব বা এক সা খেজুর অথবা এক সা কিশমিশ দিয়ে। আমরা এভাবেই আদায় করতে ছিলাম।’ (হাদিস)
কখন আদায় করবেন
সদকাতুল ফিতর আদায়ের সুন্নত ও উত্তম সময় হলো, ঈদের চাঁদ ওঠা থেকে নিয়ে ঈদে নামাজের আগে আদায় করে দেয়া। কেননা রাসুল (সা.) ঈদগাহে যাওয়ার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর দুয়েকদিন আগে যদি আদায় করা হয় তাহলেও আদায় হয়ে যাবে। এ মর্মে সাহাবিদের আমল রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে সদকা আদায় করল, তাই গ্রহণযোগ্য সদকাতুল ফিতর। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নামাজের পর তা আদায় করল, তা সাধারণ দান-অনুদানের অন্তর্ভুক্ত বলে গন্য হলো।’ (আবু দাউদ: ১৬০৯)
যাদের দেয়া যাবে
জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত এমন অভাবী লোকদের সদকাতুল ফিতর দিতে হবে। একজন দরিদ্র মানুষকে একাধিক ফিতর দেয়া যেমন জায়েজ, তেমনি একটি ফিতরা বণ্টন করে একাধিক মানুষকে দেয়াও জায়েজ। আল্লাহ বলেন, ‘জাকাত হলো কেবল ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তি, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর পথে জিহাদকারী এবং মুসাফিরদের জন্য। এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা তাওবা: ৬০)
পরিবারের সদকাতুল ফিতর
পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব যার; সাদকাতুল ফিতর আদায় করার দায়িত্বও তার। তাই স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও অধীনস্থদের সাদকাতুল ফিতর আদায় করবে পরিবারের দায়িত্বশীল কর্তা ব্যক্তি। যদি তাদের সবাই নিজ নিজ ফিতরা দিতে সামর্থ্য না রাখে।
নির্ধারিত খাদ্যদ্রব্য, পণ্যসামগ্রী বা তার মূল্যে টাকায়ও ফিতরা আদায় করা যায় এবং অন্য কোনো বস্তু (যেমন: পোশাক-আশাক, ঈদের বাজার ইত্যাদি) কিনেও দেয়া যায়। পিতা-মাতা ও ঊর্ধ্বতন এবং ছেলেমেয়ে ও অধস্তন এবং যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব রয়েছে (যেমন: স্ত্রী ও পোষ্য) তাদের ওয়াজিব ফিতরা ও জাকাত প্রদান করা যায় না।
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ