পবিত্র মাহে রমজান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এক বিশেষ উপহার। রমজান মানেই জীবনের গুনাহ্সমূহ ক্ষমা করিয়ে নিজেকে জান্নাতি করে তোলার অবারিত সুযোগ। রমজানের দিন-রাতজুড়ে শুধু ক্ষমা আর ক্ষমা। নফল নামাজ, রোজা, তিলাওয়াত, সাহরি, ইফতার; প্রতিটি ইবাদতই যেন ক্ষমার নতুন নতুন আয়োজন। রমজান ইবাদতের মৌসুম। রমজান আসার আগে রমজানকে পাবার জন্য মু’মিনের হূদয় যেমন ব্যাকুল হয়ে থাকে। রমজানের দিনগুলো যখন ফুরিয়ে যেতে থাকে মুমিনের হূদয়ে ইমানী এক ব্যথা অনুভূত হয়। মুমিনের হূদয় যেন রমজানকে বিদায় দিতে নারাজ। তবুও রমজান চলে যায়। প্রতিটি সূর্যাস্ত রমজানের একেকটি দিনের সমাপ্তি। এবারের রমজানের দ্বিতীয় দশকের শেষ দিন আজ। আজকের সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে রমজানের শেষ দশকের সূচনা হবে। বেজে উঠবে রমজানের বিদায়ঘণ্টা। চলে যাওয়া দুই দশকে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমলের যে কমতি হয়েছে তা পুষিয়ে রমজানকে জান্নাতে প্রবেশের ওসিলা বানানোর শেষ সুযোগটুকু যেন হাতছাড়া না হয় সেজন্য শেষ দশকের ইবাদতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.) শেষ রমজানের শেষ দশকের আমলেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিনে (ইবাদত-বন্দেগিতে) যে পরিশ্রম করতেন, তা অন্য কোনো সময় করতেন না। (মুসলিম: ১১৭৫)। শুধু নিজেই পরিশ্রম করতেন না, অন্যরাও যেন এ কম পরিশ্রমে জান্নাত অর্জন করতে পারেন সেজন্য অন্যদেরও জাগিয়ে দিতেন, ইবাদতে উৎসাহ দিতেন। আলী (রা.) বলেন, রমজানের শেষ ১০ দিনে রাসুল (সা.) (ইবাদত-বন্দেগি করার নিমিত্তে) তাঁর পরিবারবর্গকে (রাতে) জাগিয়ে দিতেন। (তিরমিজি: ৭৯৫)। রমজানের এ শেষ সুযোগটুকু বেশি কাজে লাগাতে নিম্নের বিষয়গুলোতে খেয়াল রাখা যেতে পারে—
১. লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান: রমজানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন হলো লাইলাতুল কদর। রমজানের একটি রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। হাজার হাজার মাস ইবাদত করে যে সওয়াব লাভ করা যায়, একটি রাতের ইবাদতেই সে সওয়াব লাভ করা যায়। সে মহিমান্বিত রাতই লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব কতটুকু তা প্রমাণে এতটুকুই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তায়ালা এ রাতের ফজিলত ও গুরুত্ব বোঝাতে পূর্ণ একখানা সুরা নাজিল করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি কি জানেন, লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।’ (সুরা কদর: ১-৩)। অন্যদিকে, লাইলাতুল কদর ভাগ্য রজনী। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চই আমি একে (পবিত্র কোরআন) এক মুবারক রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, আমি তো সতর্ককারী। এ রাতেই প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সুরা দুখান: ৩-৪)। যে রাতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্থির হয় তা হলো কোরআন নাজিলের রাত। আর কোরআন নাজিলের রাতই তো লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশকেরই কোনো এক রাত। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’ (বুখারি: ২০২০)।
২. ইতিকাফ করা: আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির আশায় মসজিদে অবস্থান করাই ইতিকাফ। ইতিকাফ বান্দা ও জাহান্নামের মাঝে দূরত্ব তৈরি করে দেয়, জাহান্নাম থেকে মুক্তির উসিলা হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। প্রতিটি খন্দক আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী দূরত্বেও চেয়েও বেশি দূরবর্তী হবে।’ (তাবারানি: ৭৩২৬)।
ইতিকাফকারীর জন্য নফল নামাজ, তিলাওয়াত ও জিকিরে মশগুলা থাকা উত্তম। কিন্তু একজন ইতিকাফকারী যখন ঘুমিয়ে থাকেন তখনো তার জন্য ইবাদতের সওয়াব লেখা হতে থাকে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সে গুনাহ্ থেকে বেঁচে থাকে এবং পুণ্য অর্জনকারীদের মতো পুণ্য তার জন্যও অব্যাহত থাকে। (ইবনে মাজাহ: ১৭৮১)।
তাই ইতিকাফের দিনরাত ইবাদতে শামিল। ফলে ইতিকাফকারী লাইলাতুল কদরে চুপ থাকলেও ইবাদতের সওয়াব লাভ করবেন। আর এভাবেই লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির বিশেষ এক ইবাদত ইতিকাফ। এজন্যই রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের দশকে ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারি: ২০২৫)।
৩. বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া: রমজানের বিশেষ ইবাদত হলো নফল নামাজ পড়া। রমজানের নফল নামাজ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থকে বিশেষ ক্ষমাপ্রাপ্তির মাধ্যম। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সাওয়াবের নিয়তে রমজানে নামাজে দাঁড়ায় তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়।’ (বুখারি: ৩৭, মুসলিম: ৭৫৯)।
সুতরাং, রমজানের বাকি দিনগুলোতে তারাবিহ, তাহাজ্জুদ, ফরজ নামাজের আগে-পরের সুন্নাত ও নফলসমূহে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত। বিশেষ সািরর সময় আমরা যখন জাগ্রত হই একটু আগে উঠলেই তো কিছু তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহ তায়ালার দরবারে অশ্রুসিক্ত হয়ে ক্ষমা চাইতে পারি। লাভ করতে পারি বিশেষ ক্ষমা।
৪. দান-সদকা করা: অন্যান্য সময় অনেক বেশি দান করেও আমরা যে সওয়াব অর্জন করতে পারি না রমজানে তা সামান্য দানেই অর্জন করতে পারি। কারণ রমজানে প্রতিটি আমলের সওয়াব অন্তত ৭০ গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। অপচয়-অপব্যয় বাদ দিয়ে সে অর্থদান করে বহুগুণ সওয়াব অর্জন করতে পারি।
লেখক: প্রিন্সিপাল, বাইতুল হিকমাহ একাডেমি, গাজীপুর
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ