ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

হিজাবের বিরুদ্ধে লড়াই কেন

প্রকাশনার সময়: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:১৫

কলেজের ক্লাসরুমে প্রবেশের সময় ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানধারীদের জবাবে ‘আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দেয়া হিজাব পরিহিতা ছাত্রী মুসকান খান কি ধর্মীয় উস্কানিদাতা? বোরকা-হিজাবের ব্যাপারটি কি শুধুই ধর্মীয়? দৃঢ় বিশ্বাস— অধিকাংশ লিবারেল-বিজেপিবান্ধব লোকেরা উল্লিখিত প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলবেন। কিন্তু সত্য হলো, মুসকান খানের প্রতিবাদ ও পর্দা-হিজাবের ব্যাপারটি শুধুই ধর্মীয় নয়; বরং বিষয়টি ধর্মীয় স্বাধীনতারও।

ফলে এটা সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসকানের সাক্ষাৎকার শ্রবণকারীরা জেনেছেন, সে প্রথমে প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু জয় শ্রীরাম বলে চিৎকারকারীরা ব্যাপক উগ্রতা শুরু করলে সে ভয় পেয়ে যায়। ‘আর আমি ভয় পেলে আল্লাহর নাম স্মরণ করি। এজন্য আল্লাহু আকবর স্লোগান দিয়েছি’— বক্তব্য মুসকানের। ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গেছে, গলায় গেরুয়া রুমাল জড়ানো যুবকরা জয় শ্রীরাম স্লোগান দিয়ে একাকী থাকা মুসকান খানকে ঘেরাও করার উপক্রম হয়। তখন মুসকান খান ভয় দূর করতে ‘আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দিয়ে সামনে চলে যায়।

ভিডিওতে প্রমাণিত, হিজাবওয়ালী মুসকান উস্কানি দেয়নি। উস্কানি দিয়েছে গেরুয়া রুমালধারী উন্মত্ত যুবকরা। ভিডিওতে সবকিছু পরিষ্কার। কিন্তু যারা সত্যকে মিথ্যা বানাতে বদ্ধপরিকর— তাদের ঠেকাবে কে? কর্নাটকের শিক্ষামন্ত্রী বিসি নাগেশ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘মুসকান খানকে ছেলেরা ঘেরাও করতে যায়নি। আল্লাহু আকবর বলার সময় তার কাছে কেউ ছিল না! সে কেন কলেজ ক্যাম্পাসে আল্লাহু আকবর স্লোগান তুলে উস্কানি দিল। ক্যাম্পাসে আল্লাহু আকবর বা জয় শ্রীরাম স্লোগান তোলা থেকে বিরত থাকতে হবে।’

টিভি চ্যানেলের রিপোর্টেও এই সত্য সামনে এসেছে, জয় শ্রীরাম স্লোগানধারী যুবকরাই হিজাব পরিহিতা মুসকান খানকে কলেজে প্রবেশে বাঁধা দেয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছিল। অশ্লীল ভাষায় হুমকি দিয়ে বলছিল, কলেজে আসতে হলে হিজাব খুলে আসতে হবে! অথচ বিজেপি নেতা ও রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর চোখে এসবের কিছুই ধরা পরেনি! প্রকাশ্যে উগ্রবাদ বিস্তারকারীদের বাঁচাতে তিনি উঠে-পড়ে লেগেছেন। বিপরীতে মুসকান খানের উস্কানি ঠিকই খোঁজে পেয়েছেন! এদিকে আরএসএসের মুসলিম উইং মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা ইন্দ্রেশ কুমার অভিযোগ করেছেন, ‘মুসকান খান হিজাব ইস্যুকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সামনে এনেছে! সে অন্যের হয়ে খেলছে! তার বোরকার নিচে জিন্স ছিল!’ অর্থাৎ ইন্দ্রেশ কুমার হিজাব ইস্যুকে ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছেন!

জিন্স পরিহিতা কোনো নারী হিজাব পরতে চাইলে অসুবিধা কিসের? কেউ বলছেন, পিতা-মাতার চাপে সে বোরকা পরিধান করেছে। জবাবে মুসকান স্পষ্টভাবে বলেছে, সে নিজের ইচ্ছায় বোরকা পরে স্কুটার চালিয়ে কলেজে যাতায়াত করে। নিজের নিরাপত্তার জন্য কখনো গার্ড নেয়নি। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, মুসকান খান উগ্রবাদী নয়। তার জানা আছে, বোরকা-হিজাব তার স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক নয়; বরং বোরকা তার ধর্মীয় ও সাংবিধানিক অধিকার।

ভারতের সংবিধান প্রণেতাদের ভালোভাবে জানা ছিল, নাগরিকদের নিজস্ব ধর্ম-রুচি ও সভ্যতা-সংস্কৃতি অনুযায়ী জীবন পরিচালনার অধিকার না দেয়া হলে, তাদের সঙ্গে বর্বরতা ও পক্ষপাতমূলক আচরণের আশঙ্কা আছে। ফলে সংবিধানে কিছু মৌলিক অধিকার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যেন প্রতিটি নাগরিক ভয়-ডরহীন নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতি পালন করতে পারে। তারা কোনো ধর্মকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে, সব ধর্ম-সংস্কৃতিকে এক পাল্লায় রেখেছেন। ফলে আইনগতভাবে দেশের প্রতিটি নাগরিক নিজ ধর্মের ওপর স্বাধীনভাবে আমল করার অধিকার রাখেন।

সংবিধানের ২৫-ধারায় বলা হয়েছে, ‘দেশের সকল নাগরিক স্বাধীন, স্বাধীনভাবে ধর্মগ্রহণ ও পালনের ক্ষেত্রে সমান অধিকার লাভ করবে।’ বোঝা গেল, এই অধিকার হরণ করার অর্থ হলো, আইনি অধিকার হরণ করা। প্রশ্ন হলো, বোরকা পরিধান ধর্মীয় অধিকার কি না? এই প্রশ্নের জবাব এমন প্রশ্নের মাধ্যমেও দেয়া যায়, ‘সরকারি অফিসে দেব-দেবীর ছবি ঝোলানো ও তাতে ফুল ছিটানো, কোনো স্কুলে ক্রুশ চিহ্ন স্থাপন করা, কোনো শিখ ধর্মাবলম্বীর পাগড়ি পরিধান, হিন্দু ব্যক্তির শাখা-সিদুঁর-তিলক লাগিয়ে সরকারি অফিসে চাকরি-আগমন, এসব কি ধর্মীয় অধিকার নয়?’

অবশ্যই এগুলো ধর্মীয় অধিকার। কিন্তু অভিযোগযোগ্য নয়। কারণ, এগুলো প্রত্যেকের সাংবিধানিক অধিকার। এসব কাজে বাঁধাপ্রদান আইন লঙ্ঘনের শামিল। মানুষ কি জানে না, সেকুলার ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে যোগি নামের একজন গেরুয়া পোশাকধারী মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে আছেন? একজন সাধু, যিনি মালিগ্রাম বোমা হামলার আসামি, গেরুয়া পোশাক পরিধান করেই পার্লামেন্টে যাতায়াত করেন? সবাই জানে। কথা হলো, প্রত্যেকের নিজের পছন্দমতো পোশাক পরিধানের অধিকার আছে। এটা আইনি অধিকার। তেমনি যারা বোরকা পরিধান করতে ইচ্ছুক, তারা বোরকা পরিধান করবে। বরং ইসলামি শরিয়ত বোরকা পরিধানের ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান করেছে।

বলা উদ্দেশ্য, বোরকা-হিজাব পরিধানে বাধা দেয়ায় শুধু ধর্মীয় অধিকারেই অবৈধ হস্তক্ষেপ নয়; বরং সাংবিধানিক অধিকারেও হস্তক্ষেপ করা হয়। বাকস্বাধীনতার ধ্বজাধারী কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, হিজাবের প্রতি চরম শত্রুতামূলক পরিবেশে বোরকা-হিজাব পরিধানের ওপর জোর দেয়ার কী দরকার? এখন তো শান্তি ও নিরাপত্তা প্রয়োজন! এই প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন ওঠে, কত সংখ্যক বিষয়কে দেখেও না দেখার ভান করতে হবে? বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ধর্মীয় ও সাংবিধানিক অধিকার হরণের জন্য কোনো কাজ বাদ রাখা হয়েছে? ইয়োগা, সূর্য নমস্কার, গীতা পাঠ আবশ্যক, বন্দে মাতরম স্লোগান, লাভ জিহাদের নামে বর্বরতা, ধর্মান্তকরের ধুয়ো তুলে মুসলিম গ্রেফতার, সাম্প্রদায়িক নাগরিক বিল, মাদরাসা বন্ধ, তিন তালাক বিলের নামে ইসলামি শরিয়তের বিকৃতি, বাবরি মসজিদ রায়, গো রক্ষার নামে মুসলিম হত্যা, মুসলিম গণহত্যার ডাক থেকে শুরু করে বর্তমান বোরকার ওপর হামলা! এসব বিষয়ে কি প্রতিরোধ জরুরি নয়?

কিছু মানুষের বক্তব্য, ‘হিজাব উত্তেজনা মূলত ইউপি ইলেকশনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।’ তবে কি মেনে নিতে হবে, দেশের সমস্ত হিন্দু সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছেন! এক বোরকা ইস্যুতে ন্যায়-অন্যায় ভুলে তারা সবাই মুসলমানদের বিরুদ্ধে একট্টা হয়েছেন! আমি এটা বিশ্বাস করতে চাই না। যদি এটা সত্য হয়ে থাকে, তবে তো কঠোরভাবে প্রতিরোধ আবশ্যক। এটা আইনি প্রতিরোধ, কোনো যুদ্ধ নয়। যেখানেই এ ধরনের অধিকার হরণের ঘটনা ঘটছে, সেখানেই প্রতিবাদের আওয়াজ উঁচু করা জরুরি। এটা সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় পরিচয় সংরক্ষণের লড়াই। মনে রাখতে হবে, উগ্রবাদীদের প্রচেষ্টা একটাই— দেশকে ‘গেরুয়াধারী রাষ্ট্র’ বানানো। মানুষ কী খাবে, কী পরবে, কীভাবে বিয়ে করবে— কিছু লোক এসব বিষয় নির্ধারণ করে দেবে, আর সবাই সে অনুযায়ী চলবে! ফলে লড়াই চলছে সাংবিধানিক অধিকার ফিরে পাওয়ার।

যারা হিজাব ইস্যুকে শুধু স্বাধীনতা এবং ইচ্ছার ব্যাপার বলছেন এবং ‘আমার শরীর-আমার ইচ্ছা’ স্লোগান তুলছেন, তাদের ব্যাপারে কথা হলো, অবশ্যই এটা স্বাধীনতার বিষয়। তবে সেটা ধর্মীয় ও সাংবিধানিক। ধর্ম ও আইনের বিরুদ্ধে নিজের ইচ্ছা বাস্তবায়নের বিষয় নয়। এটা আমার শরীর-আমার ইচ্ছার বিষয়ও নয়। কারণ, যারা হিজাব-বোরকা পরিধানের ওপর জোর দিচ্ছেন। তারা একথা মানেন, শরীরও তাদের না, শরীরের ওপর তাদের ইচ্ছাও চলে না। শরীর আল্লাহর, শরীরের ওপর ইচ্ছাও চলবে আল্লাহরই।

মুম্বাই উর্দু নিউজে প্রকাশিত সম্পাদকের কলাম থেকে, ভাষান্তর আমিরুল ইসলাম লুকমান

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ