ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সফলতা ও সন্তুষ্টির পথ ‘ইহসান’

প্রকাশনার সময়: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:৫৩

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি তার পুরস্কার বিনষ্ট করি না, যে সুন্দরভাবে কাজ করে।’ (সুরা কাহাফ: ৩০) এটি এমন একটি আয়াত— যা মুমিনের আত্মাকে প্রশান্ত করে, সুসংবাদ দেয়। এই ঐশী প্রতিশ্রুতি থেকে উৎকৃষ্ট ও মধুরতর এবং পবিত্রতর প্রতিশ্রুতি কোনো কর্ণকুহর কখনো শুনেনি। মুমিন আল্লাহর প্রতিশ্রুতিকে সত্য মনে করে। তাঁর অনুগ্রহের নিশ্চয়তা ও ন্যায়পরায়ণতায় আস্থা রাখে। আলোচ্য আয়াতটি একজন মুসলিমকে তার কর্মে খেয়াল রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। ইসলাম সবচেয়ে সুন্দর ও উৎকৃষ্টতর কর্ম সম্পাদন পছন্দ করে। পার্থিব ও পরকালীন কর্মসমূহে ‘ইহসান’-এর স্তরে উপনীত হতে, যে ব্যক্তি নিষ্ঠার সঙ্গে প্রচেষ্টা ব্যয় করে কাজকর্ম পূর্ণাঙ্গভাবে আঞ্জাম দেবে, আল্লাহর কাছে তার জন্য রয়েছে উচ্চ মর্যাদা। তার রব তাকে স্বীয় ভালোবাসা, সান্নিধ্য ও দয়া দিয়ে সম্মানিত করবেন।

বর্তমান সমাজ ও বিশ্ব কর্মে ইহসানের (নিপুণতা ও দক্ষতা) অনুপস্থিতির বিলাপ করছে— যা প্রকাশ পাচ্ছে, কর্মচারীদের কাজে অবহেলা, অফিস টাইম অপচয়, দুর্বল উৎপাদন, আমানতের খেয়ানত, স্বচ্ছতার অভাব ও বিশৃঙ্খলার বিস্তৃত পরিধিতে। কর্মে ইহসানের উপস্থিতি তো দূরের কথা। ফলে রাষ্ট্র কঠোর নিয়ম-কানুন প্রবর্তন করতে বাধ্য হয়। অথচ এই সমস্যা সমাধানে ইসলাম এমন ঐশী পদ্ধতি নিয়ে এসেছে যার দ্বিতীয় উপমা নেই। এমন নববি আদর্শ পেশ করেছে যার বিকল্প দৃষ্টান্ত নেই। উপকারী প্রতিবিধান ও খাঁটি ওষুধ প্রয়োগ করে। মূলত এই মানহাজ গভীর ঈমানের মর্মার্থ থেকে উদ্গত, যা ব্যক্তিকে ইহসানের তরবিয়্যাত দেয়। তার হূদয়ে ঈমান বপন করে। নবীজি (সা.) এভাবে তা বর্ণনা করেছেন, ‘ইহসান হচ্ছে তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে যেন তাকে দেখছ। আর যদি না দেখে থাক, তাহলে মনে করবে তিনি তোমাকে দেখছেন।’ (বুখারি) রাসুল (সা.) আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, ইহসান সকল জিনিসে পরিব্যাপ্ত। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সকল জিনিসের ওপর ইহসান আবশ্যক করে দিয়েছেন।’ (মুসলিম)

সালাত, সিয়াম, হজ, অজু ও সদকাসহ সকল কাজে তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে কর যেন তাকে দেখছ। যদি না দেখে থাক, তাহলে মনে কর যেন তিনি তোমাকে দেখছেন। অর্থাৎ তুমি যদি এই গুণে গুনান্বিত হয়ে ইবাদত করতে না পারো, তাহলে আল্লাহর ভয় ও মুরাকাবার (নজরদারি) ভিত্তিতে ইবাদত কর। (মনে করতে হবে তিনি সর্বক্ষণ বান্দাকে পর্যবেক্ষণ করছেন) এই মর্মার্থ যখন অন্তরে গেঁথে যাবে, তখন ব্যক্তির বাহ্যিক আচরণেও তা প্রকাশ পাবে। তাকে নিপুণতার সঙ্গে কাজকর্ম সুন্দরভাবে আঞ্জাম দিতে উদ্বুদ্ধ করবে। ফলে দেশ-জাতির অবস্থা উন্নত হবে।

ইহসানের এই অর্থ এখলাস প্রতিষ্ঠা করবে এবং মুসলিম দৈনন্দিন জীবনে ইবাদত, মুয়ামেলাত, সম্পর্ক ও ক্রয়-বিক্রয়সহ সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর মুরাকাবা জীবন্ত করবে। এই আত্মোপলব্ধি শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ দায়িত্বশীলদের অন্তর জাগ্রত করবে। তাকে কর্মে সর্বোচ্চ দক্ষতা প্রদর্শন ও সুন্দরভাবে কর্ম সম্পাদনে বাধ্য করবে। কেননা প্রত্যেকেই তখন এই উপলব্ধি করবে, ‘তার কাজ আল্লাহর দৃষ্টিতে আছে।’ এই অনুভূতি কর্মকে রিয়া ও নেফাকমুক্ত করে। প্রধান কর্মকর্তা-কর্তৃক অধীনস্তদের পর্যবেক্ষণ ও সুনাম-সুখ্যাতি অর্জনের পেছনে দৌড়ানোর স্থলে আল্লাহর মুরাকাবা (নজরদারি) প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে দেশ-জাতি অগ্রসর ও উন্নত হবে। উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি বৃদ্ধি পাবে।

আজকের সমাজে ফ্যাসাদ ও বিশৃঙ্খলার মূল কারণ হচ্ছে, ইতকান ফিল আমল (কর্মে নিপুণতা) ও ইহসান প্রতিষ্ঠায় দুর্বলতা। একজন মুসলিমের দৈনন্দিন জীবনে ইবাদত-বন্দেগি, সালাতসহ উঠতে-বসতে ও কর্মক্ষেত্রে যখন ইহসান সঙ্গী হবে, তখন তা তাকে একজন সত্যবাদী, বিশ্বস্ত, কর্মকুশল ও পেশায় দক্ষ করে গড়ে তুলবে। তার ধন-সম্পদ, সুস্থতা ও সন্তানাদিতে বরকতপ্রাপ্ত হবে। আল্লাহর হেফাজত তাকে বেষ্টন করে রাখবে। তাঁর রহমত ও ভালোবাসা তাকে আচ্ছাদিত করে রাখবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা ইহসান প্রদর্শন কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইহসান প্রদর্শনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা: ১৯৫)

আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ মুহসিনদের (সৎকর্মপরায়ণ, অনুগ্রহশীল) সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনকাবুত : ৬৯) আরেক জায়গায় বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর করুণা মুহসিনদের নিকটবর্তী।’ (সুরা আরাফ: ৫৬)

ইহসানকারীর প্রতি (প্রতিদানস্বরূপ) আল্লাহর ইহসানের অসংখ্য দৃষ্টান্তে কোরআন ভরপুর। ইবরাহিম (আ.) স্বীয় পিতার প্রতি উপদেশপ্রদানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ইহসান প্রদর্শন করেছেন। ফলে আল্লাহ তায়ালা তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও ‘ইহসান’ নিহিত রেখেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি এই কিতাবে ইবরাহিমের কথা বর্ণনা করুন। নিশ্চয় তিনি ছিলেন সত্যবাদী, নবী। যখন তিনি তার পিতাকে বললেন, হে আমার পিতা, যে শোনে না ও দেখে না এবং তোমার কোনো উপকারে আসে না, তার ইবাদত কেন কর?’ (সুরা মারয়াম: ৪১-৪২)

প্রত্যেক নসিহতের শুরু তিনি ইয়া আবাতি (হে আমার পিতা!) বলে সম্বোধন করতেন— যা (মুশরিক পিতার প্রতি) ভদ্রতা, হূদ্যতা ও নম্র্রতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহ তাআলা তাকে সম্মানিত করলেন আপন সন্তানদের সৎ ব্যবহার উপহার দিয়ে। যখন তাকে আপন সন্তান জবেহ করতে নির্দেশ দিলেন, তখন সন্তান (ইসমাঈল আ.) আল্লাহর নির্দেশ ও পিতার আনুগত্যে এই বলে আত্মসমর্পন করলেন, ‘হে আমার পিতা! আপনাকে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা পালন করুন। আল্লাহ চাইলে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন।’ (সুরা সাফফাত: ১০২)

সংযম ও আমানতদারি রক্ষা করে ইউসুফ (আ.) রূপ-সৌন্দর্যের নেয়ামতের যথাযথ শোকর আদায় করে ইহসান প্রদর্শন করেছেন। ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে নবুওয়াত, নেতৃত্ব ও উচ্চমর্যাদা দান করে তার প্রতি ইহসান করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর সে যে মহিলার ঘরে ছিল, ওই মহিলা তাকে ফুসলাতে লাগল এবং দরজাসমূহ বন্ধ করে দিল। সে মহিলা বলল, ‘এদিকে আসো।’ সে বলল, ‘আমি আল্লাহর আশ্রয় নিচ্ছি। তিনি আমার রব, তিনি আমার থাকার ব্যবস্থা কত উত্তম করেছেন, জালিমরা কখনো সাফল্য লাভ করতে পারে না।’ (সুরা ইউসুফ: ২৩)

আল্লাহ তাকে হেফাজত ও মর্যাদা দান করে ইহসান করলেন এবং তাকে মুহসিনদের অন্তর্ভুক্ত গুণে বিশেষিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এভাবে আমি ইউসুফকে সে দেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম। দেশের যেখানে ইচ্ছে সে নিজের স্থান করে নিতে পারত, আমি যাকে চাই আমার রহমত দিয়ে ধন্য করি, আমি সৎ কর্মশীলদের কর্মফল কখনো বিনষ্ট করি না।’ (সুরা ইউসুফ : ৫৬)

আল্লাহর নবী আইয়ুব (আ.) বিপদাপদে দীর্ঘ সবর করেছেন। ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে অফুরন্ত নেয়ামত দিয়ে ইহসান করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি তাকে সবরকারী পেয়েছি। চমৎকার বান্দা সে। নিশ্চয় সে ছিল (আল্লাহর দিকে) প্রত্যাবর্তনকারী।’ (সুরা সোয়াদ : ৪৪)

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আমি তার আহ্বানে সাড়া দিলাম এবং তার দুঃখকষ্ট দূর করে দিলাম এবং তার পরিবারবর্গ ফিরিয়ে দিলাম। আর তাদের সঙ্গে তাদের সমপরিমাণ আরো দিলাম আমার পক্ষ থেকে কৃপাবশত। আর এটা ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশস্বরূপ।’ (সুরা আম্বিয়া : ৮৪)

আমাদের রাসুল (সা.)-এর কাছে যখন জিবরাইল (আ.) ওহি নিয়ে আসলেন, তখন তিনি (ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে) স্ত্রী খাদিজা (রা.)-কে বললেন, ‘আমি নিজের আত্মার প্রতি আশঙ্কা করছি।’ তখন খাদিজা (রা.) বললেন, আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। ‘আল্লাহর কসম! তিনি কখনো আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আল্লাহর কসম! আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, সত্য কথা বলেন, অনাথ-দুর্বলের ভরণপোষণ করেন, গরিবের জন্য উপার্জন করেন, অতিথিকে আপ্যায়ন করেন এবং দুর্যোগ কবলিতদের সাহায্য করেন।’ (মুসলিম)

সুতরাং আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করবেন না যে সততা ও কল্যাণকর কাজ দিয়ে তার সমাজ, দেশ ও জাতির প্রতি ইহসান করে। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নবীজি (সা.)-কে সাহচর্য প্রদান ও সত্যায়ন করে ইহসান করেছেন। ফলস্বরূপ আল্লাহ তাআলা তাকে খাতামুল আম্বিয়ার বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করলেন। তার উম্মতে খলিফা বানালেন। রাসুল (সা.) আবু বকর (রা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে বলেন, মানুষের মধ্যে আমার প্রতি ধন-সম্পদ ও সাহচর্য দিয়ে অনুগ্রহকারীদের মধ্যে আবু বকর সর্বাগ্রে। যদি আমি উম্মতের কাউকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করতাম তাহলে আবুবকরকে গ্রহণ করতাম। তবে ইসলামের বন্ধুত্ব সম্প্রীতি রয়েছে। মসজিদে আবু বকরের দরজা ব্যতীত অন্য কারো দরজার খিল যেন খোলা না থাকে। (বুখারি)

জুননুরাইন উসমান (রা.) আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত ধন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান-সদকা করে ইহসান করেছেন। ফলস্বরূপ আল্লাহ তাআলা তার প্রতি অনুগ্রহ করলেন। তাকে অনন্তকাল স্মরণীয় ও সীমাহীন প্রতিদান এবং এমন ধন-সম্পদ দিয়ে যা কখনো শেষ হবে না। রাসুল (সা.) দুইবার বলেছেন, ‘আজকের পর থেকে কোনো আমলই উসমানের ক্ষতি করবে না।’ (তিরমিজি)

আল্লাহর বান্দাগণ! এই নমুনাগুলো প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি স্বীয় কর্মে ইহসান (যথার্থ ও পূর্ণাঙ্গতা) প্রদর্শন করবে, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তাকে তা থেকেও উত্তম ও বড় প্রতিদান দেবেন। তিনি বলেন, ‘যে ভালোভাবে কাজ করে নিশ্চয়ই আমি তার পুরস্কার বিনষ্ট করি না।’ (সুরা কাহাফ: ৩০)

কর্মে ইহসান প্রদর্শন করা মূলত নিজের নফসের প্রতি ইহসান করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা ইহসান করো, তবে নিজেদের প্রতিই ইহসান করবে।’ (সুরা ইসরা: ৭) জনৈক সালাফ বলেন, ‘আমি কারো প্রতি ইহসান বা মন্দ আচরণ করিনি; বরং (প্রকৃতপক্ষে) আমার নিজের নফসের প্রতিই ইহসান বা মন্দ আচরণ করেছি।’

একজন মুসলিমের মনে রাখা উচিত, ইহসান (অনুগ্রহপ্রদর্শন) প্রদর্শন মূলত তার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের পরিশোধকরণ। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি ইহসান (অনুগ্রহ) কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি ইহসান (অনুগ্রহ) করেছেন।’ (সুরা কাসাস: ৭৭) সুতরাং আল্লাহ তাআলা যাকে ধন-সম্পদ, মান-সম্মান বা ইলমে প্রশস্ততা দান করেছেন, তার উচিত সেগুলো সঠিক পথে ব্যয় করে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা।

১৭ রজব ১৪৪৩ হিজরি (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২) মসজিদে নববিতে দেয়া জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত

অনুবাদ— মুশাহিদ দেওয়ান

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ