গিবত আরবি শব্দ। আভিধানিক অর্থ পরনিন্দা করা, কুৎসা রটানো, পেছনে সমালোচনা করা, দোষারোপ করা, কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ অন্যের সামনে তুলে ধরা ইত্যাদি। ইবনে আসির (রহ.) বলেন, ‘গিবত হলো কোনো মানুষের এমন বিষয় যা তার অনুপস্থিতিতে উল্লেখ করা— ব্যক্তি শুনলে অপছন্দ করে, যদিও তা তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘গিবত হলো তোমার ভাইয়ের এমন আচরণ বর্ণনা করা, যা সে খারাপ জানে।’
গিবত হারাম ও কবিরা গুনাহ
গিবত মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। অনেকেই গিবতকে পাপ বা নিষিদ্ধ মনে করে না। অথচ মদ্যপান, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার ইত্যাদি থেকেও মারাত্মক ও নিকৃষ্টতম পাপ ও কবিরা গুনাহ হলো গিবত। অন্যান্য পাপ তওবা দ্বারা মাফ হয়; কিন্তু গিবতকারীর পাপ শুধু তওবা দ্বারা মাফ হয় না— যার গিবত করা হয়েছে, সে ব্যক্তি যদি মাফ করে— তবেই আল্লাহর কাছে মাফ পাওয়া যেতে পারে। একটি কবিরা গুনাহই কাউকে জাহান্নামে নেয়ার জন্য যথেষ্ট।
আমি দেখেছি, দু’জন মিলে ৩য় আরেকজনের গিবত করছে। তাদের সমালোচনার মাঝখানে ৩য় ব্যক্তি উপস্থিত হলে সঙ্গে সঙ্গে তারা দু’জন অন্য আরেকজনের প্রসঙ্গে সমালোচনা শুরু করে এবং সেই তৃতীয় ব্যক্তিও তাদের সঙ্গে সমালোচনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
যেখানেই আড্ডা সেখানে প্রায়ই গিবতের ছড়াছড়ি থাকে। অন্যের সমালোচনা ছাড়া যেন আড্ডা জমে না। অথচ গিবত শুধু পাপই বয়ে আনে। ব্যক্তির জন্য নিয়ে আসে অকল্যাণ ও জাহান্নামের বার্তা। সামাজিকভাবে গিবত সমাজের মধ্যে ফেতনা ও অশান্তির সৃষ্টি করে। ইসলামি শরিয়তের বিধান অনুযায়ী গিবত সংশ্লিষ্ট সব অপরাধ কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত— যা মূলত হারাম। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কি জান গিবত কাকে বলে? সাহাবিরা বললেন, আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) ভালো জানেন। তিনি বলেন, তোমার কোনো ভাই (দ্বীনি) সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তাই গিবত। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমি যে দোষের কথা বলি সেটা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে তাহলেও কি গিবত হবে? উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, তুমি যে দোষের কথা বলো, তা যদি তোমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে তবে তুমি অবশ্যই গিবত করলে আর তুমি যা বলছ তা যদি তার মধ্যে না থাকে তবে তুমি তার ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছ। (মুসলিম)
গিবত বিরক্তি ও ঘৃণা সৃষ্টি
গিবত চার পাশের লোকের মধ্যে ঘৃণা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করে। অন্যের প্রতি আস্থা নষ্ট করে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিন্ন করে। কোরআনে গিবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক ধারণা হতে বিরত থাক। কতক ধারণা পাপের অন্তর্ভুক্ত। তোমরা অন্যের দোষ খোঁজাখুঁজি করো না, একে অন্যের অনুপস্থিতিতে দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো সেটাকে ঘৃণাই করে থাক। আল্লাহকে ভয় কর, তিনি অতি দয়ালু।’ (সুরা হুজুরাত: ১২)
হাদিসে গিবতের শাস্তির ভয়াবহতার কথা এভাবে এসেছে— আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন আমাকে মিরাজে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন আমাকে তামার নখবিশিষ্ট একদল লোকের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তারা তাদের নখগুলো দিয়ে স্বীয় মুখমণ্ডলে ও বক্ষদেশে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাইল! এরা কারা? জিবরাইল (আ.) বললেন, এরা দুনিয়াতে মানুষের গোশত ভক্ষণ করত এবং তাদের মানসম্মান নষ্ট করত। অর্থাৎ তারা মানুষের গিবত ও চোগলখোরি করত।’ (আবু দাউদ: ৪৮৭৮ )
গিবত বা পরনিন্দা ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্যতম গুনাহ। গিবত মানুষের ঈমান ও আমল ধ্বংস করে দেয়। পার্থিব ও অপার্থিব কল্যাণ দূর করে দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেকের যে সামনে নিন্দাকারী ও পেছনে গিবতকারী।’ (সুরা হুমাজাহ: ১)
মানুষের গিবত করা থেকে বিরত থাকা উচিত । অন্যথায়, গিবত করার কারণে তাকে ভয়ংকর পরিণতির শিকার হতে হবে।
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ