আমাদের জীবন চলার পথে শয়তানের প্ররোচনায় ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অনেক গুনাহ সংঘটিত হয়ে যায়। এর মধ্যে কিছু বড় গুনাহ থাকে, যা তওবা ছাড়া মাফ হয় না। কিছু গুনাহ এমন রয়েছে, যা আল্লাহ তাআলা তওবা-ইস্তিগফার ছাড়া বান্দার নেক আমলের মাধ্যমে মাফ করে দেন। ইসলামে এমন কিছু ‘আমল রয়েছে যেগুলোর কোনো একটি যিনি করবেন তার পূর্বের জীবনের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
কেউ যদি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দেখানো পদ্ধতিতে উযূ করে তার পূর্বের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে। একদিন তৃতীয় খলীফা ‘উসমান বিন ‘আফ্ফান উযূ করার পর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে আমার এই উযূর মত উযূ করতে দেখলাম। অতঃপর তিনি বললেন,
مَنْ تَوَضَّأَ هَكَذَا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه وَكَانَتْ صَلَاتُه وَمَشْيُه إِلَى الْمَسْجِدِ نَافِلَةً
‘‘যে ব্যক্তি এরূপ উযূ করবে, তার পূর্বের পাপরাশি মাফ করা হবে এবং তার সলাত ও মাসজিদের দিকে চলার সাওয়াব অতিরিক্ত হিসেবে গণ্য হবে।’’[1]
গুনাহ মাফের ফজিলতপূর্ণ আমল নিয়ে আজকের এই লেখা।
প্রতিদিন ১০০ বার সুবহানাল্লাহ পড়া
একবার নবীজি তাঁর প্রিয় সাহাবাদের বলেন, তোমরা কি প্রতিদিন এক হাজার নেকি লাভ এবং এক হাজার গুনাহ মাফ হওয়ার আমল জানতে চাও? তখন এক সাহাবি বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! কী আমল করলে এক হাজার গুনাহ মাফ এবং এক হাজার নেকি লাভ করা যাবে? তখন নবী (সা.) বলেন, ‘১০০ বার সুবহানাল্লাহ বললে এক হাজার নেকি লেখা হবে অথবা (কোনো কোনো বর্ণনা মতে) এক হাজার গুনাহ মোচন হবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৬৯৮)
নবীর ভালোবাসা
আল্লাহকে ভালোবাসার জন্য রাসুল (সা.)-এর পথ অনুসরণ করা আবশ্যক। আর এই অনুসরণের মাধ্যমেই আল্লাহ ও তাঁর নবীর ভালোবাসা পাওয়ার পাশাপাশি গুনাহ মাফের সুযোগ পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার (নবীর) অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ মার্জনা করবেন।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৩১)
নবীর ওপর দরুদ পাঠ করা
আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার প্রতি ১০টি রহমত নাজিল করবেন। তার ১০টি গুনাহ মাফ করে দেবেন এবং ১০টি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন।’ (নাসায়ি, হাদিস : ১২৯৭)
ফজর ও মাগরিব নামাজের পর নির্দিষ্ট দোয়া
এক হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ফজর ও মাগরিব নামাজের পর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শায়ইন কাদির’ ১০ বার পড়বে, এর বিনিময়ে তার আমলনামায় চারজন গোলাম আজাদ করার সওয়াব লেখা হবে, ১০ নেকি লেখা হবে, ১০ গুনাহ মাফ হবে, ১০ মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং এ কলেমাগুলো সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য শয়তান থেকে হেফাজতের কারণ হবে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৩৫১৮)
উত্তমরূপে অজু করা
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো মুসলিম অজু করে তখন তার চেহারা ধোয়ার সময় পানির ফোঁটার সঙ্গে চোখের গুনাহগুলো ধুয়ে যায়। যখন হাত ধোয়া হয়, হাতের গুনাহগুলো ধুয়ে যায়। যখন পা ধোয়া হয়, পানির ফোঁটার সঙ্গে পায়ের দ্বারা কৃত গুনাহগুলো ধুয়ে যায়। এভাবে বান্দা গুনাহ থেকে একেবারে পাক-সাফ হয়ে যায়।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৪৪)
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা
যে ব্যক্তি যথাসময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে তার গুনাহ মাফের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) হাদিস শরিফে চমৎকার একটি উদাহরণ তুলে ধরেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার সাহাবাদের সম্বোধন করে বলেন, ‘তোমাদের কী মনে হয়? কারো বাড়ির পাশে যদি নদী থাকে আর সে তাতে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে, তার শরীরে কি কোনো ময়লা থাকবে?’ সাহাবারা জবাবে বলেন, না, তার শরীরে কোনো ময়লা অবশিষ্ট থাকবে না। নবী (সা.) তখন বলেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের দৃষ্টান্তও এরূপ। এর মাধ্যমে আল্লাহ (বান্দার) পাপসমূহ মিটিয়ে দেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৬৭)
জুমার নামাজ আদায় করা
আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করল ও জুমায় এলো, এরপর মনোযোগসহ খুতবা শুনল ও চুপ থাকল। আল্লাহ তাআলা তার গত জুমা ও এই জুমার মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহ মাফ করে দেবেন; আরো অতিরিক্ত তিন দিনের গুনাহও মাফ করবেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ৮৫৭)
নামাজের জন্য মসজিদে গমন
জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়লে প্রতি কদমের বিনিময়ে গুনাহ মাফ ও মর্যাদা বৃদ্ধির ঘোষণা এসেছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জামাতের নামাজ ঘরের বা বাজারের নামাজ অপেক্ষা ২৫ গুণ বেশি সওয়াব রাখে। কারণ বান্দা যখন উত্তমরূপে অজু করে এবং একমাত্র নামাজের উদ্দেশ্যেই ঘর থেকে বের হয় তো প্রতিটি কদমের বিনিময়ে আল্লাহ তার একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং একটি করে গুনাহ মিটিয়ে দেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪৭)
ফাতিহা শেষে আমিন বলা
বুখারির বর্ণনায় এসেছে, নবী (সা.) বলেছেন, ‘নামাজে ইমাম সাহেব যখন সুরা ফাতিহা শেষ করে তখন তোমরাও আমিন বলো। কেননা তখন ফেরেশতারাও আমিন বলে। ইমামও আমিন বলে। আর যার আমিন বলা ফেরেশতাদের আমিন বলার সঙ্গে মিলবে, তার আগের সব পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৭১৮৭)
রুকু থেকে উঠে ‘রব্বানা লাকাল হামদ’ বলা
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “ইমাম যখন রুকু থেকে উঠে বলে ‘সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ’ তখন তোমরা বলো ‘আল্লাহুম্মা রব্বানা লাকাল হামদ’। কারণ যার তাহমিদ ফেরেশতাদের সঙ্গে মিলবে, তার আগের সব পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।” (বুখারি, হাদিস : ৭৯৬)
লাইলাতুল কদরের সলাত আদায় করা
লাইলাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদরে বেশি বেশি নফল সলাত আদায় করলে পূর্বের জীবনের সমস্ত পাপ মাফ করে দেয়া হয়। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়।’’[6]
উল্লেখ্য যে, নির্দিষ্ট করে প্রতিবছর ২৭ রমাযানের রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে নির্ধারণ করার কোন নিশ্চিত ভিত্তি নেই। ২৭ তারিখও হতে পারে আবার ২১, ২৩, ২৫ বা ২৯ রমাযানের রাতও কদরের রাত হতে পারে। তাইতো রাসূলুল্লাহ (সা.) রমাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করতে আদেশ দিয়েছেন। ‘আয়িশাহ্ কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেছেন,
تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنْ الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ
‘‘তোমরা রমাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’’[7]
নয়া শতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ