ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ওয়াজ মাহফিল আমাদের ঐতিহ্যের অংশ

প্রকাশনার সময়: ২৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৪৬

ওয়াজ মাহফিল এদেশের গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের অংশ। আবহমান কাল ধরে বাঙালি মুসলিম সমাজে এটি প্রচলিত। আর কোরআন কারিমের ৭৭টি নামের এক নাম হলো ‘ওয়াজ’ বা উপদেশ। মহান আল্লাহ হলেন প্রথম ওয়ায়েজ বা ওয়াজকারী। প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) হলেন দ্বিতীয় ওয়ায়েজ। এই সূত্রে নবী করিম (সা.)-এর উত্তরাধিকারীরা ওয়ায়েজিন। এই উম্মতের দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করবেন ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া তথা নবীদের উত্তরাধিকারী উলামায়ে কিরাম। আর উলামায়ে কিরামের দায়িত্ব হলো এই দাওয়াতি কাজ কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত রাখা।

ওয়াজ, নসিহত, বয়ান, খুতবা, তাফসির ইত্যাদি দাওয়াতের প্রচলিত মাধ্যম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’ (সুরা নাহল: ১২৫)।

দাওয়াতি আলোচনার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। যেমন ওয়াজ, নসিহত, বয়ান, খুতবা, তাফসির ইত্যাদি। ‘ওয়াজ’ হলো সুন্দর, আকর্ষণীয়, যুক্তিপূর্ণ ও হূদয়স্পর্শী আবেদনময় আলোচনা। আর দেশ-বিদেশের সমকালীন খ্যাতিসম্পন্ন ওলামায়ে কেরাম তাতে উপস্থিত থেকে কোরআন হাদিসের আলোকে সারগর্ভ নসিহত পেশ করতেন। মুসলমানদের ইমান-আকাইদ ও আমলি সংশোধন, আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং যুগসচেতন হওয়ার আহ্বান করতেন। তৎকালীন ওলামা ও বুজুর্গানে দ্বীনদের কাছে ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতের কোনো ঘাটতি ছিল না।

বর্তমানে সামাজিক সংগঠন, ব্যক্তি উদ্যোগের আয়োজিত মাহফিলের ইতিবাচক ফায়েদা কিন্তু একেবারে কম নয়। মদ-জুয়া, যাত্রা, নর্তকী ও গানের কনসার্টের বিপরীতে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন সত্যিই খুব প্রশসংসার দাবি রাখে। তবে মাহফিলগুলো যাতে করে রেওয়াজ ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে না হয় সেদিকে অবশ্য খেয়াল রাখতে হবে। বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। ইলম ও আমলওয়ালা ওলামা ও বুজুর্গানে কেরামগণকে মাহফিলে দাওয়াতের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

শুধু সুন্দর সুর-কণ্ঠ, মাঠ কাঁপানো ও কন্টাক্টওয়ালা বক্তাদের দিয়ে আজীবন ওয়াজ করালেও একজন মানুষেরও হেদায়াত হবে না। অযথা টাকা খরচ ও সময় নষ্ট এবং বিনোদন বৈকি।

একথা স্বীকার করতে বাধ্য, আমাদের বর্তমানের মাহফিলগুলো আগের মতো সেই প্রভাবময় নয়। আগে বক্তাদের যেরকম ইলম ছিল, ছিল সেরকম আমলও। ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতেরও কোনো ঘাটতি ছিল না। আর আজ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এখনকার ওয়াজ মাহফিলগুলোতে বিশেষ অপচয়। শ্রোতাদের নিবেদন রক্ষার্থে বেশিরভাগ মাহফিলগুলোতে কন্টাক্টওয়ালা বক্তাদের আমন্ত্রণ। আসলে এটা সমাজেরই দোষ। সমাজ যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তেমনি মানুষের ভেতরের খুলুছিয়ত ও লিল্লাহিতের ঘাটতি হ্রাস পাচ্ছে।

ওয়াজের উদ্দেশ্য কি হবে, ওয়াজ কি ও কেন এটা অনেকেরই অজানা। হাদিসের আলোকে বলা যায় যে, ওয়াজের উদ্দেশ্য হবে মানুষকে ইহ-পরকালীন কল্যাণের পথনির্দেশ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করা। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ শুধুই ওই আমল কবুল করেন, যা তার সন্তুষ্টির জন্য করা হয়।’ (বাইহাকি)

আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ভাষার প্রাঞ্জলতা শিখে মানুষের অন্তরকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার কোনো ফরজ ও নফল ইবাদতসমূহকে কবুল করবেন না’। (মিশকাত : ৪১০)

ইমাম গাজালি (রহ.) তার লিখিত গ্রন্থ ‘আইয়্যুহাল ওয়ালাদ’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ওয়াজকারীদের ওয়াজ দ্বারা উদ্দেশ্য যেন হয় মানুষকে দুনিয়া হতে আখেরাতের প্রতি, গোনাহ থেকে নেকির প্রতি, লোভ থেকে পরিতুষ্টির প্রতি আহ্বান করা। এরইভিত্তিতে বক্তাগণ শ্রোতাদেরকে পরকালীনমুখী ও দুনিয়াবিমুখ করে গড়ে তোলার প্রয়াস করা। ইবাদত-বন্দেগি ও তাকওয়ার দীক্ষা দান করা। সর্বোপরি আত্মিক অবস্থা পরিবর্তনের সাধনা করা। এটাই হলো প্রকৃত ওয়াজ। আর যে বক্তা এরূপ উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে ওয়াজ করবে তার ওয়াজ মানুষের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। দ্বীনদার মুসলমানগণ যেন এ রকম বক্তা ও ওয়াজ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে। (মাজালিসূল আবরার: ৪৮২)

বক্তাদের জন্য পাঁচটি জিনিস অত্যাবশ্যক : সেগুলো হলো : ১. ইলম, কেননা ইলমহীন ব্যক্তি সঠিক ও বিশুদ্ধ বয়ান করতে অক্ষম। ২. আল্লাহর সন্তুষ্ট ও তার দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্য। ৩. যা বয়ান করবেন তা আমল করা। ৪. বক্তা শ্রোতাদের ওপর দয়ার্দ্র ও বিনম্র হয়ে কথা বলা। ৫. বক্তা ধৈর্যশীল ও সহনশীল হওয়া। (ফাতওয়ায়ে আলমগীরি ৪/১১০)

ওয়াজকারী ব্যক্তির জন্য দুটি গুণ থাকা অপরিহার্য। যদি দুই গুণ না থাকে তাহলে মানুষের হেদায়াত হবে না। কোরআনুল কারিমে আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘তোমরা তাদেরকে অনুসরণ কর যারা দ্বীনি বিষয়ে কোনো পারিশ্রমিক চায় না এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত’। (সুরা ইয়াসিন: ২১)

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে জানা গেল, আল্লাহর সন্তুষ্ট, দ্বীনের দাওয়াত ও মানুষের হেদায়াতকে লক্ষ্য না বানিয়ে যতই ওয়াজ হোক তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে না এবং তা দ্বারা মানুষের কোনো উপকারও সাধিত হয় না। অর্থ কড়ি, জশ-খ্যাতি ও দুনিয়াবি কোনো স্বার্থ হাসিলের জন্য যারা ওয়াজ করে বা ওয়াজের আয়োজন করে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

পরিশেষে, ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজকদের কাছে আরো প্রত্যাশা থাকবে, ওয়াজ মাহফিলে কোরআন-হাদিসভিত্তিক আলোচনার জন্য বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ আলেম নির্বাচন করবেন। তাহলে জাতি আরো বেশি উপকৃত হবে এবং ওয়াজ মাহফিলের উদ্দেশ্য হাসিল হবে। বস্তুত এমন ওয়াজের মাধ্যমে পরকালে নাজাতের আশা করা যায়।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ