আঠারোতে পা দিতেই বিয়ে হয় নাটোরের সিংগাইর উপজেলার বাস্তা গ্রামের মেয়ে আঁখি আক্তারের। বর একই উপজেলার ভূমদক্ষিণ গ্রামের ছেলে মান্নান বিশ্বাস। বিয়ের পর থেকেই স্বামী ও তার পরিবার পাঁচ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে আসছিল আঁখির পরিবারের কাছে। কিন্তু দেয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। এ নিয়ে প্রায়ই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া লেগে থাকত। যৌতুককে কেন্দ্র করেই একদিন আঁখিকে মারধর করেন স্বামী। মেয়েকে মারধরের খবর পেয়ে আঁখিকে দেখতে আসেন মা। তখন মাকে অপমান করেন আঁখির শাশুড়ি-দেবরসহ সবাই।
মায়ের অপমান সহ্য করতে না পেরে এবং যৌতুকের কারণে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওই দিন রাতেই বাথরুমে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন আঁখি। এভাবেই বিয়ের মাত্র তিন বছরের মাথায় যৌতুকের বলি হন আঁখি। (সূত্র: ২৪ মে, ২০১৬ ভোরের কাগজ)
যৌতুক আদায় করতে স্বামীরা নানা উপায় অবলম্বন করছে। কেউ স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করছে, কেউবা করছে মানসিক নির্যাতন। আর না পেলেই তাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। রংপুরের পীরগাছায় গৃহবধূ তহমিনা খাতুনের (৩২) গায়ে জ্বলন্ত কুপি ছুড়ে মারেন স্বামী ও শাশুড়ি। এতে তার গায়ে আগুন ধরে শরীরের ৫০ শতাংশ পুড়ে যায়। বিয়ের ১৩ বছর পর এই ঘটনা ঘটে। এর আগে তাকে মেরে হাত-পা ভেঙে দেয়া হয়েছিল। চড়-থাপ্পড়ে একটি কানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবুও দুই মেয়ের কথা ভেবে সংসার করে যাচ্ছেন তিনি। (সূত্র: ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ প্রথম আলো)
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় যৌতুক চেয়ে না পেয়ে স্ত্রীর শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় স্বামী। পেট্রল ঢেলে আগুন দেয়ার পর শ্বশুরকে ফোন করে। এ সময় সে মুঠোফোনে বলে, ‘তোর মেয়েকে পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছি, এসে নিয়ে যা।’ (সূত্র: ২০ নভেম্বর, ২০২০ প্রথম আলো)প্রথম আলোর অনুসন্ধানে ঢাকার আদালতের বিচারিক নিবন্ধন খাতার ১৭ বছরের হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় ৩৭৪ জন নারীকে যৌতুকের জন্য হত্যা করা হয়েছে। প্রতি বছর কেবল ঢাকায়-ই যৌতুকের জন্য গড়ে ২২ নারীকে হত্যা করা হচ্ছে।
যৌতুকের দাবি পূরণ করতে না পারায় এভাবেই ভেঙে যায় হাজারো সংসার। ঝরে যায় অসংখ্য প্রাণ। যৌতুকের এই নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব জীবন কাটাচ্ছেন অসংখ্য মা-বোন। কেটে ফেলা হয়েছে কারো কান, উপড়ে ফেলা হয়েছে কারো চোখ, আগুনে ঝলসে দেয়া হয়েছে কারো শরীর, ভেঙে ফেলা হয়েছে কারো হাত-পা, এসিড মেরে ঝলসে দেয়া হয়েছে কারো মুখ। সামাজিক এই জঘন্য প্রথার আবর্তে শুধু অসহায় মেয়েরাই বিপন্ন অবস্থার শিকার হয় তা নয়; কন্যা দায়গ্রস্থ অসহায় পিতা-মাতারাও এই নির্মম সংস্কৃতির বলি হয়।
যৌতুকের এই অভিশাপ কেবল আমাদের দেশে নয়। বরং পুরো উপ-মহাদেশজুড়ে বিস্তৃত। অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান। মেয়েপক্ষের ওপর চাপিয়ে দিয়ে, যৌতুক দেয়া-নেয়ার প্রচলনের নজির পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে পাওয়া যায় না জানা গেছে।
উপমহাদেশের বৃহত্তর সম্প্রদায়-হিন্দু জনগোষ্ঠীর বৈবাহিক রীতিতে যৌতুকের গুরুত্ব অত্যাধিক। ওই ধর্মে উত্তরাধিকারের সম্পদে মেয়েদের অংশিদারিত্বের স্বীকৃতি নেই। বিয়ের সময়ই মোটামুটিভাবে ‘যা দেয়া যায় ও যা নেয়া যায়’-এ পর্বটি সম্পন্ন করা হয়। এ জন্য যৌতুক তাদের বিবাহপর্বের একটি শক্তিশালী অনুষঙ্গ ও উপলক্ষ হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে এসেছে ও আসছে। এ অঞ্চলে প্রতিবেশী বড় সম্প্র্রদায়টির সংস্কৃতি ও জীবনাচারের প্রভাব মুসলমানদের জীবনে যেমন অন্য বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, তেমনি যৌতুকের ক্ষেত্রেও ওদের প্রচলিত সংস্কৃতি মুসলিম সমাজকে এতটাই আক্রান্ত করেছে যে, আমাদের দেশে যৌতুক ছাড়া বিয়ে খুবই কম হয়। যার ফলে বহু মুসলিম নারীর জীবন আজ অভিশাপের পাকে আটকে যাচ্ছে।
অথচ মুসলিম জীবনে এই বিষয়টির চিত্র হওয়ার কথা সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামের বিধান সেটাই। বিয়ে, বা দাম্পত্যের ক্ষেত্রে ছেলে দেবে, মেয়ে নেবে। যেমন মোহর। মেয়ে কিংবা মেয়েপক্ষের এ ক্ষেত্রে কিছুই দেয়ার কথা নয়। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘নারীদেরকে খুশি মনে তাদের মোহর প্রদান কর’। (সুরা নিসা: ৪)
যৌতুক একটি নিপীড়নমূলক প্রথা। এখানে কনেপক্ষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অন্যায়ভাবে তার পরিবার থেকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা আদায় করা হয়। অথচ আল্লাহতায়ালা কাউকে জুলুম করে সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করে বলেন, ‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)
ইসলাম শুধু যৌতুক প্রথারই বিরোধী নয়, বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে সব ধরনের অপচয়েরও বিপক্ষে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘সেই বিয়েই সর্বাধিক বরকতময়, যে বিয়েতে ব্যয় খুব সামান্যই হয়।’ (মুসনাদে আহমদ: ২৪৫২৯) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে বিয়ে করেছেন সাধারণভাবে, নিজের প্রিয় কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.)-কে বিয়ে দিয়েছেন একইভাবে।
মুসলিম সমাজের একটি বড় অংশ এই যৌতুক প্রথাকে আঁকড়ে থাকার পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে সামাজিক কুপ্রথা, কুসংস্কার। আর্থিক সুবিধা ও স্বার্থ ত্যাগ করা সাধারণভাবে মানুষের জন্য কঠিন। এতে সামাজিক রেওয়াজ ও রেওয়াজগত স্বীকৃতি থাকলে সেটি যেন আরেকটু অধিকারের ছোঁয়া পেয়ে যায়। শুরুতে অন্য সম্প্র্রদায়ের প্রভাবে মুসলিম সমাজে যৌতুক প্রথার অনুপ্রবেশ ঘটলেও এখন আর এতে প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার কিছু নেই। এটা এখন নিজেদের মধ্যেই স্বাভাবিক একটা লেনদেন ও দেনা-পাওনার হিসাবে পরিণত হয়েছে। বরের পরিবার স্বচ্ছল ও বিত্তবান হলেও এখন কনেপক্ষের সঙ্গে দেনা-পাওনা নিয়ে কথা বলেন এবং ব্যবসায়িক লেনদেনের মতো এই দেনা-পাওনার হিসাব বুঝে নেন।
প্রশান্তিদায়িনী মায়াবতী নবপরিণীতা নারী যেন হরেকরকম সম্পদের বাহন, নগদ অর্থ, মোটর সাইকেল, প্রাইভেটকার, ফ্রিজ, সোফাসেট, খাট-পালঙ্ক ইত্যাদি যৌতুক ছাড়া যেন সে মূল্যহীন। অথচ একটি মেয়ে বিয়ের আগে সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশে বেড়ে ওঠে। বিয়ের পরবর্তী সময়ে সে নিজের যাবতীয় চাহিদা উপেক্ষা করে অচেনা একটা জায়গায়, অজানা কিছু মানুষের সঙ্গে নিজের মা-বাবা, ভাই-বোন ও আপনজনদের ছেড়ে এসে জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু করে। যেখানে তাকে আমরণ সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় এবং জীবন ক্ষয় করে তিলেতিলে একটি সংসার গড়ে তুলতে হয়। নারীর এই ত্যাগ ও ক্ষয়ের মূল্য কি কেউ দিতে পারবে?
সামাজিক ও সাম্প্র্রদায়িক প্রভাব ছাড়াও আমাদের সমাজে যৌতুক গ্রহণের অন্য কারণটি হচ্ছে, আল্লাহর প্রতি ভয়হীনতা এবং শরীয়তের বিধানের প্রতি অবজ্ঞা ও উদাসীনতা। নারীর মর্যাদা দান ও নারীর আর্থিক অধিকার সুরক্ষায় ইসলাম যে বিধিবিধান দিয়েছে তার প্রতি সাধারণ পর্যায়ের সম্মানবোধ থাকলেও কোনো বরের পরিবারের পক্ষে যৌতুক গ্রহণ সম্ভব না।
যেহেতু বিয়ে হলো একটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। এতে কন্যাপক্ষ খুশি মনে বরকে বা বরপক্ষকে কিছু দিলে তা যৌতুক হবে না, বরং তা উপহার বা হাদিয়া হিসেবে গণ্য হবে। আর উপহার বা হাদিয়া প্রদান ও গ্রহণ উভয়ই সুন্নত। পারস্পরিক ভালোবাসা-সম্প্র্রীতি বৃদ্ধি এবং হিংসা-বিদ্বেষ দূর করার জন্য নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিয়া আদান-প্রদানের প্রতি উৎসাহিত করে বলেন, ‘তোমরা পরস্পর হাদিয়া আদান-প্রদান কর, তাহলে মহব্বত বৃদ্ধি পাবে।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ : ৫৯৪)
অন্যত্র বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর হাদিয়া বিনিময় কর। কারণ তা অন্তরের হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে’ (মুসনাদে আহমদ: ৯২৫০)
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মেয়ে হজরত ফাতেমার (রা.) বিয়েতে তার সংসারের জন্য একটি সাদা পশমি চাদর, একটি পানির মশক এবং ইযখির ঘাস ভর্তি একিট বালিশ উপহার দিয়েছিলেন’ (নাসায়ি: ৩৩৮৪, ইবনে মাজাহ : ৪১৫২)
তবে কন্যাপক্ষকে কোনো কিছু দিতে বাধ্য করা, চাপ সৃষ্টি করা বা পরিস্থিতি তৈরি করা যৌতুক হিসেবে বিবেচিত যা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কারো ধন-সম্পদ তার পূর্ণ সন্তুষ্টি ব্যতীত বৈধ নয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ২০৬৯৫)।
যৌতুকের মতো সামাজিক ব্যাধিকে সমাজ থেকে নির্মূল করার জন্য আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা উচিত। আর এ জন্য প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা। যৌতুক একটি সামাজিক ও ধর্মীয় অপরাধ এই বোধ সবার মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। সর্বোপরি যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে সরকার যেসব আইন ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে। তবেই আমরা যৌতুকমুক্ত একটি শান্তির সমাজ গড়তে পারব ইনশাআল্লাহ।
লেখক : মুহাদ্দিস ও বিভাগীয় প্রধান আরবি ভাষা, মদিনাতুল উলুম মাহমুদিয়া, নারায়ণগঞ্জ
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ