ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলামে হালাল হারামের মূলনীতি

প্রকাশনার সময়: ১৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:০২

মানবতার ধর্ম ইসলাম মানুষের কল্যাণে জীবিকা অন্বেষণের তাগিদে হালাল পথ দেখিয়েছে। সুস্পষ্ট নীতিনির্ধারণ করেছে। পার্থক্য তুলে ধরেছেন হালাল-হারামের। দিয়েছে কিছু মৌলিক মূলনীতি। কারণ হারাম মানুষের অন্তর, আত্মা ও দেহকে নষ্ট করে। হারাম ভক্ষণকারীর শেষ পরিণতি হয় ভয়াবহ।

হালাল অন্বেষণকারী বেঁচে থাকে মানুষের ভালোবাসায়। পরকালের জীবনে তার জন্য অপেক্ষায় থাকে সুশোভিত জান্নাত। তাই ইসলাম সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে হালাল উপার্জন ও গ্রহণের প্রতি। বর্জন করতে বলে হারামকে।

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ কর। যা হালাল তাই গ্রহণ কর এবং যা হারাম তা বর্জন কর।’ (ইবনে মাজা : ২১৪৪)

হালাল-হারামের নির্ধারক আল্লাহ

এই বিশ্বজগতের সবই আল্লাহর সৃষ্টি। এখানে বিধান চলবে তাঁর। সৃষ্টির ভালো-মন্দ জানেন তিনি। তিনি সব কিছুতে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন। কোন্ বস্তু হালাল আর কোন্ বস্তু হারাম, তা নির্ধারণ করবেন একমাত্র আল্লাহ। কোনো মানুষ হালাল-হারামের নির্ধারক নয়। যুক্তি ও বাকবিতণ্ডা করে কোনো বিষয়কে হালাল বা হারাম করা যাবে না। শরিয়ত যেভাবে হালাল-হারাম নির্ধারণ করেছে, সে নীতির আলোকে পৃথিবী চলবে। শরিয়ত নির্ধারক একমাত্র মহান আল্লাহ। কোরআনে পঠিত হয়েছে, ‘বিধানদাতা একমাত্র আল্লাহ।’ (সুরা আনয়াম : ৫৭)

আল্লাহর নির্ধারিত বিধানে বিশ্বাস

মানুষের পার্থিব জীবনের সব বিধিবিধান নির্ধারণ করেছেন পৃথিবী ও মানুষের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। মানুষের কথা ভেবে তিনি দিয়েছেন মানুষের সার্বিক কল্যাণকর বিধান। মানুষের কল্যাণে সজ্জিত করেছেন জগৎকে। মানুষের হাতে সমর্পিত করেছেন সব সৃষ্টি। তাদেরকে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন সঠিক পদ্ধতি এবং শরিয়তের পথ। বলেছেন, ‘তার বিধানে কোনো পরিবর্তন হয় না।’ যাকে তিনি হারাম করেছেন তা হারাম থাকবে। তেমনি হালালের বিধান। কিন্তু এর বিপরীত মনোভাব পোষণ করা আল্লাহর বিধান অস্বীকারের নামান্তর। হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল মনে করা শিরকতুল্য অপরাধ। আল্লাহ শিরকের গুনাহ মাফ করেন না। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শরিক করাকে ক্ষমা করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যার জন্য তিনি চান। আর যে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে সে অবশ্যই মহাপাপ রচনা করে।’ (সুরা নিসা : ৪৮)

অবৈধতার প্রমাণ না থাকলেই বৈধ

পৃথিবীর বুকে যাবতীয় সৃষ্টিজীব ও সৃষ্টবস্তু সবই মূলগতভাবে বৈধ, যদি অবৈধতার কোনো প্রমাণ না থাকে। কারণ সৃষ্টিজগতের সব কিছুর সূচনা ও নির্মাণ হয় বৈধতার ওপর। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো সৃষ্টিকে অবৈধ হিসেবে প্রমাণিত না করা যাবে, ততক্ষণ সেটা বৈধ থাকবে। কেননা মৌলিকভাবে সব কিছুই বৈধ। ইমাম সুয়ুতি বলেন, ‘বস্তুর ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো সেটা বৈধ।’ (আল আশবাহ লিস সুয়ুতি: ১৩৩)

হারামের কারণ অপবিত্রতা

মৌলিকভাবে সব কিছু বৈধতার সুতোয় বাঁধা। প্রত্যেকটা বস্তুর আবির্ভাব হয় বৈধতার ওপর। তবে একটি বৈধ বস্তু কখনো কোনো পারিপার্শ্বিকতার কারণে অবৈধ হয়ে যায়। হারাম হয়ে যায় বস্তুর ক্ষতি ও অপবিত্রতার লক্ষণ থাকলে। যেমন কুকুর একটি অপবিত্র প্রাণী এবং তার গোশ্ত মানবজাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সুতরাং কুকুর হারাম। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জীব, রক্ত, শুকরের মাংস, যেসব জন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গকৃত হয়, যা কণ্ঠারোধে মারা যায়, যা আঘাত লেগে মারা যায়, যা উচ্চস্থান থেকে পতনের ফলে মারা যায়, যা শিংয়ের আঘাতে মারা যায় এবং যাকে হিংস্র জন্তু ভক্ষণ করেছে, কিন্তু যাকে তোমরা জবাই কর তাছাড়া। আর যে জন্তু যজ্ঞবেদীতে জবাই করা হয় এবং যা ভাগ্য নির্ধারক শর দারা বণ্টন করা হয় তা গুনাহ!’ (সুরা মায়েদা: ০৩)

হালাল পর্যাপ্ত হারাম অতিরিক্ত

হালাল-হারামে ভরপুর দুনিয়া। আমাদের চারপাশে বিরাজ করছে হালাল ও হারাম। সমাজে ছড়ানো আছে হালাল-হারামের হাজারো আয়োজন। তবে হালালের তুলনায় হারামের আসবাব ও সরঞ্জাম বেশি। হালালের ক্ষেত্র হলো ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প-কারখানা ও পেশাগত ক্ষেত্র ইত্যাদি। আর হারামের ক্ষেত্র হলো, মাদকদ্রব্যের ব্যবসা, সুদের ব্যবসা, অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ কুক্ষিগত করা, যেমন ঘুষ, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি। অনুরূপভাবে ভাস্কর্য নির্মাণ, প্রাণীর চিত্রাঙ্কন হারাম জিনিসের উৎপাদন ও বিপণন, পতিতাবৃত্তি, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি, ধোঁকাবাজি, জুয়া, লটারি, ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়, অনিশ্চয়তার ব্যবসা, নিজের অধিকারভুক্ত নয় এমন সম্পদ বিক্রি, পরিমাণ ও পরিমাপে কম দেয়া, অবৈধ মজুদদারি, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মূল্য বাড়ানো, মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করা ইত্যাদি।

হারামে উদ্বুদ্ধকারী বস্তুও হারাম

যেসব জিনিস মানুষকে হারামের দিকে টেনে নিয়ে যায়, হারাম কাজ করতে উৎসাহিত করে, তা হারাম। জুয়া মানুষকে হারাম কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। চুরি করতে শেখায়। পরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করতে প্ররোচিত করে। সুতরাং জুয়া হারাম। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! জেনে রাখ, মদ-জুয়া-মূর্তি এবং পাশা খেলা, ফাল গ্রহণ ইত্যাদি অতি অপবিত্র জিনিস ও শয়তানের কাজ। অতএব তোমরা তা পরিত্যাগ কর। তবেই তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে।’ (সুরা মায়েদা : ৯০)

নিয়তের কারণে হারাম কাজ হালাল হয় না

শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা যায় না, তেমনি ভালো নিয়তে হারাম কাজ করলেও হালাল হয় না। চুরি যদি কেউ মসজিদ নির্মাণের জন্য করে তা হলে তার চুরি হালাল বা বৈধ হবে না। যদিও মসজিদ নির্মাণ পুণ্যের কাজ। হারামকে হালাল মনে করা মুশরিক তথা অবিশ্বাসীদের নিদর্শন। আল্লাহ মুশরিকদের আচরণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যা হারাম করেছেন তারা তাকে হারাম গণ্য করে না এবং সত্য দ্বীনকে তাদের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে না।’ (সুরা তওবা : ০১)

সন্দেহপূর্ণ জিনিস পরিত্যাগযোগ্য

কোনো বস্তুর বৈধ-অবৈধতা নিয়ে যদি সন্দেহ থাকে, তা হলে বস্তু পরিত্যাগ করবে। কারণ সন্দেহ মানুষকে হারাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। আর বস্তু যদি হালাল হতো, তা হলে তাতে সন্দেহের কোনো লেশ থাকত না। হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) বলেন, ‘হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। উভয়ের মাঝে বহু অস্পষ্ট বিষয় রয়েছে। যে ব্যক্তি গুনাহের সন্দেহযুক্ত কাজ পরিত্যাগ করে, সে ব্যক্তি যে বিষয়ে গুনাহ হওয়া সুস্পষ্ট, সে বিষয়ে অধিকতর পরিত্যাগকারী হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি গুনাহের সন্দেহযুক্ত কাজ করতে দুঃসাহস করে, সে ব্যক্তির সুস্পষ্ট গুনাহের কাজে পতিত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। গুনাহসমূহ আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা, যে জানোয়ার সংরক্ষিত এলাকার চারপাশে চরতে থাকে, তার ওই সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করার সম্ভাবনা রয়েছে।’ (বুখারি : ২০৫১)

হারাম প্রয়োজনে হালাল

ইসলাম মানবিক ধর্ম। মানুষকে সহজভাবে বেঁচে থাকতে প্রণোদিত করে। প্রয়োজনে হারামও ক্ষণিকের জন্য হালাল হয়ে যেতে পারে। মানুষের জীবন-মরণের প্রয়োজনে সাময়িকভাবে হারামকেও হালাল করেছে ইসলাম। কোনো অসুস্থ ব্যক্তির আরোগ্য যদি মদ ছাড়া অন্য কোনো বস্তু দ্বারা সম্ভব না হয় এবং তার জীবন যদি বিপন্ন হয় তা হলে তার জন্য ইসলাম মদ ভক্ষণ জায়েজ করেছে। (ফতোয়ায়ে শামি : ৯/৪৮৮)

মানুষের জীবনের পূর্ণাঙ্গ সংবিধান ইসলাম মানুষের কল্যাণেই বিধান দিয়েছে। বলে দিয়েছে সহজ-সরল বেঁচে থাকার পথ। ইসলামের বিধান মানতে পারলে জীবন হবে সুন্দর ও সুখময়। দুনিয়াতে এবং আখেরাতে।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ