চন্দ্রগ্রহণকে আরবিতে ‘খুসুফ’ বলা হয়। গ্রহণ লাগলে সূর্য যেমন অন্ধকার ছায়ার আবর্তে পতিত হয়ে অন্ধকার হয়ে যায়, তেমনি চন্দ্রও বছরে দুইবার স্বীয় কক্ষপথে পরিভ্রমণরত অবস্থায় অন্ধকারের ছায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে থাকে। ইহার আংশিক রূপ কখনো দৃশ্যমান হয় আবার কখনো সার্বিক রূপ পরিদৃষ্ট হয়। চন্দ্রের এ কালো রং বা অন্ধকারের হাতছানিকেই চন্দ্রগ্রহণরূপে আখ্যায়িত করা হয়।
কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন দৃষ্টি চমকে যাবে। চন্দ্র জ্যোতিহীন হয়ে যাবে এবং সূর্য ও চন্দ্রকে একত্রিত করা হবে।’ (সুরা কিয়ামাহ : ৭-৯)। উল্লিখিত আয়াতে ‘চন্দ্র জ্যোতিহীন হয়ে পড়া’র বাস্তব রূপই হচ্ছে চন্দ্রগ্রহণ। চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে নবীজি (সা.)-এর নির্দেশনা
জাহেলি যুগে চন্দ্রগ্রহণ কিংবা সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা ছিল। তারা মনে করত দুনিয়ায় বড় বড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী লোকদের কোনো অঘটন ঘটলে এসব হয়। আর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ছেলে ইবরাহিমের মৃত্যুর দিনে সুর্যগ্রহণ হয়। তখন সাহাবায়ে কেরাম তা বলাবলি করছিলেন। তা শুনে বিশ্বনবী (সা.) চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে তাদের সুস্পষ্ট বর্ণনা দেন। হাদিসে এসেছে
হ মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে দুটি নিদর্শন। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হয় না। কাজেই যখন তোমরা তা দেখবে তখন
১. তোমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করবে।
২. তার মহত্ত্ব ঘোষণা করবে আর
৩. নামাজ আদায় করবে এবং
৪. সাদকা প্রদান করবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
হ আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর কুদরত (ক্ষমতার) বিশেষ নিদর্শন। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে সূর্যগ্রহণ হয় না। অতঃপর যখন তোমরা চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ দেখতে পাও তখন
১. তাকবির (আল্লাহু আকবার) বল;
২. আল্লাহর কাছে দোয়া কর;
৩. নামাজ আদায় কর এবং
৪. দান-সাদকা কর।’ (মুসলিম)
হাদিসের নির্দেশনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, চন্দ্র ও সূর্য মহান আল্লাহতায়ালার নিদর্শনসমূহের মধ্যে দুটি নিদর্শন। আর তাতে গ্রহণ লাগা আল্লাহতায়ালার হুকুমেই হয়। তাদের নিজস্ব কোনো শক্তি বা ক্ষমতা নেই। আল্লাহতায়ালার হুকুমের অধীনেই তাদের চলাচল এবং কার্যক্রম।
তাতে গ্রহণ লাগলে মুমিন মুসলমানের করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সুতরাং চন্দ্রগ্রহণের এ সময়ে বেশি বেশি দোয়া করা, তাসবিহ পড়া, তাওবাহ-ইসতেগফার করা, নামাজ পড়া এবং দান-সাদকার আবশ্যক কর্তব্য।
এ সময় অযথা অনর্থক গল্প-গুজব, হাসি-তামাশায় সময় অতিবাহিত না করে অন্তরে মহান আল্লাহর প্রতি ভয় রাখা জরুরি। কেননা এসবই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য সতর্কতা। অনেক হাদিসে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণকে বিশেষ বিপদের সময় বা ক্রান্তিকাল বলে গণ্য করা হয়েছে।
চন্দ্রগ্রহণের নামাজ
হাদিসে সূর্যগ্রহণের নামাজের মতো চন্দ্রগ্রহণের নামাজও প্রমাণিত এবং সুন্নত। তবে এ নামাজ জামাতে ও একাকী পড়া নিয়ে মতভেদ রয়েছে। হানাফি অনুসারীরা এ নামাজ একাকী নিজ নিজ ঘরে পড়ার ওপর তাগিদ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে ফিকহের বিখ্যাত গ্রন্থ বাদায়েউস সানাঈতে এসেছে ‘চন্দ্রগ্রহণের সময় ঘরে নামাজ আদায় করা হবে। কেননা সুন্নাহ হচ্ছে, তখন একাকী নামাজ পড়া।’ (বাদায়েউস সানাঈ : ১/২৮২)
হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় একবার সূর্যগ্রহণ হলো। তখন তিনি লম্বা কেরাত ও লম্বা রুকু-সিজদার মাধ্যমে নামাজ আদায় করলেন। অতঃপর বললেন, ‘সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর নিদর্শনাবলির দুটি নিদর্শনমাত্র। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হয় না। যখন তোমরা তা দেখবে তখন বেশি বেশি আল্লাহকে ডাকবে (দোয়া করবে), বেশি বেশি তাকবির (আল্লাহু আকবার) বলবে, নামাজ পড়বে এবং সাদকা করবে।’ (বুখারি : ১০৪৪)
চন্দ্রগ্রহণের সময় কি গর্ভবতী নারী কিছু খেতে কিংবা কাটাকাটি করতে পারবে?
আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে যে, সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণের সময় গর্ভবতী নারীরা কিছু খেতে পারবেন না এবং এ সময় তারা মাছ, তরিতরকারি বা এজাতীয় কোনো কিছু কাটাকাটিও করতে পারবেন না। এ সময় কিছু খেলে কিংবা কাটাকাটি করলে নাকি গর্ভস্থ সন্তানের বিকলাঙ্গ হওয়ার অথবা যে কোনো ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। এ দুটি ধারণাই অমূলক ও কুসংস্কার। ইসলামি শরিয়তে এরকম বিশ্বাসের কোনো সুযোগ নেই।
ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগের মানুষের বিশ্বাস ছিল, জগতের বৃহৎ কোনো পরিবর্তনের কারণে চাঁদ এবং সূর্যের গ্রহণ লাগে। যেমন- বড় কারো জন্ম, মৃত্যু কিংবা দুর্ভিক্ষের আগমন ইত্যাদির কারণে প্রকৃতিতে এমনটি ঘটে। তবে আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদের এ ভুল বিশ্বাস খণ্ডন করে বলেন, ‘সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ কারো জন্ম-মৃত্যুর কারণে হয় না; এগুলো আল্লাহর নিদর্শনাবলির দুটি নিদর্শনমাত্র। যখন তোমরা তা (সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ) দেখবে তখন নামাজে নিমগ্ন হবে।’ (বুখারি : ১০৪২, মুসলিম : ৯১৪)
মুসলিম শরিফের ৯০১ নম্বর হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন তোমরা সূর্যগ্রহণ দেখবে তখন তা শেষ হওয়া পর্যন্ত বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করবে।’ অর্থাৎ সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সময় একজন প্রকৃত মুমিনের কর্তব্য হলো, সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ দূরীভূত হওয়ার আগপর্যন্ত নামাজ, জিকির, কোরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি নেক আমলের মধ্যে মশগুল থাকা। গর্ভবতী নারীদের জন্যও একই করণীয়। প্রচলিত রেওয়াজের কোনো ভিত্তি নেই।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ