ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : ইসলামে সমাধান

প্রকাশনার সময়: ১৩ নভেম্বর ২০২১, ০৯:৩১

ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে ইসলামের নির্দেশনা। সব বিষয়ের মতো ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও রয়েছে ইসলামের নির্ধারিত ও সুনির্দিষ্ট মূলনীতি। কেননা, আল্লাহর সৃষ্টি মানুষ কোনো ক্ষেত্রেই লাগামহীন স্বাধীনতা পেতে পারে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বর্তমানে দেশের জাতীয় সমস্যাগুলোর অন্যতম। অধিকাংশ নিত্যপণ্যের মূল্যই এখন নিন্ম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। চাল, ডাল, তেলসহ অন্য নিত্যপণ্যের মূল্য হরদম বেড়েই চলেছে। দেশের ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যে কারণগুলো বেরিয়ে আসে, তা হলো

১. ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ। একশ্রেণির অতি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুত গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বলে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে। সরকারও বিভিন্ন সময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকেই দায়ী করে। ২. শিল্প-মালিক, উদ্যোক্তা, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের ওপর মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি কারণ। ব্যবসায়ী এবং উৎপাদকরা চাঁদাবাজদের প্রদত্ত চাঁদার ক্ষতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে পুষিয়ে নেন। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ ভোক্তারা।

৩. আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব অভ্যন্তরীণ বাজারেও পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বাভাবিকভাবেই এর মূল্য বেড়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের এমন সব কালজয়ী কল্যাণধর্মী সুচিন্তিত নীতিমালা ও সুদূরপ্রসারী বাজার পরিকল্পনা রয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, অনাকাক্সিক্ষত মূল্যস্ফীতি রোধ এবং সর্বোপরি বাজারের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি ও অস্থিতিশীলতা দূর করা সম্ভব।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ইসলামি দৃষ্টিকোণ

প্রথমে ব্যবসা সংক্রান্ত পবিত্র কোরআনের কিছু আয়াত পাঠকদের জন্য তুলে ধরা যাক। আল্লাহ পাক বলেন,

ক. ‘তোমরা ইনসাফ মোতাবেক যথাযথভাবে ওজন কর এবং ওজনে কম দিও না। (সূরা রাহমান : ০৯)।

খ. ‘আফসোস সেই লোকদের জন্য যারা পরিমাপে দুর্নীতি করে, যারা মানুষের নিকট থেকে মেপে নিতে যথাযথভাবে নেয়। যখন মানুষকে মেপে দেয় তখন ওজনে কারচুপি করে। তারা কি মনে করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে একটি মহান (কেয়ামত) দিবসে।’ (সূরা মুতাফ্ফিফিন : ১-৪)।

গ. ‘তোমরা পরিমাপে ও ওজনে কম দিও না আমি তোমাদেরকে ভালো অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি এবং আমি তোমাদের জন্য আশংকা করছি বেষ্টনকারী আজাবের দিনের।’ (সূরা হুদ : ৮৪)।

ঘ. হে জাতি, তোমরা পরিমাপ ও ওজন পরিপূর্ণভাবে ন্যায়সংগতভাবে কর, মানুষকে তাদের জিনিসপত্র কম দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ কর না, পৃথিবীতে ফ্যাসাদ ছড়িয়ে দিও না।’ (সূরা হুদ : ৮৫)।

ঙ. ‘হে ঈমানদারগণ তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভক্ষণ করো না। পরস্পর সম্মতিক্রমে ব্যবসা করবে স্বার্থের জন্য নিজেকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াবান।’ (সূরা নিসা : ২৯)।

চ. তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত করো না এবং জেনে বুঝে সত্যকে গোপন করো না।’ (সূরা বাকারা : ৭২)।

ব্যবসাসংক্রান্ত কিছু হাদিস

ইবনে মাজায় বর্ণিত একটি হাদিসে রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যদ্রব্য ৪০ দিন পর্যন্ত মজুদ করে রাখে, আল্লাহতায়ালা তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ)

মজুদদারের ঘৃণ্য মানসিকতার নিন্দা করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘মজুদদার কতই না নিকৃষ্ট! দ্রব্যমূল্য হ্রাসের খবর তার কাছে খারাপ লাগে; আর মূল্যবৃদ্ধির খবরে সে আনন্দিত হয়।’

অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘মজুদদারের ওপর আল্লাহতায়ালা, ফেরেশতাকুল ও মানবজাতির লানত। আল্লাহতায়ালা তার কি ফরজ, কি নফল কোনো ইবাদতই কবুল করেন না।’ (শামি : ৬/৩৯৮)

মজুদদারি সম্পর্কে ফিকাহি নীতিমালা

ফিকহে হানাফির সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘হিদায়া’য় উল্লেখ রয়েছে, ‘মানুষ ও গবাদিপশুর খাদ্য মজুদ করা মাকরুহ, যদি তাতে শহরবাসীর ক্ষতি হয়। যদি শহরবাসীর ক্ষতি না হয়, তাহলে মাকরুহ নয়।’ (হিদায়া, ৪/৪৭০)

‘ফতোয়া-ই-আলমগিরি’তে উল্লেখ রয়েছে, ‘ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) বলেন, ‘নগরবাসী বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সরকার মজুদদারকে বাধ্য করবে, যেন সে তার পণ্য সাধারণ মূল্যে বা যতটুকু বেশি মূল্যে মানুষ মেনে নেয়, সেই মূল্যে বিক্রি করতে।’ (আলমগিরি : ৩/২১৪)

অন্যত্র উল্লেখ রয়েছে, মজুদদার সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করা হলে সরকার তাকে তার এবং তার পরিবারের প্রয়োজনাতিরিক্ত খাদ্য বিক্রির আদেশ দেবে এবং মজুদ করতে নিষেধ করে দেবে। যদি সে বিরত না হয়, তাহলে উপদেশ দিতে হবে, সতর্ক করতে হবে। এরপরও যদি বিরত না হয়, তার বিরুদ্ধে আবার মজুদদারির অভিযোগ ওঠে, তাহলে তাকে বন্দি করবে। (আল-মুহিত)

‘আল-মুজারাআত’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, ফকিহরা এ ব্যাপারে একমত, প্রয়োজনে মজুদদারদের সম্মতি ছাড়াই বিচারক মজুদকৃত খাদ্য বিক্রি করতে পারবেন।

মধ্যস্বত্বভোগীদের অপতৎপরতা

মধ্যস্বত্বভোগীদের অপতৎপরতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই মধ্যস্বত্বভোগীদের এহেন অপতৎপরতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে আছে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) স্বল্পমূল্যে কেনার জন্য বহিরাগত বিক্রেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করেছেন। (তিরমিজি)

অর্থাৎ পণ্যের মালিক বা তেজারতি (বাণিজ্যিক) কাফেলা শহরে পৌঁছার আগেই তাদের কাছ থেকে অধিক মুনাফার লোভে পণ্য কেনা রাসুল (সা.) নিষিদ্ধ করেছেন। কারণ, এতে সাধারণ ক্রেতা ও ভোক্তাদের স্বার্থ বিনষ্ট হয় এবং দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়।

আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো শহরবাসী কোনো গ্রামবাসীর পক্ষ হয়ে বিক্রি করবে না। মানুষকে তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দাও, যেন আল্লাহতায়ালা তাদের একের দ্বারা অন্যের রিজিকের ব্যবস্থা করেন।’ (তিরমিজি)।

সাধারণত গ্রামবাসীই অধিকাংশ খাদ্যের উৎপাদনকারী। গ্রামবাসী সরাসরি শহরে এসে সেসব খাদ্য বিক্রি করলে স্বাভাবিকভাবেই পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকে, শহরবাসীকে উচ্চমূল্য দিতে হয় না। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীরা গ্রামবাসীর কাছ থেকে নিয়ে নিজেরা দালালি করে বাজারদর বাড়িয়ে ফেলে। তাই রাসুল (সা.) এ ধরনের কাজ নিষিদ্ধ করেছেন। এক হাদিসে রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি মূল্যবৃদ্ধির অসদুদ্দেশ্যে মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপ করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তাকে আগুনের হাঁড়িতে বসিয়ে শাস্তি দেবেন।’ (তাবরানি : ৮/২১০)

অনেক সময় কেনার উদ্দেশ্যে নয়, বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অসদুদ্দেশ্যে দালালচক্রকে অধিক মূল্যে দর-দাম করতে দেখা যায়। রাসুল (সা.) সেটাও নিষিদ্ধ করেছেন। হাদিসে এটাকে ‘নাজাশ’ বলা হয়েছে। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা নাজাশ (ক্রেতাকে প্রতারিত) করার জন্য দর-দাম করবে না।’ (তিরমিজি)

শরিয়তের বিধান হচ্ছে- সাধারণত সরকার পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেবে না। এ প্রসঙ্গে আনাস (রা) থেকে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, রাসুল (সা.)-এর যুগে একবার দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। লোকেরা তখন বলে, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমাদের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিন।’ রাসুল (সা.) তখন বললেন, ‘মূলত আল্লাহই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী, রিজিক সঙ্কীর্ণকর্তা, প্রশস্তকর্তা ও রিজিকদাতা। আমি আমার রবের সঙ্গে এভাবে সাক্ষাতের আশা রাখি যে, তোমাদের কারো যেন আমার বিরুদ্ধে রক্ত বা সম্পদ, কোনো বিষয়ে কোনোরূপ দাবি না থাকে।’ (তিরমিজি : ১/২৪৫)

এই হাদিসের পরিপ্রেক্ষিতেই ফকিহরা বলেন, বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে সরকার পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেবে না; তবে ব্যবসায়ীরা যদি অতিরিক্ত মূল্য নেয় অথবা দ্রব্যমূল্য যদি এতই বেড়ে যায় যে, মূল্য নির্ধারণ না করলে জনসাধারণের ভোগান্তি হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সরকার দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারবে। সর্বসাধারণের দুর্ভোগ লাঘবের উদ্দেশ্যে সরকার তখন দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দেয়াটাকে কল্যাণকর বলেই বিবেচনা করবে।’ (হিদায়া, আলমগীরি)

ফকিহরা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, ব্যবসায়ীরা যেন যোগসাজশ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে, সেদিকে সরকারকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। যদি তারা পরস্পর যোগসাজশ করে মূল্যবৃদ্ধি করে, তাহলে সরকার বাজারে হস্তক্ষেপ করে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করতে পারবে, যাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। (তাকমিলাতু ফাতহুল মুলহিম : ১/৩১২) আল্লামা ইবনু কায়্যিমিল জাওজিয়্যা (রহ.) বলেন, ‘মানুষের মধ্যে ন্যায় এবং ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ শুধু বৈধই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে জরুরিও বটে।’ (আত-তুরুক : ১/৩৫৫)

দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের নীতিমালা প্রসঙ্গে ‘বাহরুর রায়েক’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সরকার যখন দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করতে চাইবে, তখন সংশ্লিষ্ট পণ্যের বাজারের গন্যমান্য লোকদের একত্র করবে। ক্রেতাসাধারণকে সরকার উপস্থিত করবে। বিক্রেতারা কী দামে বিক্রি করছে এবং ক্রেতারা কী দামে কিনছে, তা জিজ্ঞেস করে সত্যতা যাচাই করবে। এরপর উৎপাদক-আমদানিকারক-ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয় না, আবার ক্রেতাসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে না যায়- এমনভাবে মূল্য নির্ধারণ করে দেবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ রোগী কল্যাণ সোসাইটি

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ