ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কোরআনে পবিত্র দুই নারীর গল্প

প্রকাশনার সময়: ০৭ নভেম্বর ২০২১, ০৯:৪৫

ইংরেজি সন তখনো চালু হয়নি। কিছুদিন পরই ইংরেজি সন প্রবর্তন হবে। সে সময় বায়তুল মুকাদ্দাসের খাদেম ছিলেন এক আল্লাহ বিশ্বাসী নবী হজরত জাকারিয়া (আ.)। আল্লাহ তায়ালা বায়তুল মুকাদ্দাসের খাদেম হিসেবে ইবরাহিম (আ.)-এর উত্তরসূরি সম্মানিত ব্যক্তি ইমরান বিন ইয়াশেমের কন্যা ও ঈসা (আ.)-এর পবিত্র মাকেও কবুল করেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে মরিয়ম! আল্লাহ তোমাকে বাছাই করে নিয়েছেন। পবিত্র পরিচ্ছন্ন রেখেছেন। এবং বিশ্ব নারী সমাজের ওপর তোমাকে মনোনীত করেছেন।’ ( সূরা : মরিয়ম, আয়াত ৪২ )।

হজরত মরিয়ম (আ.) থাকতেন মসজিদের পাশে। ছোট্ট ঘরে। লোকচক্ষুর আড়ালে। সারাদিন ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। নির্জনে নিভৃতে প্রিয় প্রভুর প্রেমে ডুব দিতেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর জন্য জান্নাতের খাবার পাঠাতেন। হজরত জাকারিয়া (আ.) এসব খাবার দেখে বিস্মিত হতেন। হজরত মরিয়ম (আ.)-এর বয়স পড়ল। যৌবনে পা রেখেছেন তখন। আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে পৃথিবীর জীবনে বিস্ময় প্রকাশের ইচ্ছা করলেন। আল্লাহ জিবরাইল (আ.)কে পাঠালেন তাঁর কাছে। তাগড়া যুবকের বেশে জিবরাইল (আ.) এলেন। মরিয়ম (আ.) ভয় পেলেন। আশ্রয় প্রার্থনা করলেন রাব্বে কারিমের। যুবককে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন।

যুবক এসেছেন আল্লাহর আদেশে। বিস্ময় নির্মাণে। যুবক তাকে পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলেন। মরিয়ম (আ.) হতবাক হলেন। কোরআন তাদের আলাপচারিতার কথা এভাবে বর্ণনা করেছে, ‘অতপর তিনি তাদের ছেড়ে পর্দা গ্রহণ করলেন। তখন আমি তার কাছে আমার রুহ (জিবরাইলকে) প্রেরণ করলাম। তিনি তার সামনে সুঠামদেহী মানবাকার ধারণ করলেন। মরিয়ম বললেন, আমি তোমার থেকে দয়াময়ের আশ্রয় গ্রহণ করছিÑ যদি তুমি আল্লাহভীরু হতে। জিবরাইল বললেন, আমি তোমার রবের প্রেরিত দূত, যেন তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করি। মরিয়ম বললেন, কীভাবে আমার পুত্র সন্তান হবে? অথচ কোনো মানব আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি কামিনীও নই? উত্তর দিলেন, সেভাবেই হবে যেভাবে তিনি সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। তোমার প্রভু বলেছেন, এটা আমার পক্ষে একবারেই সহজ এবং আমি তাকে আমার পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য নিদর্শন ও রহমত বানাতে চাই। এটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়ে রয়েছে।’ (সূরা : মরিয়ম : ১৭-২১)

আল্লাহর কুদরতে মরিয়ম (আ.) গর্ভবতী হলেন। তবে তার উত্তম আদর্শ ও চরিত্রে যেন কেউ কলঙ্কের দাগ বসাতে না পারে, অনাচারীরা যেন তাকে অপবাদ দিতে না পারে সেজন্য আল্লাহ কোরআনে ষ্পষ্ট ঘোষণা করেন, ‘আর সেই নারী যে তার সতীত্ব রক্ষা করেছিল, আমি তার মাঝে আমার পক্ষ থেকে প্রাণ ফুঁকে দিলাম এবং তাঁকে ও তাঁর পুত্রকে বিশ্ববাসীর জন্য এক অনন্য নিদর্শন বানালাম।’ (সূরা আম্বিয়া : ৯১)

চিরকুমারী নারীর গর্ভে সন্তান এল। একদিন প্রসব বেদনা শুরু হল। যন্ত্রণা বাড়ল। মহিয়সী নারী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। শহর ছাড়লেন। দু’পায়া পথ ধরে চললেন নির্জন ভূমিতে। যেখানে মানুষ নেই। যেখানে মানুষ থাকে না। ঘর বাড়ি নেই। বৃক্ষে খেজুর নেই। খাবার নেই। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দির জন্য সবকিছুর ব্যবস্থা করলেন। আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হলেন। মরিয়মের গর্ভে পৃথিবীর আলোকিত সন্তান হজরত ঈসা মসিহ জন্মগ্রহণ করলেন। সন্তান নিয়ে ফিরে আসলেন জনপদে। মানুষের মাঝে। অন্তরে ভয়। দ্বিধা-সংশয়। পথে হাঁটছেন। বারবার তাকান আকাশে। প্রভুকে খুঁজেন। উত্তর চান প্রভুর কাছে। সাহায্য চান মালিকের নিকটে।

মরিয়ম (আ.)-এর পথ আগলে ধরল মানুষ। প্রশ্ন করল তাঁকে। তাঁকে কলঙ্কের তকমা দিল। তিনি দেখিয়ে দিলেন সদ্য জন্ম নেয়া পুত্রকে। তারা ঠাট্টা করল। এবং বিস্ময়বোধ করল। মায়ের পবিত্রতার সাক্ষী দিলেন মাত্রই জন্ম নেয়া একদিনের শিশু। কোরআনে এসেছে এভাবে, ‘অতপর মরিয়ম ঈসার দিকে ইঙ্গিত করল। তখন লোকেরা বলল, কোলের শিশুর সঙ্গে আমরা কীভাবে কথা বলব? ঈসা তখন বলে উঠল, আমি আল্লাহর দাস। তিনি আমাকে কিতাব (ইঞ্জিল) প্রদান করেছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। (সূরা মরিয়ম : ২৯-৩০)

আল্লাহ তায়ালা একজন নারীর পবিত্র সতীত্বের প্রমাণ পেশ করতে একদিনের শিশুর মুখে কথার ফোয়ারা জারি করেছেন। শিশুর মুখে পবিত্রতার ঘোষণা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়! মরিয়ম (আ.)-এর পবিত্রতার সাক্ষী দিতে গিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল-কোরআনে ৩১টি আয়াত নাজিল করেছেন। তার নামে স্বতন্ত্র সূরার নামকরণ করেছেন। সূরা মরিয়মে ও সূরা ইমরানে তার সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন।

২. হজরত আয়েশা (রা.)। হৃদয়ের বাদশা মুহাম্মদ (সা.)-এর স্ত্রী। আবু বকর (রা.)-এর প্রিয় মেয়ে। উম্মুল মুমিনীন। নারী হাদিস বিশারদ। আয়েশা (রা.) তখন মক্কায়। মক্কায় ধুলোবালিতে খেলছেন। ছেলেবেলা পার হয়নি। ছয় বছর তাঁর। আল্লাহর আদেশে সেই ছয় বছর বয়সে মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে বিবাহ হয়। ৯ বছর বয়সে আল্লাহর রাসুলের ঘরে যান। তখন সবাই মদিনার বাসিন্দা।

মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় স্ত্রী ছিলেন আয়েশা (রা.)। মদিনা থেকে রাসুল (সা.) যুদ্ধে যেতেন। সঙ্গে তাঁর কোনো একজন স্ত্রীকে নিতেন। স্ত্রীগণ তাঁর সঙ্গে যেতে মরিয়া থাকতেন। সেজন্য তিনি লটারির ব্যবস্থা করেন। সেবার বনি মুসতালিকের যুদ্ধে যাবেন। লটারিতে আয়েশা (রা.)-এর নাম পড়ল। যুদ্ধের মাঠে গেলেন। বিজয়ী হলেন। মদিনায় ফিরার পথ ধরলেন। হাওদার দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেরা হাওদা নিয়ে চললেন। হাওদার ভেতরে থাকতেন আম্মাজান আয়েশা (রা.)। ঘটনাক্রমে তিনি হাওদায় ছিলেন না। আম্মাজানের শারীরিক ওজন কম থাকায় তারা অনুমান করতে পারেননি তিনি ভেতরে আছেন কি-না? তিনি তখন প্রাকৃতিক ডাকে বাইরে ছিলেন।

আয়েশা (রা.) ফিরে এসে কাফেলার কাউকে পেলেন না। চাদর মুড়িয়ে শুয়ে পড়লেন উন্মুক্ত মাঠে। তার ঘুম পেল। ঘুমিয়ে পড়লেন। বনু সুলামি গোত্রের যাকওয়ান শাখার সাফওয়ান বিন মুআত্তাল (রা.) যাকে রাসুল (সা.) ফেলে যাওয়া আসবাবপত্র কুড়িয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন; সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর তিনি সেখানে ছিলেন। সাফওয়ান একজন ঘুমন্ত মানুষ দেখে এগিয়ে এলেন। আয়েশা (রা.) কে চিনে ফেললেন। তিনি আয়েশা (রা.)কে পর্দার বিধান নাজিল হওয়ার পূর্বে দেখেছিলেন। তিনি তখন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়লেন। আয়েশা (রা.) এ শব্দ শুনে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। চাদর টেনে ভালোমতো চেহারা ঢেকে নিলেন। তিনি তার সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। আম্মাজানকে সওয়ারিতে বসিয়ে পথ ধরলেন মদিনার। সাফওয়ান আগে আগে চলতে লাগলেন।

মুহাম্মদ (সা.) ঘটনা জানতে পারলেন। তিনি চিন্তিত হলেন। মুনাফিক স্বভাবের কিছু লোক অপবাদের আওয়াজ তুলল। রাসুল (সা.) কষ্ট পেলেন। আয়েশা (রা.) কে পৃথক করলেন। রেখে আসলেন শ্বশুরের ঘরে। আবু বকর (রা.)-এর আলয়ে। সেবার আয়েশা (রা.)ও চরম ব্যথা পেলেন। মুহাম্মদ (সা.) পেরেশান। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ওইদিকে মুনাফিকরা অপবাদের বিষ ছড়াতে লাগল।

অনেক দিন পর। আল্লাহ তায়ালা আম্মাজান আয়েশা (রা.)-এর পবিত্রতার ঘোষণা করে তাঁর প্রিয় কালাম কোরআনে ১০ আয়াত নাজিল করেন। তার পবিত্রতার বর্ণনা করেন সূরা নুরে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল। তোমরা একে নিজেদের জন্য খারাপ মনে করো না; বরং এটা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। তাদের প্রত্যেকের জন্য ততটুকু আছে যতটুকু সে গোনাহ করেছে এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, তার জন্যে রয়েছে বিরাট শাস্তি। যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার প্রসার লাভ করুক তাদের জন্যে ইহকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ (সূরা নুর : ১৯)

আল্লাহর কাছে চরিত্র রক্ষা করা নারীর মর্যাদা অনেক। ভালো নারীর পবিত্রতার জন্যই আল্লাহ কোরআনে; পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থে, নিজের কালামে আয়াত নাজিল করেছেন। তাদের সম্মান দিয়েছেন। সতীত্ব রক্ষাকারী নারীর মর্যাদা আল্লাহর কাছে অতুলনীয়।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ