ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬
যুবাইর বিন আওয়াম (রা.)

জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত অকুতোভয় সাহাবি

প্রকাশনার সময়: ০৩ নভেম্বর ২০২১, ১০:০৬

যুবাইর বিন আওয়াম (রা.) ছিলেন নবীজি (সা.)-এর ফুফাতো ভাই এবং একই সঙ্গে ভায়রা ভাইও। সাফিয়্যা ছিলেন তার মাতা আর আয়েশা (রা.) এর বড় বোন আসমা (রা.) ছিলেন তার স্ত্রী। যুবাইর আশারা মুবাশশারার একজন। দুনিয়াতে থাকতেই পেয়েছিলেন নবীজির পবিত্র জবানে জান্নাতের সুসংবাদ।

তিনি ছোট বেলায় মায়ের হাতে অনেক পিটুনি খেয়েছেন। মাকে পাড়াপড়শিরা বলত, বাচ্চা ছেলেটাকে কি মেরে ফেলবে? এত পেটাও কেন? মা উত্তর দিতেন, বীর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। তাই এখন থেকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। মায়ের পেটানোর উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। বড় সাহসী ছিলেন নবীজির প্রিয় এ সাহাবি। মক্কায় একবার রটে গেল, কে জানি নবীজিকে ধরে নিয়ে গেছে। যুবাইরের বয়স তখন মাত্র বারো বছর।

নবীজি দেখলেন, তরবারি হাতে যুবাইর দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করলেন, কিরে খোকা, কী হয়েছে? যুবাইর বললেন, ঘর থেকে শপথ করে বের হয়েছি, যে আপনাকে ধরতে আসবে ওর কল্লা উড়িয়ে দিব।

বদর যুদ্ধের কাহিনী যুবাইরের মুখেই শোনা যাক। যুবাইর বলেন, বদরের দিন আমি ‘উবাইদাহ বিন সা‘ঈদ বিন আসকে দেখলাম যে সে বস্ত্রাবৃত। দু’চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। খুব অহংকার দেখাচ্ছিল সে। আমি বর্শা দিয়ে তার ওপর হামলা চালালাম এবং তার চোখ ফুঁড়ে দিলাম। সে তক্ষুণি মারা গেল। উবাইদার গায়ে যুদ্ধবস্ত্র থাকায় বর্শাটি বের করতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি লাশের ওপর পা রাখলাম। বেশ শক্তি খাটিয়ে সেটি বের করে আনলাম। এতে বর্শার দু’ প্রান্তভাগ বাঁকা হয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার কাছ থেকে বর্শাটি চেয়ে নিলেন। নবীজির পর প্রত্যেক খলিফা উক্ত বর্শাটি আমার থেকে চেয়ে নিজের কাছে রাখতেন। বর্শাটির এক বিশেষ কদর ছিল।

দুই.

উহুদ যুদ্ধ শেষ হল। সাহাবায়ে কেরাম মদিনায় ফিরে এলেন। সবাই ক্লান্ত-শ্রান্ত। হঠাৎ সংবাদ এল, কুরাইশ বাহিনী নাকি আবার মদিনায় আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। নবীজি ঘোষণা দিলেন, চলো, কুরাইশকে এখনই প্রতিহত করতে হবে। যুবাইর তখনই প্রস্তুত হয়ে গেলেন।

তিন.

খন্দক যুদ্ধে যুবাইর এত প্রবল বেগে শত্রুদের ওপর তীর নিক্ষেপ করছিলেন যে, নবীজি (সা.) এক পর্যায়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘যুবাইর, তোমার জন্য আমার বাবা-মা কুরবান’। এ যুদ্ধে তিনি উসমান বিন আব্দুল্লাহর শিরস্ত্রাণে তরবারি দিয়ে একটা আঘাত করেছিলেন। সে আঘাতে তরবারিটা শিরস্ত্রাণ ভেদ করে পা পর্যন্ত নেমে এসেছিল।

চার.

বনু কুরাইজার যুদ্ধের দিন নবীজি (সা.) ঘোষণা দিলেন, কে আছে যে শত্রুদের অভ্যন্তরীণ সংবাদ এনে দিতে পারবে? যুবাইর বললেন, আমি ইয়া রাসুলাল্লাহ। নবীজি দ্বিতীয়বার বললেন, কে আছে যে শত্রুদের অভ্যন্তরীণ সংবাদ এনে দিতে পারবে? এবারো যুবাইর বললেন, আমি ইয়া রাসুলাল্লাহ। নবীজি ঘোষণাটি আবার করলেন। এবারো যুবাইর দাঁড়ালেন। নবীজি তখন মন্তব্য করলেন, ‘প্রত্যেক নবীরই বিশেষ শিষ্য (হাওয়ারি) থাকে। আমার খাস শিষ্য হল যুবাইর’।

পাঁচ.

ইয়ারমুকসহ বিভিন্ন যুদ্ধে যুবাইরের গায়ে এত পরিমাণে আঘাত লেগেছিল যে, তার সন্তানরা শরীরের সেসব আঘাতে হাত ঢুকিয়ে খেলাধুলা করত। বর্শা ও তীরের আঘাতে যুবাইরের পুরো শরীরটি ছিল ক্ষতবিক্ষত । তার বুক দেখলে যে কেউ মন্তব্য করত, এ তো বুক নয়, যেন রক্ত বের হওয়ার ঝর্না।

ছয়.

উষ্ট্রী যুদ্ধ চলাকালীন তিনি শহীদ হন। মৃত্যুর আগে পুত্র আব্দুল্লাহকে ডেকে বলেছিলেন, বাবা, মৃত্যুর সময় আমার সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার ঋণগুলো নিয়ে। বাবা, তোমাকে অসিয়ত করে যাই, যে করে হোক, ঋণগুলো শোধ কর।

সাত.

বিপুল সম্পদের মালিক ছিলেন যুবাইর (রা.)। বিভিন্ন যুদ্ধের গনীমত থেকে তিনি এসব সম্পদ অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন তাকে এত ঋণ করতে হয়েছিল, সে কাহিনীটি আরো মজার। যুবাইর ছিলেন বিশ্বস্ত মানুষ। তাই লোকজন তার কাছে আমানত রাখত। কেউ আমানত রাখতে আসলে তিনি বলতেন, ‘এ টাকাটি আমার কাছে ঋণ হিসেবে থাক, আমানত হিসেবে নয়। এতে করে তোমারই লাভ হবে। আমার থেকে হারিয়ে গেলে আমি দিতে বাধ্য থাকব। আর আমানত হিসেবে রাখার পর সে টাকা যদি আমার তসরুফ ছাড়া নষ্ট হয়, তাহলে তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন আমি তোমাকে টাকাটা ফেরত দিতে বাধ্য থাকব না।’

এভাবে মানুষের আমানতের টাকা হেফাজত করতে গিয়ে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগে তিনি পুত্র আব্দুল্লাহকে এ কথাও বলেছিলেন, যদি আমার ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে কোথাও জটিলতার সম্মুখীন হও তাহলে আমার ‘মাওলার’ কাছে সাহায্য চাইবে। আব্দুল্লাহ পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনার মাওলা? যুবাইর বললেন, আল্লাহ আমার মাওলা। আব্দুল্লাহ বলেন, ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে যখনই আমি কোনো সমস্যায় পড়তাম, বলতাম, হে যুবাইরের মাওলা, সাহায্য করুন। দোয়া করতে দেরি, সমস্যা দূর হতে সময় লাগত না।

আট.

মৃত্যুর সময় যুবাইর মদিনা, বসরা, কুফা ও মিসরে একটি একটি করে মোট চারটি বাড়ি এবং খোলা প্রান্তরে দুটি জমি রেখে গিয়েছিলেন। খোলা প্রান্তরের সে জমিন দুটি যুবাইর কিনেছিলেন এক লক্ষ সত্তর হাজার দিয়ে। আব্দুল্লাহ সেটি বিক্রি করেন ষোল লাখে। যুবাইরের মৃত্যুর পর একেকজন সাহাবি এসে ঋণের পরিমাণ জিজ্ঞেস করেন। তারা ভাই যুবাইরের জমিনটি নিজেরা কয়েকজন মিলে উচ্চ মূল্যে কিনে নেন। এভাবে সাহাবিরা সুযোগের সৎ ব্যবহার করেন। যুবাইর-পরিবারকে সাহায্য করতে পেরে তৃপ্তি বোধ করেন। যুবাইরের সর্বমোট ঋণ পরিশোধ করা হয় বাইশ লাখ। এরপর মীরাস বণ্টন হয় প্রায় বায়ান্ন লাখ টাকার মতো। আল্লাহ তায়ালাই বরকতদাতা। রাদিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আরদাহুম।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ