মৃত্যু ঠিক কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে আমরা পড়েছি এবং জেনেছি। আর সেই আদর্শ মৃত্যু রাসুলের (সা.) ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। যখন কেউ মারা যায়- হয় তারা এ দুনিয়া থেকে মুক্তি পায়, না হয় দুনিয়া তাদের থেকে মুক্তি পায়।
খারাপ লোক প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘আসমান ও জমিন তাদের জন্য কাঁদেনি।’ (সূরা দুখান : ২৯) ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘একজন পুণ্যবান লোকের মৃত্যুতে আসমান কাঁদে, কারণ আসমানের যে দরজাগুলো দিয়ে তাদের আমলগুলো অবতরণ করতো তা আর খোলা হবে না। তার সিজদার জায়গা তখন কাঁদে, দুনিয়ার মাটিও কাঁদে।’ এ ক্ষেত্রে রাসুলের (সা.) কথা একবার চিন্তা করে দেখুন, যিনি বেঁচে থাকতে সবাই তাঁর সহচার্য কামনা করেছে, তাঁর মৃত্যুতে সবাই শোক প্রকাশ করেছে। এখন যদি আপনি মদিনার অধিবাসী হন, আপনার পুরো জীবন রাসুলকে (সা.) কেন্দ্র করে আবর্তিত। এমন এক মুহূর্ত নেই যখন আপনি তাঁকে নিয়ে চিন্তা করেননি। তিনি কি করছেন, কীভাবে আপনি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন, তাঁর সাহচর্য পেতে পারেন- এসব চিন্তা আপনি প্রতিনিয়ত করছেন। এই পর্যায়ে, এক দশকেরও বেশি সময় এভাবেই কেটে গেছে। রাসুল (সা.) যেদিন মদিনায় আসলেন যেন এক সন্তানের জন্ম দিলেন, সমস্ত শহরে যেন তিনি আলো নিয়ে আসলেন, সবাইকে আলোকিত করলেন।
ওহুদের যুদ্ধে একটি দৃশ্য ছিল, যেখানে চিৎকার করে বলা হয়েছিল রাসুল (সা.) মারা গেছেন। সবাই তাদের তরবারি নামিয়ে রেখেছিল, বর্ম খুলে ফেলেছিল এবং কাঁদতে শুরু করেছিল। তাদের মনে হয়েছিল তাদের বেঁচে থাকার আর কোনো অর্থ নেই। তখন রাসুলের (সা.) সঙ্গে তারা তো মাত্র কয়েকটি বছর কাটিয়েছিল। তাহলে এখনকার কথা চিন্তা করুন।
আপনি এখন মসজিদে বসে আছেন। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে আসবেন, কি আসবেন না তা নিয়ে আপনি উদ্বিগ্ন। মনের গভীরে আপনি আশা করছেন তিনি আসলে মারা যাবেন না। মৃত্যুতো অনিবার্য, তিনিও তো একজন মানুষ। তারপরও আপনি ভাবছেন- কিন্তু না, তিনি মৃত্যুবরণ করবেন না, তিনি নিশ্চয়ই তাঁর অসুস্থতা কাটিয়ে উঠবেন, কারণ তিনিই তো কত লোকের নিরাময় করেছেন। কত লোক মৃতপ্রায় ছিল, রাসুল (সা.) তাদের জন্য দোয়া করেছেন। ফলে তারা বেঁচে গেছে। না না, তিনি এখনই মৃত্যুবরণ করবেন না। আরো কত কিছু বাকি, তাঁর জীবনের গল্প কি এখানেই শেষ? না, না আমাদের চোখের সামনে তাঁর জীবনের আরো কত গল্প উদঘাটিত হবে- এই প্রত্যাশাই আপনি তখন করছেন।
কতই না উপযুক্ত যে রাসুলের (সা.) শেষ দর্শন ছিল হাসি। তিনি তাঁর কক্ষে। আনাস (রা.) দৃশ্যটি বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘আমরা নামাজ পড়ছি, আপনি দেখতে পেলেন রাসুল (সা.) পর্দা তুলে হাসলেন।’ আপনি তাঁর সবগুলো দাঁত দেখতে পেলেন। তখন তাঁর মুখ ছিল মুসহাফের পাতার মতো, তাঁর সবচেয়ে সুন্দর হাসি ছিল উম্মতের উদ্দেশ্যে তাঁর শেষ হাসি।
আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম যখন মদিনায় আসলেন, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন রাসুলের (সা.) এই হাসির কারণে। এখন তিনি মদিনা ছেড়ে, এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছেন হাসিমুখে। আপনি এখন নামাজে, তাঁর দিকে তাকিয়ে আপনি উদ্বেলিত। তিনি যেভাবে হাসছেন, নিশ্চয়ই তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। রাসুল (সা.) বলছেন, ‘আপনারা নামাজ চালিয়ে যান।’ [আশ সামাঈল আল মুহাম্মাদিয়াহ : ৩৮৬] আমি আমার লক্ষ্য পূর্ণ করেছি, আমার যা করা উচিত ছিল তা আমি করেছি। আমি বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। আপনারা এখন নামাজ পড়ছেন, আমি আমার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছেছি। আপনারা চালিয়ে যান, এর অর্থ শুধু নামাজ চালিয়ে যান, তা কিন্তু নয়। তারপর তিনি পর্দা নামিয়ে নিলেন।
মসজিদে বসে তাঁর কক্ষে কি হচ্ছে তা নিয়ে আপনি উদ্বিগ্ন। এইবার আয়েশা (রা.) তাঁর কোলে মাথা রাখেননি, তিনি আয়েশার (রা.) কোলে মাথা রেখেছেন। আয়েশা (রা.) তাঁর জ্বরের তীব্রতা বর্ণনা করছেন। রাসুল (সা.) বলছেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই, মৃত্যুর শেষ সময় সত্যিই কষ্টকর।’ (সহিহ বুখারি : ৬৫১০) ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘রাসুলের (সা.) জ্বরের উত্তপ্ততার মতো উত্তপ্ত কিছু আমি কখনো অনুভব করিনি।’
রাসুল (সা.) আয়েশার (রা.) কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন, তিনি আয়েশার (রা.) ভাই আব্দুর রহমানকে দেখতে পেলেন। তাঁর হাতে একটি মিসওয়াক ছিল। আয়েশা (রা.) দেখলেন তিনি তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাই আয়েশা (রা.) জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কি মিসওয়াক করতে চান?’ রাসুল (সা.) মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। আয়েশা (রা.) মিসওয়াকটি চাবিয়ে নরম করলেন, তারপর রাসুলকে (সা.) দিলেন। শেষবারের মতো রাসুল (সা.) মিসওয়াক করলেন, যা প্রতি নামাজের আগে তিনি করতেন। এভাবেই তাঁর পালনকর্তার সঙ্গে কথোপকথনের জন্য তিনি নিজেকে প্রস্তুত করতেন। তিনি মিসওয়াক করছেন এবং উপরের দিকে তাকাচ্ছেন।
যখন জিবরিল (আ.) তাঁর কক্ষে প্রবেশ করলেন, তাঁর চেহারা প্রজ্বলিত হলো। জিবরিল (আ.) তাঁকে দুটোর একটি বেছে নিতে বললেন। ‘তিনি কী চান এ পৃথিবীর অস্তিত্ব যতদিন আছে ততদিন বেঁচে থাকতে? নাকি সর্বোচ্চ সঙ্গীর সাথী হতে?’ তিনি বেছে নিলেন, ‘আর-রাফিকাল আ‘লা’ তথা সর্বোচ্চ সঙ্গী। তিনি উপরের দিকে তাকিয়ে বলতেই থাকলেন, বরং আমি বেছে নিয়েছি ‘আর-রাফিকাল আ‘লা’- সর্বোচ্চ সঙ্গী। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘শেষের কথাটি তিনি তিনবার বলেন। যতক্ষণ না তাঁর হাত এলিয়ে পড়ল, দৃষ্টি নিথর হয়ে গেল।’ (বুখারি : ৪৫৮৬) তিনি তাঁর সর্বোচ্চ বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হলেন।
আয়েশা (রা.) বলেন, ‘এক সুঘ্রাণ তৎক্ষণাৎ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ল।’ যখন পুণ্যবানদের আত্মা নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ফেরেশতারা সুগন্ধি কাফনের কাপড় নিয়ে আসেন। তাহলে চিন্তা করে দেখুন, ফেরেশতারা রাসুলের (সা.) জন্য যে কাফনের কাপড় এনেছিলেন তার সুগন্ধ কেমন ছিল। সারা ঘরে সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল। এত সুন্দর ঘ্রাণ কেউ কখনো পায়নি। আয়েশা (রা.) কান্না শুরু করলেন। আপনি এই পর্যায়ে মসজিদে বসে আয়েশার (রা.) চিৎকার শুনছেন, আপনি শুনছেন : ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) মারা গেছেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) মারা গেছেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) মারা গেছেন।’
আপনি পর্দার দিকে তাকিয়ে ভাবছেন, তিনি কি আবার সেই পর্দা তুলবেন? এটা কি গুজব? ওহুদের যুদ্ধেও তো আমরা মনে করেছিলাম তিনি মারা গেছেন, কিন্তু আসলে তিনি মারা যান নি। এরকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তো আমরা আগেও গিয়েছি। তিনি এখনই বের হয়ে আসবেন, এটা সত্যি হতে পারে না। প্রত্যেকেই পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে, তারা চারপাশেও তাকাচ্ছে। কেউ কেউ এই পর্যায়ে কাঁদতে শুরু করেছে, কেউ কেউ আবার অবিশ্বাসের ঘোরে আছে। আপনি চারপাশে তাকিয়ে দেখছেন।
আলী (রা.) স্পষ্টবাদী, কিন্তু তিনিও কথা বলছেন না। আপনি ওসমানকে (রা.) দেখছেন তিনি দাঁড়াতে পারছেন না। ওমর (রা.) বলছেন, ‘কে বলেছে রাসুল (সা.) মারা গেছেন? আপনারা মিথ্যা বলছেন, আপনারা মিথ্যা বলছেন, আপনারা ফিতনা সৃষ্টি করছেন। একথা সত্যি নয়, অবশ্যই রাসুল (সা.) মারা যাননি। তিনি এখনই বেরিয়ে আসবেন। আপনারা মিথ্যুক, আপনারা কপটাচারি। এভাবে ফিতনার সৃষ্টি করবেন না।’ তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না রাসুল (সা.) মারা গেছেন। রাসুলের (সা.) মৃত্যুর সংবাদ সেদিন মসজিদে সবাইকে দংশন করেছিল।
তখন আবু বকর (রা.) উঠে দাঁড়ালেন। তিনি সবাইকে স্মরণ করালেন, ‘যারা মুহাম্মাদের (সা.) উপাসনা করে তারা জেনে রাখুক তিনি সত্যিই মারা গেছেন, আর যারা আল্লাহর উপাসনা করে তারা জেনে রাখুক, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ চিরঞ্জীব, কখনো মারা যাবেন না।’
অনুভূতিটা একবার কল্পনা করুন, সমাজের প্রতিটি মানুষ এই দুনিয়ার মধ্যে তাদের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিটিকে হারিয়েছেন। এখন তাদের কী হবে? সমাজের প্রতিটি মানুষের সন্তান যেন একসঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছে, মসজিদে প্রতিটি মানুষের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটি সবেমাত্র মৃত্যুবরণ করেছেন। সবাই তাদের নিজস্ব বেদনায় নিমজ্জিত। প্রত্যেককে এখন নিজের বাসায় ফিরে যেতে হবে যেখানে রাসুল (সা.) আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন, সবাইকে মসজিদে নামাজ পড়তে হবে তাঁর ইমামতি ছাড়া! উৎসব উদযাপন করতে হবে তাঁকে ছাড়া!
প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি উপলক্ষ এখন তাদের দংশন করবে। সুবহানাল্লাহ! এ যেন সন্তান হারানোর বেদনা। একটি হাদিসে রাসুল (সা.) মৃত সন্তানের পিতা-মাতার পুরস্কারের কথা বলেছিলেন। তখন সাহাবায়ে কেরাম বলেছিলেন, ‘হে রাসুলুল্লাহ! যাদেরকে সন্তান হারানোর পরীক্ষা দিতে হয়নি তাদের কী হবে? রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘তাহলে তারা আমাকে হারানোর পুরস্কার পাবে, তাদেরকে আমার মৃত্যুর চেয়ে বড় পরীক্ষা দেয়া হবে না।’ (সুনান আত-তিরমিজি : ১০৬২)
‘যেদিন আল্লাহর রাসুল (সা.) মদিনায় প্রবেশ করেছিলেন, সেদিন সমস্ত শহর আলোকিত হয়েছিল। আর যেদিন তিনি মারা গেলেন, সেদিন সমস্ত শহর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছিল।’ (আনাস ইবনে মালিক)
অনুবাদ : ফাহমিনা হাসানাত
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ