আমার এইচএসসি পরীক্ষার পর ঢাকায় আমাদের বাসা চেঞ্জ হয়েছিল। নতুন বাসায় একদিন ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠে বাইরে অনেক মানুষের চিৎকার শুনতে পাই। দ্রুত বারান্দায় গিয়ে দেখি বাসার সামনের বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার থেকে আগুন লেগেছে আর সেই আগুন একটা বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আগুন নেভানোর জন্য অনেক মানুষ একসঙ্গে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর আল্লাহ তায়ালার রহমতে সেই আগুন নেভানো সম্ভব হয়েছিল, বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। পুরো ঘটনায় যে বিষয়টা নজর কেড়েছিল, আগুনের ক্ষতি থেকে মানুষকে বাঁচানোর ব্যাকুলতা।
এই বাসাতেই থাকাকালীন সময়ে আরেকদিন নিচের রাস্তায় একটা রোড এক্সিডেন্ট দেখেছিলাম। বেশ কয়েকজন মানুষ আহত হয়েছিল। আহত মানুষগুলোকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য আশেপাশের মানুষগুলো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আর এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। আহত মানুষগুলোকে বাঁচানোর ব্যাকুলতা এখানেও নজর কেড়েছিল। অগ্নিকাণ্ড, এক্সিডেন্ট, মহান আল্লাহর দেয়া বিভিন্ন আজাবে যখন মানুষ আক্রান্ত হয়, তখন আক্রান্ত মানুষগুলোকে বাঁচানোর জন্য এক ব্যাকুলতা আমাদের মধ্যে কাজ করে। এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। এটা মানুষের প্রতি মানুষের অনুগ্রহ বা ইহসান। কিন্তু সবচেয়ে বড় ইহসান বা অনুগ্রহ আসলে কী? সেটা জানতে কোরআনে সূরা নামলে বর্ণিত দুইটি ছোট্ট ঘটনা দেখে নেই :
(১) আল্লাহর নবী সুলাইমান (আ.) একবার তার বাহিনী নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে একটা পিঁপড়ার ঢিবি তথা পিঁপড়া অধ্যুষিত এলাকা ছিল। সুলাইমান (আ.) এর বাহিনীর আগমন শব্দ শুনতে পেয়ে ওই পিঁপড়া দলের একটি পিঁপড়া অন্য পিঁপড়াদের উদ্দেশ করে বললো, ‘হে পিপীলিকার দল! তোমরা তোমাদের গৃহে প্রবেশ কর। অন্যথায় সুলায়মান (আ.) ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদেরকে পিষ্ট করে ফেলবে।
(২) সুলাইমান (আ.) মানুষ ছাড়াও আল্লাহর অনুগ্রহে জ্বীন, পাখি ইত্যাদি মাখলুকের ভাষাও বুঝতেন। উনার দরবারে হুদহুদ নামে এক পাখি ছিল। একবার সেই পাখি সুলাইমান (আ.) এর নিকট ‘সাবা’ নামক রাজ্যের কথা জানালো, ওইখানের রানি ছিল বিলকিস নাম্নী এক মহিলা। আর তারা সূর্যের পূজা করতো। সুলাইমান (আ.) এই সংবাদপ্রাপ্ত হয়ে তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করে একটি পত্র লিখেছিলেন আর হুদহুদ পাখিকে দিয়েই সেই পত্র প্রেরণ করেছিলেন। পরবর্তীতে আল্লাহর অনুগ্রহে রানি বিলকিস এবং ওই রাজ্যের অন্যরাও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
উপরের প্রথম ঘটনাটিতে একটি পিঁপড়ার মধ্যে নিজের স্বজাতিকে বাঁচানোর এক পরম ব্যাকুলতা আমরা দেখতে পাই। সুলাইমান (আ.) এর বাহিনী না দেখে, ভুলক্রমে তাদের পিষে ফেলতে পারে, এই ভয় থেকে সে অন্য পিঁপড়াদের সতর্ক করে দিলো, যাতে তারা নিরাপদ স্থানে চলে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে। আল্লাহর নিকট পিঁপড়াটির এই ফিকির পছন্দ হয়েছে। একইভাবে হুদহুদ পাখির মধ্যে একটি কওমকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর এক ব্যাকুলতা তৈরি হয়েছিল। সেজন্য সাবা নামক রাজ্যের মানুষদের অবস্থা পাখিটি সুলাইমান (আ.)কে জানিয়েছিল। পরবর্তীতে এই ওসিলায় সেই কওমের সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। পাখিটির এই ফিকির মহান আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় হয়েছে। এজন্য আল্লাহ তায়ালা কোরআনেই উল্লেখ করে দিয়েছেন এই ঘটনা। (দ্রষ্টব্য সূরা নামল : ১৮-৪৪)
সুতরাং বুঝা গেল, একজন মানুষের প্রতি অন্য একজন মানুষের সবচেয়ে বড় ইহসান বা অনুগ্রহ হলো, তাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা। একটা পাখি বা একটা পিঁপড়ার মধ্যে এই ফিকির থাকায় তাদের কথা আল্লাহ তায়ালা কোরআনে উল্লেখ করে দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ! যতদিন কোরআন বিদ্যমান থাকবে, ততদিন এই ঘটনার আলোচনা চালু থাকবে।
মানুষকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর এই ব্যাকুলতা সবচেয়ে বেশি ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মধ্যে। তিনি বলতেন : ‘আমার ও মানুষের উদাহরণ হলো ওই ব্যক্তির মতো, যে আগুন জ্বালিয়েছে। আগুন চারপাশ আলোকিত করলে কীট-পতঙ্গ এসে ভিড় জমাতে থাকে। পতঙ্গগুলো আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর ওই লোক তাদের সেখান থেকে তুলে ছুড়ে ফেলে। আবার তারা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনি তাদের সেখান থেকে উদ্ধার করেন। আমি তোমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাধা দেই। আর মানুষ সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে।’ (বুখারি : ৬৪৮৩)
আহ! কতই না সুন্দর উপমা দিয়ে নিজের ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। প্রিয় নবীজি (সা.) এর উম্মাতী হিসেবে আমাদের মধ্যেও এই ব্যাকুলতা, দরদ থাকা চাই। নিজেদেরকে, নিজেদের পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পুরো দুনিয়াবাসী কীভাবে জাহান্নাম থেকে বেঁচে জান্নাতে যেতে পারে, সেই এক ফিকির আমাদের মধ্যে থাকা চাই। সেই ব্যাকুলতা, দরদ নিয়ে দাওয়াত, মুজাহাদা ও দুয়ায় আত্মনিয়োগ করা চাই। একটি পিঁপড়া বা পাখি থেকে যেন আমরা অধম না হয়ে যাই!!!
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ