অনেকে সুদ ও মুনাফাকে একই মনে করেন। এমনকি ‘সুদ তো মুনাফার মতই’ বলতেও দ্বিধা করেন না। অথচ এ দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, যা নিম্নরূপ:
(ক) সুদ হলো একই জাতীয় জিনিসের বিনিময়ে অতিরিক্ত গ্রহণ করা, যা হারাম (সুরা বাক্বারা: ২/২৭৫; মুসলিম: ১৫৮৮)। আর মুনাফা হলো হালাল ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত লভ্যাংশ।
(খ) সুদ হলো ঋণের শর্ত অনুযায়ী ঋণগ্রহীতা কর্তৃক ঋণদাতাকে মূল অর্থের সঙ্গে প্রদেয় অতিরিক্ত অর্থ। ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘প্রত্যেক ঋণ যা লাভ নিয়ে আসে, সেটিই সুদ’। (ইরওয়া: ১৩৯৭) পক্ষান্তরে মুনাফা হলো উৎপাদনের মূল্য ও উৎপাদন খরচের পার্থক্য।
(গ) সুদ পূর্ব নির্ধারিত। অপরপক্ষে মুনাফা অর্জিত হয় পরে।
(ঘ) সুদে কোনো ঝুঁকি বা অনিশ্চয়তা নেই। অপরপক্ষে কোনো উদ্যোগে বা কারবারে মুনাফা না হয়ে লোকসানও হতে পারে। এক্ষেত্রে মূলধন সরবরাহকারী এবং উদ্যোক্তা উভয়ের ক্ষেত্রেই ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বিদ্যমান।
(ঙ) সুদ কখনই ঋণাত্মক হতে পারে না। বড় জোর খুবই কম বা তাত্ত্বিকভাবে শূন্য হতে পারে। মুনাফা ধনাত্মক, শূন্য এমনকি ঋণাত্মক (অর্থাৎ লোকসান) হতে পারে।
(চ) সুদের ক্ষেত্রে ঋণদাতা সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করে না। পক্ষান্তরে মুনাফা উদ্যোক্তা ও পুঁজির জোগানদাতার সময় ও শ্রম বিনিয়োগের ফল।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন ও সুদকে হারাম করেছেন’ (সুরা বাক্বারা: ২/২৭৫)
ব্যবসার লক্ষ্য হলো সম্পদের প্রবৃদ্ধি ঘটানো বা মুনাফা লাভ করা। ব্যবসার মাধ্যমে মূলধনের মুনাফা লাভ ইসলামে সম্পূর্ণ জায়েজ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না, তোমাদের পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা ব্যতীত।’ (সুরা নিসা ৪/২৯)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনু কাসির (রহ.) বলেন, ‘ধন-সম্পদ উপার্জনে তোমরা অবৈধ পন্থাসমূহ অবলম্বন করো না। তবে ক্রেতা ও বিক্রেতার সম্মতিতে বৈধ ব্যবসা করো এবং এর মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করো’। (হাফেজ ইবনু কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আজিম: ২/১৬১)
মানুষ ব্যবসার মাধ্যমে হালাল উপায়ে যে মুনাফা বা লাভ অর্জন করে, কোরআন মাজিদে তাকে ‘আল্লাহর অনুগ্রহ’ (ফজলুল্লাহ) বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান কর’ (সুরা জুমু’আহ: ৬২/১০)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশ-বিদেশ ভ্রমণে বের হবে’ (সুরা মুজাম্মিল: ৭৩/২০)
পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় হালাল-হারাম বাছ-বিচার না করে যে কোনো উপায়ে মুনাফা অর্জনের অবাধ সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ইসলামি অর্থনীতিতে অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত মুনাফা অবৈধ বা হারাম। কারণ তা শোষণের হাতিয়ার।
ইসলামি শরিয়তে মুনাফা বা লাভের কোনো পরিমাণ নির্ধারিত নেই। বরং তা সাধারণ বাজারদরের ওপর নির্ভরশীল। মূলত ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় হলো- ১. তাতে জুলুম না থাকা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা জুুলুম থেকে বেঁচে থাক। কেননা জুলুম ক্বিয়ামতের দিন ঘন অন্ধকার হয়ে দেখা দেবে’। (মুসলিম: ২৫৭৮) ২. ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতি। (সুরা নিসা ৪/২৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাইতো বলেছেন, ‘ক্রয়-বিক্রয় শুধু পারস্পরিক সম্মতিতে অনুষ্ঠিত হয়’। (ইবনু মাজাহ: ২১৮৫; ইবনু হিববান: ৪৯৬৭)
উরওয়া বিন আবিল জা’দ আল-বারেকি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী করীম (সা.)-এর নিকট পশুর একটি চালানের সংবাদ আসল। তিনি আমাকে একটি দিনার দিয়ে বললেন, উরওয়া! তুমি চালানটির নিকট যাও এবং আমাদের জন্য একটি বকরী ক্রয় করে নিয়ে আস। তখন আমি চালানটির কাছে গেলাম এবং চালানের মালিকের সঙ্গে দরদাম করে এক দিনার দিয়ে দুইটি বকরী ক্রয় করলাম। বকরী দু’টি নিয়ে আসার পথে এক লোকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলো। লোকটি বকরী ক্রয় করার জন্য আমার সঙ্গে দরদাম করল। তখন আমি তার নিকট এক দিনারের বিনিময়ে একটি বকরী বিক্রয় করলাম এবং একটি বকরী ও এক দিনার নিয়ে চলে এলাম। এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! এই হচ্ছে আপনার দিনার এবং এই হচ্ছে আপনার বকরী। তখন রাসুল (সা.) বললেন, এটা তুমি কিভাবে করলে? উরওয়া (রা.) বলেন, আমি তখন তাঁকে ঘটনাটি বললাম। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আল্লাহ! আপনি তার হাতের লেনদেনে বরকত দিন’। (বুখারি: ৩৬৪২)
উক্ত হাদিস থেকে বোঝা যাচ্ছে, বৈধভাবে শতভাগ লাভ করলেও তাতে কোনো সমস্যা নেই।
সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের এক ফতওয়ায় বলা হয়েছে, ‘ব্যবসায়ে লাভ বা মুনাফা নির্ধারিত নেই। বরং সরবরাহ ও চাহিদার অবস্থা অনুপাতে মুনাফা কম বা বেশি হতে পারে। কিন্তু মুসলিম ব্যক্তি ব্যবসায়ী হোক বা অন্য কেউ হোক তার জন্য উত্তম হলো, ক্রয়-বিক্রয়ে সরল ও উদার হওয়া এবং ক্রেতার সরলতার সুযোগ নিয়ে তাকে ক্রয়-বিক্রয়ে ধোঁকা না দেয়া। বরং সে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের অধিকার সমূহের প্রতি খেয়াল রাখবে’। (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ১৩/৯১, ফতওয়া নং ৬১৬১)
সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহ.) এক ফতওয়ায় বলেন, ‘লাভ বা মুনাফার কোনো পরিমাণ নির্ধারিত নেই। বরং বেশি ও কম লাভ করা জায়েজ। তবে বাজারে পণ্য যদি নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট মূল্যে মজুত থাকে তাহলে বিক্রেতার জন্য মানুষকে ধোঁকা দেয়া ঠিক নয়। বরং তার কর্তব্য হলো মানুষকে জানিয়ে দেয়া যে, এ দ্রব্যটি এত মূল্যে (বাজারে) মজুত আছে। কিন্তু আমি এই মূল্যে আমার এ পণ্যটি বিক্রি করব না। এক্ষেত্রে ক্রেতা যদি বেশি মূল্যে তা ক্রয় করতে পষন্দ করে তাতে কোনো দোষ নেই। তবে বিক্রেতা বাজার দাম সম্পর্কে মানুষকে অবগত করবে। আর মূল্য যদি নির্ধারিত না থাকে তাহলে সে যে কোনো মূল্যে বিক্রি করতে পারে’।
ইসলাম সুদের মাধ্যমে মুনাফা লাভের পন্থাকে হারাম ঘোষণা করেছে। তার পরিমাণ কম বা বেশি যাই হোক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সূদের পাওনা যা বাকি রয়েছে, তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা সত্যিকারের মুমিন হয়ে থাক’ (সুরা বাক্বারা: ২/২৭৮)। আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রা.) বলেন, ‘সুদের দ্বারা সম্পদ যতই বৃদ্ধি পাক না কেন তার শেষ পরিণতি হলো নিঃস্বতা’।
সারকথা হলো ইসলামি অর্থনীতিতে বৈধ ও সুবিচারপূর্ণ মুনাফা হচ্ছে-
১. যা সাধারণ সুস্থ-শান্ত অবস্থায় চাহিদা ও সরবরাহের নিয়মাধীন উন্মুক্ত স্বাধীন বাজারে লেনদেনের দরুন অর্জিত হয়।
২. উৎপাদন ব্যবস্থা ও পণ্য বিক্রয়ের কাজে নিযুক্ত শ্রমজীবীদের প্রাপ্য যথাযথভাবে আদায় করার পর ব্যবসায়ীদের নিকট যতটা উদ্বৃত্ত থাকবে।
৩. ব্যবহারকারীদের ক্রয়ক্ষমতা থেকে আনুপাতিক মূল্যে যা অর্জিত হবে।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ