ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

যেসব শ্রেণির সঙ্গে বন্ধুত্ব নয়

প্রকাশনার সময়: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ২২:৪২

যাপিত জীবনে পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্ব মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। যা মহান আল্লাহ তায়ালার অপার নিয়ামতের অন্তর্ভুক্ত। আর বন্ধু মানে জীবন চলার বাঁকে বাঁকে নানা বিষয় ও কাজের সহযোগী। এই সহযোগী বা বন্ধু নির্বাচনে আছে ইসলামের শক্ত নীতিমালা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় যাকে তাকেই বন্ধু বা সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না; বরং বন্ধু সে হবে, যে কল্যাণকর কাজের সহযোগী হবে এবং আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ানোর ক্ষেত্রে সাহায্য সহযোগিতা করবে। অতএব, বন্ধু হবে পরকালের কল্যাণে। এর বিপরীতে যে ব্যক্তি আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং কল্যাণকর কাজ থেকে বিরত রাখে, এমন সব লোকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বা বন্ধুত্বে জড়ানো সঠিক নয়।

কোরআন ও হাদিসে এমন চার শ্রেণির কথা উল্লেখ আছে, যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব সঠিক নয়।

১. কাফির: এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘মুমিনগণ যেন মুমিনদেরকে ছেড়ে কাফিরদেরকে (নিজেদের) মিত্র না বানায়। যে এরূপ করবে, আল্লাহর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তাদের (জুলুম) থেকে বাঁচার জন্য যদি আত্মরক্ষামূলক কোনো পন্থা অবলম্বন করে, সেটা ভিন্ন কথা।’ (সুরা আলে ইমরান: ২৮)

আয়াতে বর্ণিত ওলী বা মিত্র দ্বারা এমন বন্ধুত্ব ও আন্তরিক ভালোবাসাকে বুঝানো হয়েছ, যার দ্বারা দু’জন লোকের জীবনের লক্ষ্য ও লাভ-লোকসান অভিন্ন হয়ে যায়। মুসলিমদের এ জাতীয় সম্পর্ক শুধু মুসলিমদের সঙ্গেই হতে পারে। অমুসলিমদের সঙ্গে এরূপ সম্পর্ক স্থাপন করা কঠিন পাপ। ওপর এক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! মুসলিমদের ছেড়ে কাফিরদেরকে বন্ধু বানিয়ো না। তোমরা কি আল্লাহর কাছে নিজেদের বিরুদ্ধে (অর্থাৎ নিজেদের শাস্তিযোগ্য হওয়া সম্পর্কে) সুস্পষ্ট প্রমাণ দাঁড় করাতে চাও?’ (সুরা নিসা: ১৪৪)

২. জালিম বা অত্যাচারী: এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে শুধু তাদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে বের করার কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করেছে। যারা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে তারাই জালেম।’ (সুরা মুমতাহিনা: ৯)

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অত্যাচারীকে অত্যাচারী হিসেবে জানার পরও তাকে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য তার সঙ্গে চলে, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেল।’ (তবরানী: ১/৩২)

৩. ফাসেক: পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! কোনো ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বসো। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হবে।’ (সুরা হুজরাত: ৬)

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা বোঝা গেল, যেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কোনো ফাসেক ব্যক্তির সংবাদের ওপরও আস্থা রাখা উচিত নয়, সেখানে কিভাবে একজন ব্যক্তি ফাসেকের সঙ্গে সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব স্থাপন করা যায়!

তাছাড়া এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ তার বন্ধুর দিনের ওপর হয়। অতএব, তোমাদের প্রত্যেককে দেখা উচিত যে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করছে।’ (তিরমিজি: ২৩৭৮)

বোঝা গেল, কেউ যদি ফাসেক, তথা পাপাচার, গুনাহগার ও মিথ্যুক ব্যক্তির সঙ্গে ওঠাবসা, চলাফেরা ও বন্ধুত্ব স্থাপন করে, তাহলে তার মাঝেও ওই ব্যক্তির মন্দ গুণাগুণ চলে আসবে।

৪. বিদআতি: শরিয়তের পরিভাষায় বিদআত বলা হয়, যে জিনিস বা কাজ আল্লাহ ও তার রাসুল দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করেননি, সেই ধরনের জিনিস বা কাজকে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করা এবং তা সওয়াব বা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় মনে করে করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদআতের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন এবং তার নানাবিধ খারাপ পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন।

বিদআতের একটি নিকৃষ্ট পরিণাম হলো, ‘কিয়ামতের দিন সে রাসুল (সা.) এর সুপারিশ থেকে বঞ্চিত হবে। নবীজি সাল্লাল্লাহু সালাম ইরশাদ করেন, ‘আমার উম্মতের জন্য আমার সুপারিশ থাকবে, তবে বিদআতিরা সুপারিশ থেকে বঞ্চিত হবে’। (আল-বিদ’উ ওয়ান-নাহিউ আনহা: ৮৫)

ওপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) যেমনিভাবে বিদআতের অনুসরণ নিষেধ করেছেন, তেমনিভাবে বিদআতিকে কোনো প্রকার সম্মান প্রদর্শন করতে নিষেধ করেছেন। ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বিদআতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল, সে যেন ইসলাম ধ্বংস করার কাজে সাহায্য করল’। (তবরানী: ৭৬৭২)

উপর্যুক্ত হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, বিদআতি সে যেই হোক, আলেম হোক বা আলেম না হোক, সে কোনো প্রকার সম্মান পাওয়ার যোগ্য নয়। কারণ সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দুশমন, বিদআত প্রবর্তনকারী মূলত ইসলামের পরিপূর্ণতাকে অস্বীকারকারী। ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর একটি কথা থেকে তা প্রমাণিত হয়, তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোনো বিদআতের প্রচলন ঘটাল আর একে নেক কাজ বলে মনে করল সে যেন প্রকারান্তরে এ কথাই ঘোষণা করল যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পয়গাম পৌঁছাতে খিয়ানত করেছেন’। (নাউজুবিল্লাহ) কারণ যেখানে আল্লাহ তায়ালা নিজে ইরশাদ করেছেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম’। (সুরা মায়িদা: ৩) সুতরাং রাসুল (সা.) তাঁর যুগে যে আমল দ্বীন হিসেবে গণ্য ছিল না তা আজও দ্বীন হিসেবে গণ্য হতে পারে না। অতএব, এ ধরনের দিনবিরোধী ইসলামবিদ্বেষী ও ইসলামকে বিকৃত সাধারণকারী ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা স্থাপনের কোনো প্রশ্নই আসে না?

তাই আসুন! আমরা আমাদের যাপিত জীবনে এ চার শ্রেণির সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতার সম্পর্কে জড়ানো থেকে নিজেকে দূরে রাখি।

মুহাদ্দিস, জামিয়া কাশেফুল উলূম মাদ্রাসা, মধুপুর, টাঙ্গাইল।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ