ঢাকা, বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না

প্রকাশনার সময়: ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১২

সম্পদ আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বড় নেয়ামত। এর দ্বারা জমিন আবাদ করা হয়, বিপদাপদ দূরীভুত হয়, প্রয়োজন পূরণ হয়, বদান্যতা প্রকাশ পায়, সুনাম অর্জন হয় এবং মুসলিমদের কল্যাণে প্রচেষ্টা চালানো যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম লোকের জন্য উত্তম সম্পদ কতই না ভালো।’ (আদাবুল মুফরাদ)

ধন-সম্পদ ছাড়া মানুষের জীবন যাপন সম্ভব নয়। এ জন্যই ধন-সম্পদকে মানুষের নিকট সুশোভিত ও প্রিয় করে দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে প্রবৃত্তির ভালোবাসা- নারী, সন্তানাদি, রাশি রাশি সোনা-রূপা, চি‎‎হ্নিত ঘোড়া, গবাদি পশু ও শস্যক্ষেত। এগুলো দুনিয়ার জীবনের ভোগসামগ্রী। আর আল্লাহ, তাঁর নিকট রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৪)

পৃথিবীর পবিত্র বস্তুসমূহের ক্ষেত্রে মূল হলো, তা মানুষের জন্য হালাল; যেন এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর ইবাদতে সহযোগিতা নিতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সব কিছু নিজ অনুগ্রহে। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন।’ (সুরা আল-জাসিয়া: ১৩)

রাসুলগণের সুন্নাত হলো, হালাল উপার্জন ও পবিত্র বস্তু ভক্ষণ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে রাসুলগণ, তোমরা পবিত্র ও ভাল বস্তু থেকে খাও এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর সে সর্ম্পকে আমি সম্যক জ্ঞাত।’ (সুরা আল-মুমিনুন: ৫১)

পূর্ববর্তী সকল উম্মতকে আল্লাহ তায়ালা ফেতনার মাধ্যমে পরীক্ষা করেছেন। আর এই উম্মতের ফেতনা হলো ধন-সম্পদ। নবী (সা.) বলেছেন, ‘সকল উম্মতেরই ফেতনা রয়েছে, আর আমার উম্মতের ফেতনা হচ্ছে ধন-সম্পদ।’ (মুসনাদে আহমাদ)

বান্দা তার সম্পদ উপার্জন ও ব্যয়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কয়েকটি বিষয়ে জিজ্ঞাসিত না হওয়া পর্যন্ত আদম সন্তানের পা-দ্বয়কে নড়তে দেয়া হবে না। তার বয়স সম্পর্কে কী কাজে তা শেষ করেছে, তার ইলম সম্পর্কে তদানুযায়ী কী আমল করেছে, তার সম্পদ সম্পর্কে কোথা হতে সে তা উপার্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করেছে, তার শরীর সম্পর্কে সে কিসে তা বিনাশ করেছে।’ (সুনানে তিরমিজি)

মানুষের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন চরিত্রের মাপকাঠি ও বদান্যতার ময়দান। কাজেই যে ব্যক্তি মানুষের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করে এবং মানুষেরা তার সত্যবাদিতা ও আমানতদারিতার সাক্ষ্য দেয় সেটা তার বুদ্ধির পরিপূর্ণতা ও দ্বীনি পূর্ণাঙ্গতার নির্দেশক।

মানুষের পারস্পরিক হকসমূহ উদারহীন নীতির ওপর স্থাপিত; এ জন্য আল্লাহ তায়ালা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা এর মাঝে হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টির উপাদান নিহিত রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না।’ (সুরা আল-বাকারা: ১৮৮) অর্থাৎ নানা ধরনের হারাম উপার্জনের মাধ্যমে— যে বিষয়ে আল্লাহ অনুমোদন দেননি অথবা মালিকের অন্তর সন্তুষ্ট নয়। আর সম্পদ হারাম হওয়ার বিষয়টি মানুষের রক্তপাত এবং সম্মানহানী করার মতোই হারাম। রাসুল (সা.) কুরবানির দিন মিনাতে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, ‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ এবং তোমাদের মানসম্মান তোমাদের পরস্পরের ওপর তেমন হারাম, যেমন হারাম তোমাদের এই দিন, তোমাদের এই মাস এবং তোমাদের এই শহর।’ (বুখারি ও মুসলিম

মানুষের মাঝে ধন-সম্পদের লেনদেন একটি বৈধ নীতি; তাদের জীবনে এর কোনো বিকল্প নেই। কেবল সত্যবাদিতা ও আমানতদারিতার মাধ্যমেই মানুষ সম্পদ ভোগ ও তা থেকে উপকার অর্জন করতে পারে। মানুষের আর্থিক লেনদেনে অনুপ্রবেশ করার জন্য শয়তানের অনেকগুলো প্রবেশদ্বার রয়েছে, যেগুলো দিয়ে সে তাতে অনুপ্রবেশ করে তাদেরকে হারাম লেনদেনে জড়িত করে। আর কঠিন শাস্তির হুমকি সম্বলিত অসংখ্য দলিল বর্ণিত হয়েছে ওই ব্যক্তির জন্য, যে শয়তানের ফাঁদে পড়ে নানা উপায়ে অবৈধ পন্থায় মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করে।

মানুষের মাঝে লেনদেনে স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা বজায় রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। যে ব্যক্তি এ মূলনীতির বিপরীতে গিয়ে তার ভাইয়ের নিকট কোনো হারাম জিনিস বিক্রয় করল বা এমন কিছু বিক্রয় করল যা নিজের মালিকানাধীন নয় অথবা যা আয়ত্ব করা এবং তা দ্বারা উপকৃত হওয়া সম্ভব নয়; তাহলে সে ব্যক্তি নিষিদ্ধ বিষয়ে জড়িয়ে পড়ল।

শরিয়তের অনুমোদনহীন ধোঁকাপূর্ণ বা অজ্ঞতাপূর্ণ কোনো কিছু বিক্রয় করা অথবা পণ্যে প্রতারণা করা এমন কাজ যার বিরুদ্ধে শাস্তির হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একদা রাসুল (সা.) স্তূপকৃত খাদ্যশস্যের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি স্তূপের মধ্যে হাত ঢুকালেন। তার হাতের আঙ্গুলগুলোয় আর্দ্রতা দেখতে পেলেন। তিনি বললেন, ‘হে খাদ্যশস্যের মালিক! এটা কী?’ সে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এতে বৃষ্টি পড়েছিল। রাসুল (সা.) বললেন, ‘কেন তুমি ভেজা অংশ খাদ্যশস্যের ওপরে রাখনি, যাতে লোকেরা তা দেখতে পায়। যে ব্যক্তি ধোঁকা দেয় সে আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না।’ (মুসলিম)

মুমিনরা একই বন্ধনে আবদ্ধ। আর তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটায় ধন-সম্পদে নিন্দিত প্রতিযোগিতা। সুতরাং কোনো ব্যক্তি যদি তার ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর ক্রয়-বিক্রয় করে বা তার দর-দামের ওপর দর-দাম করে অথবা নিজে কোনো পণ্য ক্রয়ে অনাগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও তার দাম বাড়িয়ে বলে যাতে পণ্যটি তার অপর ভাইয়ের হাতছাড়া হয়ে যায়; তাহলে সে হারাম কাজ করল। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পরে হিংসা পোষণ করো না, ধোঁকাবাজি করো না, বিদ্বেষ লালন করো না, একে অপরের পশ্চাতে শত্রুতা করো না এবং একজনের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর অন্যজন ক্রয়-বিক্রয় করবে না।’ (মুসলিম)

আল্লাহ মহান। সুতরাং মর্যাদাপূর্ণ বিষয়েই তাঁর নামে শপথ করা উচিত। আর মুমিন ব্যক্তি লেনদেনে অযথা শপথ করা থেকে মুক্ত থাকে। কেউ যদি তার পণ্য ক্রয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করতে সত্য শপথও করে তাহলে তার সম্পদের বরকত উঠিয়ে নেয়া হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কসম পণ্য চালু করে দেয় কিন্তু বরকত নিশ্চিহ্ন করে দেয়।’ (বুখারি)

আর যে ব্যক্তি মানুষের মাঝে তার পণ্য ব্যাপক বিক্রয়ের আশায় তার ওপর মিথ্যা শপথ করল, সে মূলত অনেকগুলো অপরাধ করল— মিথ্যা বলা, আল্লাহর ব্যাপারে উদাসীনতা প্রদর্শন এবং ক্রেতাকে ধোঁকা দেয়ার অপরাধ। আবু যর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির সঙ্গে কেয়ামত দিবসে আল্লাহ কথা বলবেন না, তাদের প্রতি তাকাবেন না এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ বর্ণনাকারী বলেন: তিনি এটা তিনবার পাঠ করলেন। আবু যর (রা.) বলে উঠলেন, তারা ধ্বংস হবে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হে আল্লাহর রাসুল তারা কারা? তিনি বললেন, ‘তারা হচ্ছে- যে টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পরে, যে দান করে খোঁটা দেয় এবং যে মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করে।’ (মুসলিম)

অঙ্গিকার পূর্ণ করা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা এবং পারস্পরিক শর্ত মেনে চলা দ্বীনের উত্তম শিষ্টাচারের অন্তর্গত যা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ কর।’ (সুরা আল-মায়েদা: ০১) রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমানগণ তাদের একে অপরের মধ্যে স্থিরকৃত শর্তাবলি মেনে চলতে বাধ্য। কিন্তু হালালকে হারাম অথবা হারামকে হালাল করার মতো শর্ত মেনে চলতে বাধ্য নয়।’ (তিরমিজি)

ক্রেতা সম্পূর্ণ মালের অধিকার লাভ করবে। আর ওজনে হ্রাসকারী ব্যক্তি ক্রেতার অধিকার খর্ব করার কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষতি ও ধ্বংসের ভীতি প্রদর্শন করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ধ্বংস যারা পরিমাপে কম দেয় তাদের জন্য। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে। আর যখন তাদেরকে মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়।’ (সুরা আলমুতাফফিফিন: ০১-০৩)

শ্রমিকের ক্ষেত্রে শর্ত হলো তার মাঝে শক্তি ও আমানতদারিতার গুণ বিদ্যমান থাকা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আপনার মজুর হিসেবে উত্তম হবে সে ব্যক্তি, যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত।’ (সুরা আল-কাসাস: ২৬)

আর যে ব্যক্তি কোনো কাজ না জানা সত্ত্বেও তা জানার দাবি করে এবং ওই কাজের মাধ্যমে সে মানুষের নিকট থেকে অর্থ, সম্পদ গ্রহণ করে; সে মূলতঃ তার নিকট যা নেই তা থাকার মিথ্যা দাবি করল। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাকে যা দেয়া হয়নি তা দেয়া হয়েছে বলা ওইরূপ প্রতারকের কাজ, যে প্রতারণার জন্য দু’প্রস্ত মিথ্যার পোশাক পরল।’ (বুখারি ও মুসলিম)

আল্লাহ তায়ালা জালিমদের প্রতিপক্ষ এবং তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, তিন ব্যক্তির অন্যায় কর্মকাণ্ডের কারণে তাদের বিরুদ্ধে তিনি বাদী হবেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো সে ব্যক্তি; যে খাদেম ও শ্রমিকের অধিকার আদায় করে না অথবা অধিকার আদায়ে বিলম্ব করে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন যে, কেয়ামত দিবসে আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব। যে ব্যক্তি আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। যে ব্যক্তি কোনো আজাদ মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। আর যে ব্যক্তি কাউকে মজুর নিয়োগ করে তার থেকে পুরো কাজ আদায় করে তার পারিশ্রমিক দেয় না।’ (বুখারি)

আর যে ব্যক্তি অন্যের প্রতি ইহসান করল অথবা তাকে ঋণ প্রদান করল সে শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা পাওয়ার উপযুক্ত। সক্ষম ঋণগ্রহীতা যদি তার ঋণ পরিশোধ না করে বা পরিশোধে বিলম্ব করে, তাহলে সে ঋণদাতার ওপর জুলুমকারী ও তার ইহসান অস্বীকারকারী হিসাবে গণ্য হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ধনী ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করা জুলুম।’ (বুখারি ও মুসলিম) হকদারকে তার প্রাপ্য প্রদান এবং অনুপোযুক্ত ব্যক্তি যা চায় তা না দেয়ার ওপর মানুষের হকসমূহ স্থাপিত। আর ঘুষ দাতা এবং ঘুষ গ্রহীতা উভয়েই আল্লাহর লানতপ্রাপ্ত। ইবনে আমর (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতাকে অভিসম্পাত করেছেন।’ (তিরমিজি)

যে কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করল বা কোনো পদে অধিষ্টিত হলো অথবা ফরজ জাকাত আদায়ের জন্য তাকে নিয়োগ দেয়া হলো; অতঃপর সে মানুষের কাছ থেকে উপহার-উপঢৌকন গ্রহণ করল, সে আত্মসাৎকারী হিসেবে গণ্য হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি যাকে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করে পাঠাই, তার কী হলো যে, সে ফিরে এসে বলে— এই মাল আপনাদের এবং এই হাদিয়া আমাকে দেয়া হয়েছে! সে তার পিতা-মাতার গৃহে বসে থেকে দেখল না কেন, তাকে হাদিয়া দেয়া হয় কিনা? যার হাতে আমার জীবন, সেই মহান সত্তার কসম! তোমাদের কেউ জাকাতের সম্পদ হতে কোনো জিনিস আত্মসাৎ করলে কেয়ামতের দিন সে তা কাঁধে বহন করে নিয়ে উপস্থিত হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

(১০ রবিউস সানি ১৪৪৪ হিজরি মোতাবেক ৪ নভেম্বর ২০২২ ঈসাব্দ মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার অনুবাদ)

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ