বিয়ে, একটি নির্মল বন্ধন, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। জীবনকে সুন্দর আর সুখময় করে তোলার উৎকৃষ্ট মাধ্যম।
প্রতিটি মানুষই পরিণত বয়সে পৌঁছে খুঁজে বেড়ায় জোছনা ছড়ানো একটি চাঁদকে, তালাশ করে শুভ্র-সুন্দর একটি পুষ্পকে। যে চাঁদের আলোয় আলোকিত হবে তার জীবন-জগৎ, যে পুষ্পঘ্রাণে মোহিত হবে তার ছোট কুঁড়েঘর।
বিয়ে মানে জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বিয়ে মানে অপরিচিত দুজন মানুষের নতুন করে পথচলা। কিন্তু আফসোস! অনেক সময়ই এ পথচলা আর সূচনাটাই হয় নানা রকম কুসংস্কার আর অপসংস্কৃতি দিয়ে। সমাজের প্রচলিত এসব অপসংস্কৃতি যেন অঘোষিতভাবেই বাঙালির সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যা খুবই নিন্দনীয় এবং পরিহারযোগ্য।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া এসব জাহেলি কুপ্রথার অবসান ঘটুক, শরয়ি দিকনির্দেশনা অনুযায়ী বিয়ে সম্পাদিত হোক, আর বর-কনে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা, আর এ প্রত্যাশা থেকে দু’কলম লেখার চেষ্টা।
নিচে বিয়ের অপসংস্কৃতিগুলোকে দলিলের আলোকে বিশ্লেষণ করা হলো-
পাত্রী দেখার অনিয়ম
আমাদের দেশে ঘটা করে কনে দেখতে গিয়ে বরের পাশাপাশি বাবা, বন্ধুরাও আসে। যা ইসলাম সমর্থন করে না। পাত্রীকে শুধুই পাত্র এবং পাত্রের কাছে মহিলারা দেখতে পারবে। পাত্র ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ দেখলে পর্দা লঙ্ঘনের গুনাহ হবে।
মুগিরা বিন শোবা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.) এর কাছে গিয়ে এক নারীকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। তিনি আমাকে বললেন, আগে যাও, তাকে দেখে নাও। কারণ এ দেখাদেখি তোমাদের বন্ধনকে অটুট রাখতে সহায়ক। (বুখারি- হাদিস: ৪৮৩৩)
গায়ে হলুদ হিন্দু সংস্কৃতি
সম্প্রতি বিয়ে-শাদীতে গায়ে হলুদ সংস্কৃতি মহামারি আকার ধারণ করেছে। আর গায়ে হলুদকে কেন্দ্র করে অনেক আয়োজন, অনুষ্ঠান, গান বাজনা ও আর ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশার মতো নির্লজ্জ ঘটনাও প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে।
মূলত গায়ে হলুদ বিজাতীয় সংস্কৃতি। সনাতন ধর্মে সব ধর্মীয় উপাসনাতেই হলুদ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ। তারা বিশ্বাস করে, হলুদ রঙ অশুভ শক্তিকে দূরে রাখে। হলুদ এবং তেলের মিশ্রণ নব বর, বধূর জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে ইত্যাদি...।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে।’ (আবু দাউদ: হাদিস, ৪০৩১)
অতএব একজন মুসলিম বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে বিরত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। এটাই ঈমান এবং মুসলমান হওয়ার দাবি।
গভীর রাত অবধি গানবাজনা
বিয়েকে কেন্দ্র করে গভীর রাত অবধি চলে গানবাজনা। অশ্লীলতা আর বেহায়াপনায় মেতে ওঠে তরুণ-তরুণীরা। সাউন্ড বক্সের উচ্চাওয়াজে ব্যাঘাত ঘটে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়, বিঘ্ন্ন ঘটে ঘুম-নিদ্রায়। একজন মুসলিম তো কোনো হারাম কাজে জড়িত হতে পারে না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মদ, জুয়া ও সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন’ (মিশকাত: হাদিস ৪৫০৩)
সর্বোপরি প্রকৃত মুসলমান তো সে-ই যে কারও কষ্টের কারণ হয় না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রকৃত মুসলিম সেই যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ (বুখারি: হাদিস, ১০)
বিয়েতে অধিক অপচয় করা
বিয়ে বাড়িতে জাঁকজমক আর আড়ম্বর অনেক বেশি করা হয়। একদিকে যেমন আল্লাহর নিয়ামত খাবারের অপচয় হয় অন্যদিকে বিয়েকে কেন্দ্র করে গেইট, লাইট, ভিডিও, মঞ্চ তৈরি করা ইত্যাদি বিষয় বাহুল্য খরচের দাগটি আরও বাড়িয়ে দেয়। অনেককে দেখা যায়, টাকা না থাকলেও ধার-কর্জ করে বা সুদের ওপর ঋণ করে এনেও বিয়ের জমকালো আয়োজন করেন। অথচ ইসলাম অনাড়ম্বর বিয়েটাই বেশি বরকতপূর্ণ বলে আখ্যা দিয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে বিয়ে যত সহজ এবং স্বল্পব্যয়ী হয় সে বিয়ে ততই শান্তি ও বরকতময় হয়। (মিশকাত: হাদিস, ১৯৫৮)
বিয়ের গোসল ভাবিরা দেয়া
আমাদের দেশে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে ভাবিরা দেবরকে বিয়ের গোসল দেয়ার প্রথা আছে। যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং পরিহারযোগ্য। ইসলামে দেবরকে গোসল দেয়া দূরের কথা বরং মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা (মাহরাম নয় এমন) নারীদের কাছে যাওয়া পরিত্যাগ কর। এক আনসারী ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! দেবর সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? তিনি বললেন, দেবর তো মৃত্যু সমতুল্য।’ (বুখারি: হাদিস, ৫২৩২)
বিয়ের অনুষ্ঠানে সেলফি তোলা
বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোর আরেক গর্হিত কাজ সেলফি তোলা। অনেক ধর্মপ্রিয় মানুষও সেলফি তোলাকে গুনাহের কাজই মনে করে না। খুবই আফসোসের বিষয় হচ্ছে, মুসলমানের বহু কাঙ্ক্ষিত ইবাদত হজ ও তাওয়াফেও পৌঁছে গেছে এ সেলফি ভাইরাসের দৌরাত্ম্য। রাসুল (সা.) বলেন, প্রত্যেক ছবিনির্মাতা জাহান্নামে যাবে, তার নির্মিত প্রতিটি ছবি পরিবর্তে একটি করে প্রাণ সৃষ্টি করা হবে, যা তাকে জাহান্নামে শাস্তি দিতে থাকবে। (বুখারি: হাদিস, ২২২৫)
বিয়েতে যৌতুক দাবি করা
আরেকটি ঘৃণিত ও গর্হিত কাজ হচ্ছে, বিয়েকে উপার্জনের মাধ্যম বানানো। পাত্রীর পরিবারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যৌতুক দিতে বাধ্য করানো। এটা শুধু জুলুম নয়, অনেক বড় জুলুম। আর তা শুধু ব্যক্তির ওপর নয়, গোটা পরিবার ও বংশের ওপর জুলুম। অথচ আল্লাহ তায়ালা কাউকে জুলুম করে সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভক্ষণ করো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৮)
অধিক পরিমাণে মোহর দাবি করা
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তাদের ন্যায়সঙ্গত মোহর আদায় করো’। (সুরা নিসা: ২৫)
আল কোরআনের ভাষায় ‘ন্যায়সঙ্গত মোহর’ বলা হয়েছে। অতএব এ ব্যাপারে স্বামীর অর্থনৈতিক শক্তি-সামর্থ্য বিবেচনা করে যৌক্তিকভাবে মোহর নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু বর্তমান সমাজে মোহরানা বিষয়ে মেয়েদের পক্ষ থেকে অনেক বেশি বাড়াবাড়ি করা হয়। ছেলের সাধ্যের বাইরে গিয়ে তার ওপর একটি বড় বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়। এটা চরম অন্যায়। আল্লাহ তায়ালা কাউকে তার সাধ্যের বাইরে বোঝা চাপিয়ে দেয়া পছন্দ করেন না।
মোহর আদায়ে শিথিলতা প্রদর্শন করা
বর্তমানে মোহর পরিশোধ না করা অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। মোহর যে স্ত্রীর অপরিহার্য অধিকার এবং স্বামীর অবশ্য পালনীয় কর্তব্য তার কোনো চিন্তা বা গরজ কারোর ভিতরই থাকে না। অথচ রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে পুরুষ কোনো নারীকে বিয়ের সময় মোহরানা নির্ধারণ করে, তবে আল্লাহ তায়ালা তার অন্তরের খবর জানেন যে, তার তা আদায় করার নিয়ত নেই। ফলে সে আল্লাহর হকের মধ্যে ওই নারীকে ধোঁকা দিল এবং তার লজ্জাস্থানকে অন্যায়ভাবে ভোগ করল। এমন ব্যক্তি কিয়ামতের দিবসে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে ব্যভিচারী হিসেবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৮৯৩২)
টাকা কিংবা উপহার সামগ্রী নেয়া
অনেক জায়গায় গেট সাজিয়ে সেখানে বর পক্ষের লোকদের আটকে রেখে জোর করে টাকা আদায় করে। কখনোবা খাওয়া শেষে কনেপক্ষের লোকেরা বরের হাত ধুয়ে দিয়ে টাকা দাবি করে বসে।
আবার কখনো ঈদের সময় জামাইকে এবং তার ভাই-বোনদেরকে কাপড়-চোপড় দেয়া বা অন্য কোনো মৌসুমে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে চাল, আটা, ময়দা, পিঠা ইত্যাদি পাঠানো এবং এ প্রচলনকে জরুরি মনে করার প্রথা অনেক জায়গায় চালু আছে। এগুলো না দিলে এ নিয়ে নানারকম অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। এসব তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক জায়গায় বিবাহ ভেঙে যেতেও দেখা গেছে।
অথচ কারও স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ব্যতীত তার থেকে কিছু গ্রহণ করাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সাবধান! কারও জন্য তার ভাইয়ের কিছুমাত্র সম্পদও বৈধ নয়, যদি তার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি না থাকে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৫৪৮৮)
অশ্লীলতার ছড়াছড়ি
আজকাল বিয়ের অনুষ্ঠানে বেগানা নারীদের সাজ-সজ্জা করে নিজেকে বিকশিত করা এবং যুবক যুবতিদের অবাধ মেলামেশা একটা মহামারি রূপ ধারণ করেছে। পর্দা যে ফরজ বিধান, এ অনুভূতি যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের বাসস্থানে অবস্থান করবে এবং জাহেলি যুগের সৌন্দর্য প্রদর্শনের মতো তোমরা তোমাদের প্রদর্শন করবে না, তোমরা যথাযথভাবে নামাজ আদায় করবে এবং জাকাত প্রদান করবে।’ (সুরা আহজাব: ৩৩)
কুসংস্কার সৃষ্টির কারণ ও প্রতিকার
কোনো সংস্কৃতি যখন ইসলামি কার্যকলাপে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে এবং নৈতিকতা বিবর্জিত হয় তখন তা অপসংস্কৃতি ও কুসংস্কার বলে চিহ্নিত হয়। এ অসংস্কৃতির প্রভাবে জাতি তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে, হারিয়ে ফেলে মনুষ্যত্ব আর মানবতা। সমাজে এ ধরনের কুসংস্কার সৃষ্টির প্রধান কারণ হলো ঈমান ও ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা। ইসলামের প্রথম কথাই হলো ‘ইকরো’ পড়ো এবং অজানাকে জয় করো। অতএব এসব অপসংস্কৃতি থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে হবে এবং ঈমান ও ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশের পর একজন মুসলিমের ওপর কী দায়িত্ব অর্পিত হতে পারে- সর্বত্র এ আলোচনার প্রচার-প্রসার ঘটাতে হবে। ঈমান ও ইসলামই মুক্তির মূলমন্ত্র। কারণ একজন মানুষ ঈমান ও ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশ করার পর নিজস্ব মত প্রয়োগের এবং ঐশী বিধান লঙ্ঘনের যেমন কোনো অধিকার থাকে না তেমনি কোনো অধিকার থাকে না শরিয়তবহির্ভূত কোনো আচার-প্রথা ও সংস্কার-সংস্কৃতি অনুসরণেরও।
এজন্যই তো যখন সাহাবায়ে কেরাম ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়েছিলেন তখন জাহেলিয়াতের সব স্বভাব, বৈশিষ্ট্য ও সমগ্র বিধিবিধানকেই তারা গ্রহণ করেছিলেন। জাহেলিয়াতের কোনো কিছু তারা বাকি রাখেননি এবং ইসলামের কোনো কিছু বাদ রাখেননি। আর এ জীবনবিপ্লব তাদের মধ্যে ঘটে যেত ইসলামকে জানার এবং মানার পরই, কোনো বিলম্ব ছাড়াই।
বিয়েও একটি ইবাদত
একটি ঘর, একটি সমাজ, একটি রাষ্ট্র ও একটি সভ্য জাতি বিনির্মাণে বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কল্যাণের ধর্ম ইসলামে বিয়ের প্রতি নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং বিয়েকে ঈমানের অর্ধেক বলে অভিহিত করা হয়েছে। নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যখন বিয়ে করল তখন সে দ্বীনের অর্ধেকটা পূর্ণ করে ফেলল। এখন সে যেন বাকি অর্ধাংশের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে।’ (মিশকাত ২/২৬৮)
আবার বিয়ে থেকে বিমুখতা পোষণকারীকে দেয়া হয়েছে কঠোর ধমকিও- বর্ণিত হয়েছে, ‘বিয়ে আমার সুন্নত। অতএব যে আমার সুন্নত পালন থেকে বিরত থাকবে, সে আমার অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১০৩৯০)
আসুন! বিয়েকে ইবাদত হিসেব, নবীজির সুন্নত পালনের উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ শরিয়া মোতাবেক সম্পন্ন করি, অপসংস্কৃতি থেকে নিজে দূরে থাকি, অন্যকেও দূরে রাখি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুক। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, উচ্চতর গবেষণা বিভাগ, শায়েখ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ