ঢাকা, শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মালিকানা ও লেনদেনে অস্বচ্ছতা নয়

প্রকাশনার সময়: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬:৩৪

কোরআন মজিদের সর্বাধিক দীর্ঘ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জাতিকে হেদায়েত দান করেছেন যে, যখন তোমরা বাকিতে লেনদেন করবে তখন তা লিখে রাখবে। সাধারণ বাকি লেনদেনকেই যখন লিখে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তখন যৌথ কারবারের মতো জটিল বিষয়টিতে কার প্রাপ্য কী হবে তা লিখে রাখার গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়।

এই নির্দেশ এ জন্যই দেয়া হয়েছে, যাতে পরবর্তীতে ঝগড়া-বিবাদ ও মতবিরোধ সৃষ্টি না হয়। আর হলেও তা ন্যয়নীতির সঙ্গে সমাধান করা যায়।

অতএব কোনো ব্যবসায় যদি একাধিক ব্যক্তি কাজ করে তাহলে প্রথম ধাপেই এ বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া জরুরি যে, এ ব্যবসায় কার কী অবস্থান হবে। এমনকি যদি বাবার ব্যবসায় ছেলে অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলেও প্রথমদিনেই এ বিষয়টি শরিয়তের দৃষ্টিতে চূড়ান্ত হওয়া জরুরি যে, সে কি বেতনের ভিত্তিতে কাজ করবে, না ব্যবসার যথারীতি অংশীদার হিসেবে, কিংবা কেবল বাবার সাহায্যকারী হিসেবে। বেতনের ভিত্তিতে হলে বেতনের পরিমাণ নির্ধারিত হওয়া উচিত। আর যদি পিতা তাকে ব্যবসার মালিকানায় অংশীদার বানাতে চায় তাহলে শরিয়তের দৃষ্টিতে এর প্রথম শর্ত হলো, ছেলের পক্ষ থেকে ব্যবসায় মূলধন যুক্ত করা (এ মূলধন সংযুক্তির একটি পন্থা এও হতে পারে যে, পিতা ছেলেকে কিছু নগদ অর্থ প্রদান করবে। ছেলে ওই অর্থ দ্বারা ব্যবসার নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ ক্রয় করে নিবে। দ্বিতীয় বিষয়টি লিখিত আকারে যৌথ ব্যবসার ডকুমেন্ট স্বরূপ সংরক্ষণ করা উচিত। ডকুমেন্টে এ বিষয়টিও সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা জরুরি যে, লভ্যাংশের কে কত শতাংশ পাবে। যাতে পরবর্তীতে কোনো প্রকার জটিলতা সৃষ্টি না হয়।

যদি কোনো অংশীদারের ব্যবসায় অধিক সময় দিতে হয়, অধিক দায়িত্ব পালন করতে হয় তাহলে এ বিষয়টিও পরিষ্কার হওয়া উচিত যে, অধিক কাজ কি বিনিময়হীন স্বেচ্ছা সেবা হিসেবে করবে, না এর বিনিময়ে সে পারিশ্রমিক বা লভ্যাংশের হার বৃদ্ধি করে নিবে। মোটকথা, দায়-দায়িত্ব ও প্রাপ্য সকল বিষয়ই স্পষ্ট হওয়া জরুরি। আর যদি সহযোগী হিসেবে পিতার ব্যবসায় বিনিময়হীন স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে থাকে তাহলে ব্যবসা হতে সে কিছুই পাবে না

যদি কারো যৌথ ব্যবসায় উপরোক্ত বিষয়গুলো এখনো চূড়ান্ত না করা হয় তাহলে অতি দ্রুত তা চূড়ান্ত করা বাঞ্ছনীয়। এ ব্যাপারে লজ্জা, তিরষ্কার, তাচ্ছিল্য কিংবা উদারতা কোনো কিছুই প্রতিবন্ধক হওয়া উচিত নয়। যৌথ কারবারের এ স্বচ্ছতাকে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ঐক্যের পরিপন্থী মনে করা মস্ত বড় শয়তানি ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়; বরং ঐক্য ও সম্প্রীতির স্থায়িত্ব এ স্বচ্ছতার ওপরই নির্ভরশীল। অন্যথায় এ বাহ্য ভালোবাসাই শত্রুতার জন্ম দিবে। আর এজন্য ইসলামের সোনালী শিক্ষা হলো, ‘ভ্রাতৃত্বের আবহে বসবাস কর আর অপরিচিতের ন্যায় লেনদেন কর।’

২. আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্যও এককভাবে গৃহ নির্মাণ বড় কঠিন বিষয়। তাই সাধারণত গৃহ ক্রয় বা নির্মাণ পরিবারের একাধিক সদস্য মিলে যৌথভাবেই হয়ে থাকে। বাবা বাড়ি নির্মাণ করলে ছেলেরাও সামর্থ্য অনুপাতে নিজেদের অর্থ দিয়ে থাকে। সাধারণত তা কোনো বিষয় চূড়ান্ত করা ছাড়াই হয়ে থাকে। (কী পরিমাণ দেয়া হচ্ছে তার হিসাবও রাখা হয় না।) তা কি ছেলের পক্ষ থেকে বাবার জন্য হাদিয়া-সহযোগিতা, না ঋণ, নাকি বাড়ির মালিকানায় অংশগ্রহণ কিছুই স্বচ্ছ থাকে না। অথচ হাদিয়া বা দান হলে বাড়ির মালিকানায় সে অংশীদার হবে না এবং এ টাকা সে কখনো ফেরত পাবে না। ঋণ হলে বাড়ির একক মালিকানা পিতার হবে আর ছেলের প্রদত্ত অর্থ পিতার দায়িত্বে ঋণস্বরূপ থাকবে। আর যদি বাড়ির মালিকানায় অংশীদার হওয়ার জন্য টাকা দেয়া হয় তাহলে অর্থের পরিমাণ অনুযায়ী বাড়ির মালিকানা লাভ করবে। বাড়ির মূল্য বৃদ্ধি ঘটলে তার প্রাপ্য মালিকানারও মূল্য বৃদ্ধি পাবে। মোটকথা প্রত্যেক অবস্থার ফলাফল ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু যেহেতু অর্থ দেয়ার সময় কোনো বিষয় চূড়ান্ত করা হয়নি, প্রদত্ত টাকার হিসাবও রাখা হয়নি তাই পরবর্তীতে কোনো বিরোধ দেখা দিলে বিশেষ করে এ অবস্থায় বাবার মৃত্যু হলে উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টনে অবর্ণনীয় জটিলতার সৃষ্টি হয়। যারা গৃহ নির্মাণে অর্থ ব্যয় করেছে তাদের সঙ্গে অন্যদের সীমাহীন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কখনো এ বিবাদে পুরো বংশে জড়িয়ে যায়।

যদি ইসলামের সোনালি শিক্ষা অনুসরণ করে গৃহ নির্মাণের পূর্বেই এ বিষয়টি চূড়ান্ত করা হতো আর তা লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হতো তাহলে পারিবারিক এ দ্বন্দ্ব-কলহের সুযোগ সৃষ্টি হতো না।

৩. পরিবারের কোনো ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করলে শরিয়তের নির্দেশ হলো অনতিবিলম্বে তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি উত্তরাধিকারদের মাঝে বণ্টন করে দিতে হবে। কিন্তু আমাদের সমাজে শরিয়তের এ নির্দেশ পালনে চরম অবহেলা-উদাসীনতা বিরাজমান। কোথাও তো হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে যে যা পায় তার ওপরই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। আবার কোথাও এমন মন্দ নিয়ত না থাকলেও অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণে সম্পত্তি বণ্টন করা হয় না। যদি মৃত ব্যক্তির কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য থাকে তাহলে জীবদ্দশায় যে সন্তান তার দেখাশুনা বা সহযোগিতা করত সেই তা দেখাশোনা করতে থাকে। কিন্তু এ বিষয়টি পরিষ্কার করা হয় না যে, এখন ব্যবসার মালিকানা কার, আর তা কী পরিমাণ। উত্তরাধিকারীদের অংশ কী হারে পরিশোধ করা হবে। ব্যবসায় যে ভাই শ্রম দিচ্ছে সে এর বিনিময়ে কী পাবে; বরং কেউ যদি সম্পত্তি বণ্টনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাহলে তার এ প্রস্তাবকে সমাজে ঘৃণিত ও দোষনীয় মনে করা হয়। বলা হয় মৃত ব্যক্তির কাফনও এখনো পুরাতন হয়নি জীবিতরা সম্পদ ভাগ বাটোয়ারার ধান্ধায় পড়ে গেছে।

অথচ এ বণ্টন শরিয়তের নির্দেশ, স্বচ্ছ মালিকানার দাবিও বটে। কিন্তু এদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। আর এ অবহেলার ফলাফলই কিছুদিন পর প্রকাশ পেতে থাকে। সময় অতিবাহিত হলে পরস্পরের নিজ প্রাপ্য ও অধিকারের কথা স্মরণ হয়। অসন্তোষ ও ক্ষোভ জন্মাতে থাকে। সময়ের ব্যবধানে পরিত্যক্ত সম্পত্তির মূল্য বৃদ্ধিতে বড় ধরনের তারতম্য ঘটে গেলে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহও বড় আকার ধারণ করে। সে দ্বন্দ্ব-কলহের উপযুক্ত কোনো সমাধানও খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন এ বিবাদ হাটে ঘাটে প্রসার লাভ করে। এমনকি কখনো আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

যদি শরিয়তের নির্দেশ অনুযায়ী যথাসময়ে সম্পদ বণ্টন হয়ে যেত তাহলে সকলের সন্তুষ্টিতে সব বিষয় মীমাংসা হয়ে যেত। সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পেত।

উপরোক্ত আলোচনায় সমাজে প্রচলিত কেবল তিনটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হলো। অন্যথায় সমাজে বিস্তৃত ঝগড়া-বিবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হলে দেখা যাবে মালিকানার অস্বচ্ছতা ও লেনদেনের অপরিচ্ছন্নতা মহামারির আকার ধারণ করে আছে, যার ফলে সৃষ্ট হচ্ছে অসংখ্য অগণিত ফেতনা-ফ্যাসাদ, দ্বন্দ্ব-কলহ। লেনদেন ছোট হোক বা বড় তা পরিষ্কার হওয়া উচিত। তার শর্তসমূহ স্বচ্ছ ও অস্পষ্টতামুক্ত হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে কোনো সংকোচ, লজ্জা, উদারতা বা লৌকিকতা কোনো কিছুই প্রতিবন্ধক হওয়া উচিত না। এভাবে লেনদেনের শর্তসমূহ পরিষ্কার করে পারস্পরিক যত সদাচার করা যায় ততই ভালো। নিজে ত্যাগ স্বীকার করে অন্যকে প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করাই কাম্য। বলাবাহুল্য, এটিই উদ্দেশ্য হলো শরিয়তের এ নীতির-‘ভ্রাতৃত্বের আবহে বসবাস কর আর অপরিচিতের ন্যায় লেনদেন কর।’

(জিকর ও ফিকর’ থেকে গৃহীত

অনুবাদ : মাওলানা শাববীর আহমদ)

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ