প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাধারণত আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য সতর্কতামূলক বার্তা। আর আমাদের এ পৃথিবী মহাশূন্যে ভাসমান অন্যান্য গ্রহের মতো একটি গ্রহ। দৃষ্টিতে পড়ার মতো এর কোনো খুঁটি বা পিলার নেই। এর চার দিকেই বিশাল শূন্যতা বিরাজ করছে। এ পৃথিবীর পরিধি হচ্ছে ২৫ হাজার মাইল এবং আয়তন ২০ কোটি ১৯ লাখ বর্গমাইল। এটি দেখতে অনেকটা কমলালেবুর মতো চ্যাপ্টা গোলাকার। এর চেয়ে বহু বড় গ্রহ-নক্ষত্র মহাশূন্যে ভাসমান রয়েছে।
মানুষের এ সুন্দর পৃথিবীতে প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসলীলার কারণেই সাধিত হয় ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, প্লাবন, মহামারি, ভূমিকম্প ইত্যাদি। একে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে থাকি। এসব বিপর্যয় কেন সংঘটিত হয়? এসব ভয়াবহ বিপদের কারণ কী? মহানবী (সা.) কর্তৃক প্রদত্ত ভবিষ্যদ্বাণীতেই এর জবাব পরিলক্ষিত হয়।
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন এবং পাপ-পুণ্যের পথ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। কেউ যদি স্বেচ্ছায় পাপের পথে পা বাড়ায়, তাহলে আল্লাহর রীতি এই যে, তিনি তাকে সেই উপায়-উপকরণ ব্যবহার করার সুযোগ করে দেন। কাজেই মানুষের অবাধ্যতা ও গুনাহের কারণেই যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসে, সে সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘যখন আমার উম্মতের মধ্যে নিম্নে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হবে তখন তাদের ওপর প্রাকৃতিক বিপর্যয় নাজিল হবে। রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল। এ বৈশিষ্ট্যগুলো কী? তিনি বলেন- ১. যখন গনিমতের সম্পদ রাষ্ট্রীয়করণ করা হবে; ২. রাষ্ট্রীয় আমানতকে গনিমত মনে করা হবে; ৩. জাকাতকে জরিমানা মনে করা হবে; ৪. পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের আনুগত্য করতে শুরু করবে; ৫. ব্যক্তি তার মায়ের অবাধ্য হবে; ৬. বন্ধুর সঙ্গে সদাচরণ করবে অথচ পিতামাতার সঙ্গে অসদাচরণ করবে; ৭. মসজিদে উচ্চঃস্বরে কথা বলা হবে; ৮. সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোকরা নেতা হবে; ৯. কোনো ব্যক্তিকে তার অপকর্মের ভয়ে সম্মান করা হবে; ১০. মদপান করা হবে এবং রেশমি পোশাক পরিধান করা হবে; ১১. গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র বৃদ্ধি পাবে; ১২. শেষের লোকরা প্রথম যুগের লোকদেরকে অভিসম্পাত করবে; তখন তারা যেন গরম বাতাস প্রবাহিত হওয়া বা ভূমিধস সংঘটিত হওয়া বা চেহারা বিকৃতি হওয়ার অপেক্ষা করে।’ (তিরমিজি: ৪/৯৪)
মূলত মানবজাতির অকর্মই সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মূল কারণ। এজন্য আল্লাহ তায়ালা আমাদের সতর্ক করে বলেন, ‘আপনি বলুন, তিনিই তোমাদের ওপর ঊর্ধ্ব দিক থেকে অথবা তোমাদের গায়ের নিচ থেকে কোনো শাস্তি প্রেরণ করতে অথবা তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করতে ও এক দলকে অপর দলের শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতেও সম্পূর্ণরূপে সক্ষম।’ (সুরা আনআম: ৬৪-৬৫)
আলোচ্য ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তব প্রমাণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেগুলোকে পৃথিবীবাসী সুনামি, সিডর, আইলা, ক্যারিনা, নার্গিস ইত্যাদি নামে পরিচিত করেছে। মুসলমানরা আল্লাহর দ্বীন যথাযথ পালন না করার কারণে তাদের বিভিন্ন দেশ ও দলে বিভক্ত হওয়াও এ ভবিষ্যদ্বাণীর জ্বলন্ত প্রমাণ। তাদের মধ্যে ধর্মহীনতা পরিলক্ষিত হওয়ার কারণে অমুসলিম দেশের দ্বারা আক্রান্ত হওয়াও এর বাস্তব উদাহরণ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মুমিনের জন্য আল্লাহর পরীক্ষা। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সর্বপ্রথম আল্লাহ তায়ালার প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস রেখে তার সাহায্য কামনা করা এবং ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেয়ার পাশাপাশি তার ইবাদাত-বন্দেগি করে দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের প্রার্থনা করা।
রাসুলুল্লাহ (সা.) হাদিসে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজেও উম্মতের ওপর দুর্যোগের ব্যাপারে শঙ্কিত ছিলেন। তিনি দোয়া করেছেন যেন তাঁর উম্মতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে একসঙ্গে ধ্বংস না করা হয়।
কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিলে রাসুলুল্লাহ (সা.) বিচলিত হয়ে পড়তেন। আল্লাহর শাস্তির ভয় করতেন। বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করতেন এবং অন্যদেরকেও তা করার নির্দেশ দিতেন। ঝড়-তুফান শুরু হলে তিনি মসজিদে চলে যেতেন। নফল নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানাতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এ আমল দ্বারা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী তা জানতে পারি।
মুমিন বান্দার উচিত, সবসময় আল্লাহর পথে অগ্রসর হওয়া, আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা, তাঁর নির্দেশিত বিধিবিধান পালন করা। বিশেষ করে তাঁর নিষেধাজ্ঞাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করা। তবেই আল্লাহ তায়ালা পার্থিব জীবনের কঠিন বিপদাপদ ও দুর্যোগ থেকে মুক্তি দেবেন এবং মৃত্যুর পরে উত্তম প্রতিদান দিবেন। আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য পথ (কল্যাণের ফয়সালা) তৈরি করে দেন। (সুরা তালাক: ২) হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে তার করুণা চাও, কেননা আল্লাহ তার কাছে করুনা চাওয়াকে ভালোবাসেন। আর (বিপদাপদে) অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো তাঁর কাছে দুঃখ কষ্ট লাঘবের ধৈর্য ধারণ করা।’ (তিরমিজি)
কোরআনে আরও এসেছে, ‘গুরু শাস্তির পূর্বে আমি অবশ্যই তাদেরকে লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে।’ (সুরা সাজদাহ: ২১) এ আয়াতের তাফসিরে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘ছোট শাস্তি হলো দুনিয়ার বিপদাপদ, রোগব্যাধি, মৃত্যু এবং তাদের ওপর নেমে আসা অন্যান্য মুসিবত, যা দিয়ে আল্লাহ তার বান্দাকে পরীক্ষা করেন, যাতে বান্দা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে।’
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যেহেতু মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে, তাই তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসাও একটি মহৎ কাজ। যে কোনো দুর্যোগের মুহূর্তে প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী সাহায্যের হাত প্রসারিত করার পাশাপাশি ভয়াবহ দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় তাদের প্রতিপালকের প্রতি তাওবার মাধ্যমে ফিরে আসা। তাঁর কাছে আশ্রয় চাওয়া। কেননা যারাই বিপদাপদের মুহূর্তে তার কাছে আশ্রয় চেয়েছেন, তিনি তাকে আশ্রয় দিয়েছেন, তার দুঃখ-দুর্দশা দূর করেছেন।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ