ঢাকা, বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১, ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৬

রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের পরিণাম

প্রকাশনার সময়: ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৫৪

কারও সম্পদ আত্মসাৎ করা জঘন্য অপরাধ। আর যদি তা বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ হয় তাহলে অপরাধের মাত্রা আরও বেশি। অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ ইসলামের দৃষ্টিতে কবীরা গুনাহ। যা সহজে ক্ষমা হয় না। সম্পদ আত্মসাৎ করার পরিণামও খুব ভয়াবহ। এরূপ খিয়ানতকারীকে আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন না। তাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেন। এ মর্মে এরশাদ হচ্ছে- ‘নিশ্চয় আল্লাহ খিয়ানতকারীদেরকে ভালোবাসেন না।’ (সুরা আল-আনফাল: ৫৮)

অন্যের জিনিস আত্মসাৎ করা খুবই নোংরা স্বভাব। তারা মানসিকভাবে নিচু শ্রেণির ব্যক্তির মধ্যে গণ্য। কোনো রুচিশীল ভদ্র মানুষ এমন করতে পারে না। তাই তো যে যা আত্মসাৎ করবে, তাই নিয়ে বিচারের মাঠে উপস্থিত হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কোনো নবীর জন্য শোভনীয় নয় যে, তিনি খিয়ানত করবেন। আর যে লোক খিয়ানত করবে সে কিয়ামতের দিন সেই খিয়ানত করা বস্তু নিয়ে উপস্থিত হবে। অতঃপর প্রত্যেকেই পরিপূর্ণভাবে পাবে যা সে অর্জন করেছে। আর তাদের প্রতি কোনো অন্যায় করা হবে না।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৬১)।

হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি যাকে তোমাদের কোনো কাজের দায়িত্বশীল করি, অতঃপর সে সূচ পরিমাণ বস্তু বা তার চেয়ে বেশি সম্পদ আত্মসাৎ করল, সেটাই হবে খিয়ানত। কিয়ামতের দিন সেই বস্তু নিয়ে সে উপস্থিত হবে।’ (মুসলিম: ১৮৩৩)

যে ব্যক্তি অন্যের বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে যে বস্তু আত্মসাৎ করবে হাশরের ময়দানে সেদিন তাই নিয়ে হাজির হবে। সেটা কোনো প্রাণী হোক, স্থাবর সম্পদ হোক অথবা কোনো বস্তু। যারা অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভোগ করছে বা রাষ্ট্রের সম্পদ আত্মসাৎ করছে তাদের সেদিন অবস্থা হবে খুবই লজ্জাকর। যারা সরকারি ত্রাণ চুরি করছে তাদের এ বিষয়ে ভাবা উচিত। যারা ত্রাণের টাকা, চাল, ডাল, তেল প্রভৃতি জিনিস আত্মসাৎ করছে তাদেরকে এসব জিনিস নিয়েই বিচারের মাঠে উপস্থিত হতে হবে। সেদিন সারা পৃথিবীর মানুষ দেখে আত্মসাৎকারীকে চিনতে পারবে। গোটা জাহানের মানুষের সামনে অপমান থেকে বাঁচতে চাইলে এসব ফেরত দিয়ে তওবা করা উচিত।

আত্মসাৎকারীর জন্য জান্নাত হারাম

আত্মসাৎকারী ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম করা হয়েছে। তারা জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ পাবে না। এমর্মে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- মাক্বিল ইবনু ইয়াসার (রা.) বলেন, আমি নবী করীম (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘কোনো ব্যক্তি মুসলিমের দায়িত্ব গ্রহণের পর খিয়ানত অবস্থায় মারা গেলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করেছেন।’ (বুখারি: ৭১৫১; মুসলিম: ৩৮০)

মাক্বিল ইবনু ইয়াসার (রা.) বলেন, আমি নবী করীম (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যার প্রতি আল্লাহ কোনো দায়িত্ব অর্পণ করেন, অতঃপর সে সুষ্ঠুভাবে তা পালন করে না, সে জান্নাতের গন্ধ পাবে না।’ (বুখারি: ৭১৫০)

মাক্বিল ইবনু ইয়াসার (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে কোনো আমির (শাসক) মুসলিমদের দেখাশুনার দায়িত্ব নিল, অতঃপর সে তাদের (সমস্যা দূর করার) চেষ্টা করল না এবং তাদের হিতাকাঙ্ক্ষী না, সে তাদের সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম: ১৪২)

কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি খিয়ানত বা আত্মসাৎ করা অবস্থায় মারা গেলে তার জন্য জান্নাত হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। দায়িত্বে নিযুক্ত হওয়ার পর সঠিকভাবে স্বীয় দায়িত্ব পালন না করলে জান্নাতের সুগন্ধিও লাভ করতে পারবে না। দায়িত্বশীলকে সদা-সর্বদা জনগণের সমস্যাবলি দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। নিজ দায়িত্বে কোনো অবহেলা করা যাবে না। মানুষের সঙ্গে মিশুক হতে হবে। তাদের পাশে থাকতে হবে। অন্যথা এ দায়িত্বই তার জন্য ভয়াবহতায় রূপ নেবে।

আত্মসাৎকারীর বাসস্থান হবে জাহান্নাম

আত্মসাৎকারী ব্যক্তির জান্নাতে ঠাঁই হবে না বিধায় তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নামে। আত্মসাতের সম্পদ দিয়ে দুনিয়ায় কিছুটা সুখ ভোগ করেছে। পরকালে তাকে এই সুখের মাশুল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বুঝিয়ে দিতে হবে।

খাওয়ালা আনছারী (রা.) বলেন, আমি নবী করীম (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘নিশ্চয় কিছু লোক আল্লাহর সম্পদ অন্যায়ভাবে দখল করবে। আর কিয়ামতের দিন তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম।’ (বুখারি: ৩১১৮)

ওবাদাহ ইবনু ছামিত (রা.) বলেন, হুনাইনের যুদ্ধের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) গনীমতের এক ক্ষুদ্রকণা পরিমাণ জিনিস হাতে করে বললেন, ‘হে উপস্থিত জনগণ! আমার হাতের এই ক্ষুদ্র অংশ তোমাদের গনীমতের মালের অন্তর্ভুক্ত। সূঁচ পরিমাণ বা তার চেয়ে কম-বেশি সম্পদ কারও নিকট থাকলে তা পেশ কর। নিশ্চয় খিয়ানত (আত্মসাৎ) কিয়ামাতের দিন খিয়ানতকারীর জন্য অপমান-অপদস্ত ও জাহান্নামের কারণ হবে।’ (ইবনু মাজাহ: ২৮৫০)

ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ওমর (রা.) আমাকে বললেন, খায়বারের যুদ্ধের দিন সাহাবিগণের একটি দল বাড়ি ফিরে আসছিলেন। ওই সময় সাহাবিগণ বললেন, অমুক অমুক শহিদ, শেষ পর্যন্ত এমন এক ব্যক্তিকে সাহাবিগণ শহীদ বললেন, যার ব্যাপারে রাসুল (সা.) বললেন, ‘কখনো নয়, আমি তাকে জাহান্নামে দেখছি সে একটি চাদর অথবা আবায়া (এক ধরনের পোশাক) আত্মসাৎ করেছে।’ (মুসলিম: ১১৪)

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.)-এর গনীমতের মালের এক ব্যক্তি দায়িত্বশীল ছিল, যে কারকারা নামে পরিচিত। সে মারা গেলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জাহান্নামী বলে ঘোষণা করেন। সাহাবিগণ তার নিকট গিয়ে দেখলেন সে একটি চাদর আত্মসাৎ করেছিল।’ (বুখারি: ৩০৭৪)

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মিদ’আম নামে একটি গোলাম রাসুল (সা.)-কে হাদিয়া দিয়েছিল। মিদ’আম এক সময় রাসুল (সা.)-এর উটের পিঠের হাওদা নামাচ্ছিল এমতাবস্থায় একটি তীর এসে তাকে লাগে এবং সে মারা যায়। সাহাবিগণ বলেন, তার জন্য জান্নাত। রাসুল (সা.) বললেন, কখনই নয়। আল্লাহর কসম, নিশ্চয় ওই চাদরটি যেটি সে খায়বারের গনীমত বণ্টন করার পূর্বে আত্মসাৎ করেছিল সে চাদরটি জাহান্নামের আগুন তার ওপর উত্তেজিত করছে।

এ কথা শুনে একজন লোক একটি জুতার ফিতা বা দু’টি জুতার ফিতা রাসুল (সা.)-এর নিকট নিয়ে আসল। রাসুল (সা.) বললেন, একটি বা দু’টি জুতার ফিতা আত্মসাৎ করলেও জাহান্নামে যাবে। (বুখারি: ৬৭০৭)

আত্মসাৎকারীর শেষ পরিণতি হবে জাহান্নাম। রাষ্ট্রে বা জনগণের সামান্য কোনো জিনিস আত্মসাৎ করলেও পরিণাম একই। সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের জন্য হাদিসগুলো দিকনির্দেশক। আত্মসাৎ হলে পরিণতি খুবই ভয়ঙ্কর।

হাশরের মাঠে আত্মসাৎকারীকে দৃষ্টান্তস্বরূপ উপস্থাপন করা হবে

আত্মসাৎ, খিয়ানত এবং বিশ্বাসঘাতকতা ভয়ঙ্কর অপরাধ। যারা দুনিয়ায় এগুলোর সঙ্গে জড়িত হবে, তাদেরকে বিচারের মাঠে সবার মাঝে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এ মর্মে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- ইবনু উমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের জন্য এক একটি পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং বলা হবে, তা উমুকের পুত্র উমুকের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক।’ (বুখারি: ৬১৭৮)

আবূ সাঈদ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের নিতম্ভের (পেছনে) নিকট তার বিশ্বাসঘাতকতার পতাকা স্থাপন করা হবে।’ (মুসলিম: ১৭৩৮)

অপর এক বর্ণনায় রয়েছে- ‘কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের জন্য তার বিশ্বাসঘাতকতার পরিমাণ অনুযায়ী পতাকা উত্তোলন করা হবে। সাবধান! প্রধান শাসকের বিশ্বাসঘাতকতার পতাকাই হবে সবচেয়ে বড়।’ (মুসলিম: ১৭৩৮)

কিয়ামত দিবসে হাশরের মাঠে প্রত্যেক আত্মসাৎকারী ও বিশ্বাসঘাতকের অবস্থা হবে খুবই লজ্জাকর। তাদের আত্মসাতের পরিমাণ অনুযায়ী পেছনে পতাকা উড়তে থাকবে। যেখানে তাদের প্রত্যেকের পরিচয় উল্লেখ করা হবে। বিষয়টি কতটা নোংরা ও অপমানজনক তা আত্মসাৎকারীদের অনুধাবন করা প্রয়োজন। বিচারের মাঠে অপমান থেকে বাঁচতে চাইলে সকল প্রকার খিয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতা বর্জন করা অপরিহার্য কর্তব্য।

সুধী পাঠক! যারা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছি তাদের বিষয়টি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। জনগণের জিনিস অন্যায়ভাবে ভোগ করতে তাদের বিবেকে বাধা দেয় না। গভীরভাবে এ হাদিসগুলো তাদের ভাবা প্রয়োজন। সামান্য সুখ যেন আজীবনের কান্নায় রূপ না নেয়। সবাই সময় থাকতে সাবধান হই।

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেউ কারও প্রতি যদি সম্মানের ব্যাপারে বা কোনো কিছুর ব্যাপারে অত্যাচার করে থাকে তাহলে আজকেই সে যেন তা সমাধা করে নেয়, ওই দিন আসার পূর্বে যে দিন তার নিকট কোনো অর্থ-সম্পদ থাকবে না। ওইদিন সৎ আমল থাকলে অন্যায় পরিমাণ নিয়ে নেয়া হবে। আর সৎ আমল না থাকলে তার পাপগুলো নিয়ে অপরাধীর ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে।’ (বুখারি: ২৪৪৯)

আল্লাহ তায়ালা সব মুসলিমকে সামান্য থেকে সামান্যতর আত্মসাৎ করার মতো জঘন্য অপরাধ থেকে বিরত থাকার তওফিক দান করুন। আমীন!

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ