ঢাকা, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩১, ১৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

কীসের ধোঁকায় তুমি রব থেকে দূরে?

প্রকাশনার সময়: ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ২৩:৪৫

মনে করুন, আপনি আপনার বাবার অবাধ্য এক সন্তান। আপনার অবাধ্যতায় মনে কষ্ট পেয়ে একদিন আপনার বাবা আপনাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে আমার সন্তান! কোন জিনিসটি আমার প্রতি তোমাকে ধোঁকায় ফেলে রাখল?’

এর মানে কী, জানেন? এর মানে হচ্ছে, তিনি মনে বড় আবেগ নিয়ে আপনাকে বলছেন, ও আমার সন্তান! তোমাকে আমি জন্ম দিলাম, খাইয়ে বড় করলাম, বড় হওয়ার পথে চিকিৎসা বাবদ সব খরচ বহন করলাম, পড়ালেখা করিয়ে আজকে একটি অবস্থানে দাঁড় করালাম। আর আজ কিনা তুমি আমাকে চিনতে পারছ না, আজ কিনা তুমি আমাকে পাত্তা দিচ্ছ না, আজ কিনা তোমার কাছে আমি অবহেলিত। আজ তুমি আমার অবাধ্য হতে দ্বিতীয়বার পর্যন্ত ভাবছ না।

আচ্ছা একটু চিন্তা করুন তো, এই যে আপনার বাবা আপনার প্রতি তার অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তার এই হূদয় নাড়ানো কথাগুলো কি আপনার হূদয়ে একটুও হিট করছে? বাবা আপনার প্রতি কতটা কষ্ট পেলে এভাবে বলতে পারেন তা কি আপনি সন্তান বুঝতে পারছেন? বাবার এমন কথার পর আপনি কি আর তার অবাধ্য হয়ে চলতে থাকার কথা নাকি তার দিকে ফিরে আসার কথা?

আপনার বাবা যদি আপনার প্রতি তার অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে আপনার হূদয়ে নাড়া দেয় তবে যে রব আপনাকে সৃষ্টি করে অসংখ্য অগণিত নিয়ামতের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছেন, যে রব আপনার বাবার চেয়ে লক্ষ কোটি গুণ দয়ালু সেই রব যদি তাঁর নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন তখন আপনার হূদয়ে কী পরিমাণ নাড়া দেয়ার কথা— তা একটু ভাবুন তো।

আল্লাহ এ পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের কাছে প্রশ্ন রাখছেন: ‘হে মানুষ, কোন জিনিসটি তোমাকে তোমার মহামহিম মালিকের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলে রাখল? যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি তোমাকে সোজা সুঠাম করেছেন এবং তোমাকে সুবিন্যস্ত করেছেন। তিনি যেভাবে চেয়েছেন সেই আঙ্গিকেই তোমাকে গঠন করেছেন।’ (সুরা আল-ইনফিতার: ৬-৮)

লক্ষ্য করুন, আয়াতের শুরুতেই আল্লাহ ‘মানুষ’ বলে সম্বোধন করেছেন। আর এই ‘মানুষ’ বলে সম্বোধন করাতে পৃথিবীর সব কাফির-মুশরিক, নাস্তিক-মুরতাদ তথা মুসলিম-অমুসলিম সবাই এর মধ্যে ঢুকে গেছে। ফলে সম্বোধনের পরে আল্লাহ যে কথাটি বলছেন সে কথাটি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলছেন।

‘হে মানুষ, কোন জিনিসটি তোমাকে তোমার মহামহিম মালিকের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলে রাখল?’ যদিও আমরা দেখতে পাচ্ছি এটি একটিমাত্র বাক্য কিন্তু এর ভিতরে আরও বহু বাক্য লুকিয়ে আছে। চিন্তাশীল মাত্রই এই বাক্যের গভীরতা বোঝার কথা।

আল্লাহর এভাবে বলার মানে কী, জানেন? আল্লাহ বোঝাতে চাচ্ছেন, ও আমার বান্দা, মায়ের পেটের ভিতর থাকতে যখন তোমাকে দুনিয়াবাসীর কেউ চিনত না, যখন তোমাকে কেউ দেখাশোনা করত না তখন এই আমি আল্লাহ তোমাকে চিনতাম, তখন এই আমি আল্লাহ তোমার দেখাশোনা করতাম। মায়ের পেটে নাপাক পানির অবস্থায় থাকতে যখন কারও কাছে তোমার দাম ছিল না তখন এই আমি আল্লাহর কাছে তোমার দাম ছিল। মায়ের পেট থেকে বের হওয়ার পর যখন দুনিয়ার কোনো খাবার তোমার উপযোগী ছিল না তখন আমি আল্লাহ তোমার মায়ের স্তনে তোমার উপযোগী খাবার প্রস্তুত করে রেখেছিলাম। আর আজ কিনা তুমি আমাকে চিনতে পারছ না। আজ তোমার আচরণ বলছে তোমার প্রতি আমার দয়ার কথা তুমি ভুলে গেছ, তুমি আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে পারোনি।

ও আমার বান্দা! অন্য সবার মতো সেদিন তোমারও হাত ছিল কিন্তু তুমি সে হাত দিয়ে কিছু ধরতে গেলে তা পড়ে যেত, তোমার পা ছিল কিন্তু পা দিয়ে তুমি হাঁটতে গেলে তুমি পড়ে যেতে, তোমার মাথা ছিল কিন্তু মাথা দিয়ে তুমি আজকের মতো চিন্তা করতে পারতে না। তোমার মুখ ছিল কিন্তু তোমার সে মুখ দিয়ে তোমার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারতে না। কোনো কিছু বলতে গেলে অসহায়ের মতো মা-বাবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে।

আর আজ যখন তোমার রব তোমার হাত সচল করে দিলেন, তোমার পা-কে হাঁটার উপযোগী করে দিলেন, তোমার মুখে কথা ফুটিয়ে দিলেন তখন তুমি সেই হাত দিয়ে তোমার রবের নাফরমানি করছ, তোমার সেই পা দিয়ে খারাপ পথে গমন করছ, তোমার সেই মুখ দিয়ে আল্লাহর তাসবিহের পরিবর্তে বিভিন্ন গান-বাজনায় মগ্ন আছ, সেই মুখ দিয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনির পরিবর্তে বিভিন্ন নেতানেত্রীর নাম ধরে গলা ফাটাচ্ছ। ব্রেইন দিয়ে তোমার রবকে তুমি চিনতে পারছ না, পারলে আরও রবের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছ।

বান্দারে, তোমার প্রতি তোমার রবের এত এত দান-অনুগ্রহের কথা কীভাবে তুমি ভুলে যেতে পারলে, কীভাবে? একবারও কি তোমার রবের অনুগ্রহের কথা তোমাকে ভাবায় না, একবারও না? যে রব তোমার জন্ম থেকে তোমার প্রতি এত অনুগ্রহ করে যাচ্ছেন সে রবের নির্দেশ পালনে আজ তুমি কীভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারো? আজ কীভাবে তোমার সে রব তোমার কাছে অবহেলিত থাকতে পারে? তোমার কি এই ভেবে কষ্ট হয় না, যে রব আমার জন্য এত কিছু করলেন সেই রবের হুকুম কীভাবে আমি অমান্য করতে পারি? সেই রবকে কীভাবে ভুলে যেতে পারি? সেই রবের এত অনুগ্রহ পাওয়ার পর কীভাবে আমি অকৃতজ্ঞ হতে পারি?

আচ্ছা! তুমিই বলো, তুমি যদি কাউকে অনুগ্রহ করো আর সে যদি তোমার প্রতি অকৃতজ্ঞ আচরণ করে তবে তুমি কি তাকে আর পরবর্তীতে সাহায্য করতে যাবে? যাবে না, তার প্রতি তোমার রাগ সৃষ্টি হবে। যে তুমি অন্যের একবার অকৃতজ্ঞ আচরণের জন্য পরেরবার তাকে সাহায্য করতে যাবে না সে তুমি নিজের এক-দুবার নয় বারবার অকৃতজ্ঞ আচরণের পর আমি রব কিন্তু তোমার জন্য আমার অনুগ্রহের দুয়ার বন্ধ করে দিচ্ছি না। এ অনুগ্রহের দুয়ার বন্ধ না করে দেয়ার সুযোগে কি তুমি তোমার রবের অবাধ্য হয়ে চলতেই থাকবে? নীড়ে ফিরবে না আর?

কোরআনের যে আয়াতটি নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করলাম সে আয়াতটি অশ্রুসিক্ত হওয়ার মতো একটি আয়াত। আয়াতটির অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারলে আপনিও অশ্রুসিক্ত না হয়ে পারবেন না। বিশ্বাস করুন, এই আয়াতটি পড়লে কিংবা তিলাওয়াত শুনলে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার চোখ মুখ বেয়ে অশ্রু পড়তে থাকে। এমনকি বুক ফেটে কান্নার আওয়াজ শব্দ করে আসতে চায়।

কেন জানেন? কারণ উপরে আলোচনা করে আসা প্রতিটি বিষয় আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আল্লাহর নিয়ামতের স্মরণ আমার সামনে প্রশ্ন রেখে বলে, এত নিয়ামত পেয়েও কোন জিনিস তোমাকে তোমার রবের প্রতি গাফেল করল?

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ