সাজসজ্জা করা নারীদের সৃষ্টিগত প্রবণতা। তাই তাদের অঙ্গসজ্জার জন্য বিভিন্ন প্রকার গহনার সঙ্গে চাই প্রসাধনী। যেমন- কানের দুল, গলার হার, ব্রেসলেট, লিপস্টিক, স্নো, ক্রিম, পাউডার, মেকআপ বক্স ইত্যাদি। তাই তো মহান আল্লাহ কোরআনে নারীদের সম্পর্কে বলেছেন: ‘যে অলংকারে লালিত পালিত হয়।’ (সুরা যুখরুফ: ১৮)
তারা স্বামীর জন্য সাজবে। অনুরূপভাবে সাজসজ্জা করে শালীনভাবে নিজেদের মধ্যে বা মাহরাম পুরুষ তথা বাবা, ভাই, দাদা, চাচা, আপন ভাতিজা, ভাগ্নে ইত্যাদি রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের সামনেও চলাফেরা করতে পারে। কিন্তু বেপর্দা অবস্থায় পরপুরুষদের সামনে নিজেদের দেহ, পোশাক বা অলংকারাদির সৌন্দর্য প্রকাশ করা জায়েজ নেই। ইসলাম নারী জাতিকে সকল প্রকার অশ্লীলতা, বেহায়াপনা থেকে পরিত্রাণ দিয়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে মর্যাদার উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। ইসলামে মুসলিম নারীদেরকে অন্যান্য বিধর্মী ও জাহিলি যুগের নারীদের থেকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা হয়েছে।
মুসলিম নারীদের বৈশিষ্ট্য হলো- লাজুকতা, শালীনতা, সচ্চরিত্রা হওয়া, পুণ্যবতী ও ধৈর্যশীলা হওয়া এবং পরপুরুষ থেকে নিজেকে সংরক্ষিত করে রাখা। আর জাহিলি যুগের নারীদের বৈশিষ্ট্য হলো- পরপুরুষের সামনে নিজের রূপ-লাবণ্য প্রদর্শন এবং তাকে প্ররোচিত করা। জাহিলি যুগের নারীদের এই রূপচর্চাকে পবিত্র কোরআনের ভাষায় ‘তাবাররুজ’ আখ্যায়িত করে মুসলিম নারীদেরকে এ রূপচর্চা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করো এবং প্রাচীন জাহিলিয়াতের নারীদের মতো সাজগোজ ও সৌন্দর্য প্রদর্শন করে ঘোরাফেরা করো না।’ (সুরা আহযাব: ৩৩)
আয়াতে প্রাচীন জাহিলিয়াত দ্বারা মহানবী (সা.)-এর প্রাক- আবির্ভাব কালকে বুঝানো হয়েছে। সেকালে নারীরা নির্লজ্জ সাজসজ্জার সঙ্গে নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াত। উক্ত আয়াতে নারীদেরকে সে প্রাচীন জাহিলি যুগের নারীদের মতো সাজগোজ ও সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়াতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে ইসলাম নারীদের স্বভাবজাত চাহিদা পূরণের জন্য বৈধ সাজসজ্জা করতে বাধা দেয় না। বরং আপন স্বামীর নিকট সাজগোজ করার ব্যাপারে হাদিসে উৎসাহিত করা হয়েছে। হযরত উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন: ‘কোনো মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর তাকওয়ার পর উত্তম যা কিছু লাভ করে তা হলো পুণ্যময় স্ত্রী, স্বামী তাকে কোনো নির্দেশ দিলে সে তা পালন করে, সে তার দিকে তাকালে তাকে আনন্দিত করে এবং সে তাকে শপথ করে কিছু বললে সে তা পূর্ণ করে, আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে তার সম্ভ্রম ও সম্পদের হেফাজত করে। (ইবনে মাজাহ: ১৮৫৭)
নারীদের রূপচর্চার শরয়ি নীতিমালা
আজকাল পশ্চিমাদের ন্যায় মুসলিম নারীদের ভিতরও কৃত্রিম রূপচর্চা ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে। ধর্মীয় বিধানের প্রতি উদাসীন নারীরা পার্লার সংস্কৃতিকে হাল ফ্যাশনের প্রতীক রূপে জানে। অথচ এসব পার্লারগুলো রূপচর্চার আড়ালে শরিয়ত লঙ্ঘন করছে এবং অশ্লীলতার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। অধুনা যুগের অশ্লীলতা এতটাই উগ্র হয়েছে যে, তার সামনে প্রাচীন জাহিলিয়াত কবেই ম্লান হয়ে গেছে। তাই যুগের এ নাজুক পরিস্থিতিতে জানতে হবে নারীর জন্য কী ধরনের সাজসজ্জা বৈধ।
নিম্নে সাজগোজের কয়েকটি শরয়ি বিধি উল্লেখ করা হলো:
১. শরিয়তসম্মত শালীন কাপড় পরা, যা মহিলাদের সতরকে পূর্ণাঙ্গরূপে ঢেকে রাখে।
২. এমন পাতলা কাপড় পরা যাবে না যে, কাপড়ের ভিতর দিয়ে শরীরের রঙ ও সতর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
৩. এমন আঁটসাঁট পোশাক না পরা, যার দ্বারা শরীরের গোপন ও স্পর্শকাতর অঙ্গগুলো যেমন: স্তন, নিতম্ব ইত্যাদির আকৃতি বাহির থেকে ফুটে ওঠে। যেমনটা পশ্চিমা নারীরা পরে থাকে। (আল হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম: পৃ.১৬১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জাহান্নামবাসী ওই সকল নারী, যারা পোশাক পরিহিতা হয়েও উলঙ্গ, যারা পথচ্যুত এবং অন্যদেরকে পথচ্যুত করবে, এদের মাথা হবে উটের পিঠের মতো করে বাঁকানো, এরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, এমনকি জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’ (সহিহ মুসলিম: ৫৪৭৫)
তবে এসব পোশাক স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য কেবল স্বামীর সম্মুখে পরা যাবে। অন্য কারও সম্মুখে পরা যাবে না। (ফতহুল বারী: ১০/২৫৯)
৪. নারীরা পুরুষদের পোশাক পরতে পারবে না। এমনকি অন্যান্য সাজসজ্জার বেলায়ও পুরুষদের বেশ ধারণ করতে পারবে না। অধুনা যুগের অনেক নারী যেমন পশ্চিমাদের ন্যায় শার্ট, ফুল প্যান্ট, হাফ প্যান্ট, ট্রাউজার ইত্যাদি পরে থাকে। হাদিসে এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে। ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষদের এবং পুরুষের বেশ ধারণকারী মহিলাদেরকে অভিশাপ করেছেন।’ (বুখারি: ৫৮৮৫)
ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, উক্ত হাদিসে নারীদেরকে পোশাক, সৌন্দর্য ও চালচলনে পুরুষদের সাদৃশ্য অবলম্বন করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাই নারীদের জন্য শার্ট- প্যান্ট ইত্যাদি পুরুষদের পোশাক স্বামীর সম্মুখেও পরা উচিত নয়। এক্ষেত্রে পুরুষ ও মহিলাদের পোশাকের স্বাতন্ত্র নির্ভর করবে দেশীয় প্রচলন ও রীতির ওপর। তাই যেসব দেশে কোনো পোশাক পুরুষ ও মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রে সমানভাবেই প্রচলিত আছে, মহিলাদের জন্য সেসব পোশাক পরাতে কোনো সমস্যা নেই। (আলমাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ: ১২/১২, ফতহুল বারী: ১০/২৭৮)
৫. মুসলিম নারীরা ইয়াহুদি, খ্রিস্টান, মূর্তি পূজারি, অন্যান্য বিধর্মী ও অশ্লীল সমাজের নারীদের পোশাক তাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে পরতে পারবে না। দুঃখজনক হলেও আজকাল বিধর্মীদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে এ জাতীয় পোশাক মুসলিম সমাজে বিশেষ প্রসার ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। অথচ ঈমানের ন্যূনতম দাবি যে, মুমিন হূদয় এ সকল ইসলামি মূল্যবোধবিরোধী পোশাক ঘৃণা করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে।’ (আবু দাউদ: ৪০৩১)।
৬. ভ্রু প্লাগ করা, চেহারা বা দেহাঙ্গে উল্কি অঙ্কন করা, এমনিভাবে ট্যাটু লাগানো যাবে না। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন উপায়ে ভ্রু প্লাগ করা এবং দেহাঙ্গে উল্কি অঙ্কন বা ট্যাটু লাগানো হারাম ও নিষিদ্ধ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আল্লাহ তায়ালা অভিসম্পাত করেছেন সেসব নারীদের ওপর, যারা দেহাঙ্গে উল্কি উৎকীর্ণ করে এবং যারা করায়, তেমনি যারা ভ্রু উঠিয়ে সরু (প্লাগ) করে, যারা সৌন্দর্য বাড়াতে দাঁতের মাঝে ফাঁকা সৃষ্টি করে এবং যারা আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন আনে।’ (বুখারি: ৪৮৮৬)
৭. মেকআপ করা। যেমন- বর্তমানে লিপিস্টিক, স্নো, ক্রিম, পাউডার, মেকআপ বক্স সহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী পাওয়া যায়। এগুলো নারীদের জন্য ব্যবহার করা জায়েজ। ইসলাম নারীকে সাজসজ্জার জন্য মেহেদি লাগানো এবং এ ধরনের সামগ্রী ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। তবে এসব বস্তু ব্যবহারের সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।
ক. চেহারার সৃষ্টিগত রং পরিবর্তনের চেষ্টা এবং বিজাতি কিংবা প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত নারীদের অনুকরণ করার উদ্দেশ্যে হলে এসবের ব্যবহার জায়েজ হবে না।
খ. মেকআপে ক্ষতিকর বস্তু বা প্রসাধনী ব্যবহার করা যাবে না।
গ. অতিরিক্ত রূপচর্চা করা যাবে না। কেননা, অতিরিক্ত রূপচর্চা হয়তো ত্বকের ক্ষতি করে কিংবা অপচয়ের সীমায় পড়ে।
ঘ. যে সমস্ত প্রসাধনী হালাল বস্তু দ্বারা তৈরি সেগুলোর ব্যবহার জায়েজ। তবে এগুলোর উপাদানে হারাম কোনো জিনিস নিশ্চিতভাবে জানা থাকলে সেগুলো ব্যবহার করা জায়েজ হবে না।
ঙ. যেসব সামগ্রীতে অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়, সেগুলো যদি আঙুর, কিশমিশ, শুকনো বা ভেজা খেজুর দ্বারা তৈরি করা হয় তাহলে তা সামান্য পরিমাণ ব্যবহারও জায়েজ হবে না। আর এগুলো ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা তৈরি অ্যালকোহল যদি নেশার পরিমাণে না পৌঁছে, তাহলে পরবর্তী ফুকাহায়ে কেরামের মতানুযায়ী তা ব্যবহার করা জায়েজ হবে। (হিদায়া: ৪/১৯২, তাকমিলাতু ফতহুল মুলহিম: ৩/৬০৮)
মহিলাদের সাজসজ্জার আরও একটি সামগ্রী হলো নেইলপালিশ। তাতে যদি নাপাক উপাদানের মিশ্রণ না থাকে, তাহলে ব্যবহার করা জায়েজ। তবে নেইলপালিশ যেহেতু পানি প্রবেশের প্রতিবন্ধক, তাই তা নখে থাকা অবস্থায় ওজুু ও ফরজ গোসল সহি হবে না। তাই বারবার অজুর সুবিধার্থে নেইলপালিশ ব্যবহার না করাই অধিকতর নিরাপদ। (হিন্দিয়া:১/৫৪, আপকে মাসায়েল: ৩/১৫০)।
নারীর রূপ-লাবণ্য, শোভা-সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা সৃষ্টিগত এবং স্বভাবজাত। তাই ইসলাম নারীকে বৈধ সাজসজ্জা করতে নিষেধ করে না। কিন্তু বর্তমান যুগে নারীদের কৃত্রিম রূপচর্চা যেমন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তেমনি তা
রূপচর্চার আড়ালে অশ্লীলতার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এজন্য মুসলিম নারীদের করণীয় হলো, শরিয়ত সমর্থিত সাজগোজ ও শরিয়ত বহির্ভূত সাজগোজ সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া এবং ইসলামের নির্দেশনা মেনে চলে সম্ভ্রম ও সতীত্ব রক্ষা করা। একজন নারী সহজেই তার চিন্তা, অভিরুচি, মননশীলতা, রুচিশীলতা ও নান্দনিকতা তার পরিবার থেকে ধীরে ধীরে জাতীয় জীবনে ছড়িয়ে দিতে পারে। আল্লাহ তায়ালা তাওফিক দান করুন!
লেখক: শিক্ষার্থী, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ঢাকা।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ