ঢাকা, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১, ৯ রবিউস সানি ১৪৪৬

দুর্নীতি দমনে মহানবীর শিক্ষা

প্রকাশনার সময়: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:২৮

প্রিয়নবী (সা.) তাঁর ইসলাম প্রচার ও প্রসার কল্পে যে প্রধান অন্তরায়টি উপলব্ধি করেন তাহলো দুর্নীতির মতো পচনশীল রোগ। তিনি সমাজের সর্বস্তর থেকে এ জঘন্যতম অন্যায় ও গর্হিত পাপকে নির্মূল করার সংকল্প করেন। নবী (সা.) মুসলমানদের শুধু ধর্ম ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, তারা যাতে সম্মানের সঙ্গে দুনিয়ায় বেঁচে থাকে তারও ব্যবস্থা করে গেলেন। মহানবীর অবদানের এখানেই শেষ নেই, তিনি সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করার জন্য সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন। বিচার ও ইনসাফকে দিলেন ধর্মের মর্যাদা এবং ন্যায়নীতি ও সাম্যের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্রনীতি গড়ে তুললেন। নবীর সৃষ্ট নয়া সমাজে অভিজাত বা পুরোহিত বলে কোনো বিশিষ্ট সমাজ থাকল না। যোগ্যতা থাকলে আজাদকৃত দাস ও খলিফা হতে পারবে, এ ছিল নবী প্রদত্ত বিধান।

নবী (সা.) নারী জাতিকে দিলেন ইসলামী অধিকার। ইসলাম নারীর অধিকার নির্ধারণ করার ব্যাপারে তিনটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখেছে। প্রথমত, একমাত্র পারিবারিক শৃঙ্খলার জন্য নারীর ওপরে পুরুষকে যে কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে, পুরুষ যেন এ ক্ষমতার অপব্যবহার করে নারীর ওপর অত্যাচার অবিচার করতে না পারে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যেন প্রভু ও দাসীর সম্পর্ক না হতে পারে। দ্বিতীয়ত, নারীকে তেমন সব সুযোগ দিতে হবে যার দ্বারা সে সমাজব্যবস্থার গণ্ডির মধ্যে স্বীয় স্বাভাবিক প্রতিভার পরস্ফূিটন করতে পারে। তৃতীয়ত, নারীর উন্নতি ও সাফল্যের উচ্চশিখরে আরোহন করা যেন সম্ভব হয়। কিন্তু তার উন্নতি সাফল্য যা কিছুই হবে তা নারী হিসেবেই হতে হবে। ক্রীতদাস-দাসীকে মুক্তিদানের পথ তিনি উন্মুক্ত করে দিলেন। ক্রীতদাসীদের রক্ষিতা রূপে ব্যবহার না করে তিনি তাদেরকে বিয়ে করতে মনিবদের নির্দেশ দিলেন। পুরুষদের জন্য বিয়ের সর্বমোট সংখ্যাও তিনি সীমাবদ্ধ করে দিলেন নারীদের স্বার্থে।

আল্লাহ পাক কোরআনে বান্দার হককে সংরক্ষণ করার ব্যাপারে জোর তাগিদ দিয়েছেন। ‘তোমরা তোমাদের পরস্পরের ধন-সম্পদ অবৈধ পন্থায় ভক্ষণ করবে না। তোমরা শাসকদের নিকট ঝুঁঁকে পড়ো না এ উদ্দেশ্যে যে, তোমরা জেনেশুনে লোকদের ধন, সম্পদের কিছু অংশ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করবে।’ অপর এক জায়গায় আল্লাহ বান্দাদের মধ্যে নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা কায়েম করার নির্দেশ দেন। ‘তোমরা যখন লোকদের মাঝে বিচার ফায়সালা করবে, তখন অবশ্যই সুবিচার করবে’।

প্রিয়নবী এ নীতিতে কেবল মুসলিমদেরই নবী ছিলেন না, তিনি অমুসলিমদেরও নবী ছিলেন। তাই তাকে তাদের বিচারকার্য পরিচালনা করতে হতো। একদা কোনো একদল মুসলিম সম্প্রদায় মুশরিকদের মূর্তি আলয়ে ঢুকে একটা মূর্তির নাক ভেঙে ফেলে এই দেখে মুশরিকরা নবীর কাছে বিচার দায়ের করে। নবী (সা.) তার বিচারে ওই মুসলিম সম্প্রদায়কে ডেকে বিচার করলেন। মুশরিকদের মূর্তির নাক ভেঙেছে তিনি সেই মুসলিমের নাক নেয়ার হুকুম দেন। এতে মুশরিকরা নবীর এ বিচারে অভিভূত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। এই ছিল নবীর সাম্যের নীতি, যে নীতি গোটা বিশ্ব ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল।

তাই সমাজ ও রাষ্ট্রে সুবিচার ও ন্যায়নীতির নিরাপত্তা বিধান কল্পে পবিত্র কোরআন এক বিরাট চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা তোমরা সবাই সুবিচার ও ন্যায়নীতি নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াও আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হিসেবে; সে সুবিচার যদি তোমাদের নিজেদের বাবা-মা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধেও হয়, যদি তারা ধনী বা গরিবও হয়। এদের অপেক্ষা আল্লাহই তো উত্তম, অতএব তোমরা নফসের খায়েশের অনুসরণ করতে গিয়ে অবিচার ও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করো না।’

প্রিয়নবী দেখিয়ে দিয়ে গেছেন, আইন প্রয়োগে মানুষে মানুষে কোনো রূপ ভেদাভেদ করার নীতি ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়; না বংশের দিক থেকে না বর্ণ, ভাষা ও সম্পদ পরিমাণের ভিত্তিতে।’ নবী (সা.) এ ব্যাপারে পরিষ্কার ঘোষণা করেছেন- ‘তোমাদের মধ্যে পূর্ববর্তী জাতিগুলো ধ্বংস হয়েছে কেবল এ বিভেদ ও নীতির ফলে যে, তাদের সমাজের ভদ্র লোকেরা যখন চুরি করত, তখন তাদের কোনো শাস্তি দেয়া হতো না, পক্ষান্তরে তাদের দুর্বল লোকেরা যখন চুরি করত তখন তারা তাদের ওপর শাস্তির ব্যবস্থা করত। আল্লাহর শপথ মুহাম্মদ (সা.)-এর কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করে তার হাতও কেটে দেয়া হবে’ (হাদিস)।

চুরি, ব্যভিচার, মদ, জুয়া, অন্যায় ও স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি সমাজ থেকে নির্মূল করার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা দিলেন আমাদের প্রিয় নবী (সা.)। সুদ ও ঘুষকে হারাম করলেন। কেননা, সুদ ও ঘুষ সমাজজীবনকে করে ফেলে কলুষিত ও পাপাসক্ত। ঘুষ তাকে বলে, যা কোনো বস্তুর বিনিময় পাওয়ার শর্তে দেয়া হয়। নবী করিম (সা.) এই ঘুষ গ্রহণ ও প্রদান করতে নিষেধ করেছেন। কেননা, ঘুষের মাধ্যমে অবৈধ স্বার্থ উদ্ধার করা বা কারো হক নষ্ট করা অথবা কারো প্রতি জুলুম করার উদ্দেশ্য হয়। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ পাক তার পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন (সুরা বাকারা-২৭৫) ‘আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করে দিয়েছেন পরে তার পরিবর্তে জাকাতকে বৃদ্ধি করেছেন। আর আল্লাহ তার কোনো আইন অমান্যকারী ও পাপাচারীকে ভালোবাসেন না’।

এ আয়াতের দাবিতে নবী (সা.) তার অধঃপতিত সমাজকে এক সুশ্রী জীবনদান, নির্মল চরিত্র গঠন ও উন্নত রুচিবোধে গড়ে তোলেন। অথচ আশ্চর্যের কথা এই যে, প্রিয়নবী এ অসাধ্য সাধন করেছিলেন মাত্র ১০ বছর সময়ের মধ্যে, যে সময় একটি সাধারণ পরিবারের মানোন্নয়নের পক্ষেও যথেষ্ট নয়। ১০ বছরে তিনি একটি নিকৃষ্টতম মানবীয় উপাদানকে ঢালাই ছাঁটাই করে এক উন্নত জাতিতে পরিণত করলেন। যারা হজরতের তিরোধানের পর মাত্র ৮০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর যাবতীয় সমৃদ্ধ দেশকে পদানত করেছিল এবং পৃথিবীর ভেতর বৃহত্তম সাম্রাজ্য গড়তে সমর্থ হয়েছিল যা রোমক জাতি আটশ’ বছরেও করতে পারেনি।

প্রিয়নবী ঘুণে ধরা অসভ্য ও বর্বর সমাজকে একটি আদর্শ ও কুসংস্কারমুক্ত সমাজে রূপান্তরিত করার জন্য দুর্বার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুললেন। তিনি অত্যন্ত হেকমতের সঙ্গে সমাজের দুর্নীতি উচ্ছেদ করে আরব জাতিকে উদ্ধার করলেন, তার ফলে সারাবিশ্ব মানব মুক্তির পথ খুঁজে পেল, শান্তি পেল। মহান আল্লাহ তার কিতাবে সুরা মায়িদার ২৮নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন- ‘চোর পুরুষ বা নারী যে কেহই হোক, তার দু’হাত কেটে ফেলো’। আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা যায়, এই আয়াতের আইনগত বা বিচার শর্ত প্রয়াগ কেবল ইসলামী শাসনব্যবস্থার বলবৎ হবে নচেৎ হবে না। কেননা চোর যদি কোনো উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হয়, তার যদি জীবিকার ব্যবস্থা করা হয় রাষ্ট্র কর্তৃক, তখন যদি চুরি করে সেই অবস্থায় তার কাছে ১০ দেরহাম পরিমাণ অর্থ থাকে, ইসলামী রাষ্ট্রে তার বিচার উপরোক্ত আয়াতের অর্থ অনুযায়ী হবে; নচেৎ নয়। বস্তুত পক্ষে ইসলামী রাষ্ট্রেই কেবল সব মানুষের ন্যায্য বিচার ও অধিকার সুনিশ্চিত পাওয়ার আশা করা যায়।

প্রিয়নবী (সা.) এমনিভাবে কোরআনের আলোকে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে জঘন্যতম পাপ, দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, ব্যভিচারকে নির্মূল করে সত্যিকার ইসলামী ভাবধারা ও সংস্কৃতির দিকে মনোনিবেশ করার জন্য জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও তা রক্ষা ও বন্দ করে গেছেন।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ