ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১, ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

আমাদের আদর্শ বিশ্বনবী (সা.)

প্রকাশনার সময়: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:০৫

বর্তমান সময়টা হচ্ছে মডেলের যুগ। পোশাক-খাবার থেকে শুরু করে জুতা-স্যান্ডেল ও রূপচর্যা পর্যন্ত এমন হাজারও নিত্যকার প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গের প্রতিটিরই আছে আলাদা মডেল। এমনকি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মডেলিংয়ের ওপর উচ্চতর শিক্ষা পর্যন্ত চালু হয়েছে। মডেলিং সব জায়গায়, শুধু মডেল নেই আমাদের জীবন গঠন ও পরিচালনের ক্ষেত্রে। উভয় জাহানের কল্যাণ ইসলাম পরিপালনের ক্ষেত্রে।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)কে মানা এবং অনুসরণ করা। এটা আবেগের বিষয় নয়, জানার বিষয়। তাঁর ঘুমাতে যাওয়া, ঘুম থেকে ওঠা, তাঁর নামাজ আদায় করা, হজ করা, স্ত্রী ও ঘরের মানুষদের সঙ্গে আচরণ, শিশু ও তরুণদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার— এমন নানা বিষয় জানা, যেসব ব্যাপারে তিনি শ্রেষ্ঠতম আদর্শ। তা যদি না জানা যায়, তাহলে তাঁকে কিভাবে আপনি অনুসরণ করবেন? আপনি যদি কাউকে না চেনেন, না জানেন- তাহলে আপনার পক্ষে তাকে ফলো করা সম্ভব নয়। তাকে অনুসরণ বা অনুকরণ করতে হলে তাকে আগে ভালোভাবে জানতে হবে।

১৪৫০ বছর আগে একটি অরাজক ও অমানবিকতাপূর্ণ সমাজে আল্লাহ তায়ালা রাসুলুল্লাহকে (সা.) পাঠান। তিনি এসে দ্বন্দ্ব-কলহ ও বিবাদপূর্ণ মক্কা ও মদিনায় সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। শৃঙ্খলা ফিরে আনেন। শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এটা সম্ভব হয়েছে যখন তাঁর অনুসারী সাহাবায়ে তাঁকে সেরা মডেল হিসেবে সর্বোচ্চ অনুসরণ-আনুগত্য বাস্তবায়ন করেছেন।

আমাদের আল্লাহ কয়জন? একজন। আমাদের নবী কয়জন? একজন। আমাদের কিতাব কয়টা? একটা। আর যদি বলি দল কয়টা? অনেক। কওমি ঘরানার ১৩টি ইসলামি দল; আহলে হাদিস ও সালাফি ঘরানায় ১৬টি, সুন্নি ঘরানায়ও অনেক দল। এমনকি তাবলিগ জামাতও দুইভাগে ভাগ হয়ে পড়েছে। এভাবে ইসলামের নামেও আমরা এক হতে পারিনি। এর কারণ— আমরা যাকে মডেল বানানো উচিত, তাকে মডেল মানছি না।

সব খানেই মডেল অনুসরণ করছি। রাজনীতিতে-ভোটাভুটিতে আমাদের মডেল আমেরিকাসহ পশ্চিমা রীতিনীতি। আমরা সব ধরনের মডেল চর্চা করছি। অথচ মদিনার মডেল আজ মসজিদের এক কোনায় ঢুুকরে ঢুকরে কাঁদছে। কারণ আমরা সিরাত থেকে দূরে সরে গেছি। রাসুল (সা.)-এর জীবনাদর্শ আমাদের কাছে নেই।

সেই সিরাত জানব কোথা থেকে? আসতে হবে কোরআনের কাছে। আল্লাহকে চিনতে যেমন কোরআন দরকার, তেমনি রাসুল (সা.)কে জানতে হলেও প্রয়োজন আল-কোরআন। কোরআনে মুহাম্মাদ নামে একটি সুরাই আছে। এ ছাড়াও তাঁর জীবনের ঘটে যাওয়া ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, সমর নীতিসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন সুরায়। এমনকি তাঁর শান ও সম্মানে কয়েকটি সুরা নাজিল হয়েছে। যেমন একটা ছোট সুরা, যা আমরা নামাজে দাঁড়ালেই মনে আসে সুরা আল-কাউসার। প্রথম রাকাতের সঙ্গে দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ইখলাস। একদম শর্টকাট নামাজ। এই হলো আমাদের নামাজের অবস্থা।

মনে রাখবেন, এ ডিজিটাল শর্টকাট সিস্টেম নামাজে নেই। নামাজ হবে ম্যানুয়ালি। সেই ১৪৫০ বছর আগে যেমন ছিল তেমন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ঠিক সেভাবে নামাজ পড়, যেভাবে আমাকে নামাজ পড়তে দেখ। (বুখারি ও মুসলিম) অর্থাৎ রাসুল (সা.) যেভাবে নামাজ পড়েছেন, ঠিক সেভাবেই নামাজ পড়তে হবে কেয়ামত পর্যন্ত। কিন্তু আমরা তা করি না, আমাদের সুবিধামতো শর্টকাট করে পড়ি। কারণ আমরা দাবি করি রাসুল (সা.) আমাদের মডেল, কিন্তু বাস্তবে তা মানি না। আমরা তো ভাই শোনার জাতি, বলার জাতি। বলতে চাই বেশি, শুনতে চাই কম। শিখতে চাই আরো কম। আর মানতে তো চাই-ই না। আফসোস, আমরা তাঁকে জানা বা বোঝার চেষ্টা করি না। জ্ঞান অর্জনে আমরা অনেক পিছিয়ে। কাউকে হেয় করার জন্য নয়, কথাগুলো দুঃখের সঙ্গে বলছি। এমন উদাসীনভাবে ইবাদত করে আল্লাহর কাছে গেলে কী জবাব দেব আমরা! এজন্য আমাদের জীবনের সব জায়গায় রাসুলকেই (সা.) একমাত্র মডেল মানতে হবে।আমাদের নামাজ নবী (সা.)-এর মতো হচ্ছে কি-না কোনো টেনশন নেই। কোরআন পড়ছি, নেকি গুনছি। অথচ কোরআন শুধু নেকি হাসিলের জন্য নাজিল হয়নি। পড়লে সওয়াব এটা অতিরিক্ত পাওয়া, এটা কোরআনের বরকত। কোরআন নাজিল হয়েছে মূলত আমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আনতে। কিন্তু আমরা শুধু অন্ধকারের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছি। কোরআনকে না বোঝা আর না মানার কারণে। আবারো বলি, আফসোস, আমাদের জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে ঘিরে আছে বিভিন্ন ধরনের মডেল। কিন্তু নেই শুধু ইসলামের মডেল। নেই রাসুলুল্লাহ’র (সা.) মডেল। রবিউল আউয়াল মাস চলছে, চারদিকে তাঁকে জানার বা বোঝার একটা জোয়ার ওঠার কথা, তাঁর আদর্শের চর্চা হওয়ার কথা। তা হচ্ছে কতটুকু?

শ্রেষ্ঠতম মডেল রাসুলুল্লাহ (সা.)

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আল-আহযাব: ২১ প্রথমাংশ) তিনি কেমন মডেল, কেমন আদর্শ? আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী। (সুরা আল-কলম: ৪) কাদের জন্য তাঁকে অনুসরণ ও অনুকরণ করা সহজ? আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’ (সুরা আল-আহযাব: ২১, শেষাংশ)

যার ভেতর আখিরাতের ভয় আছে, যে বিশ্বাস করে আমি যা-ই করি বিচারের দিনে তার জবাব আমাকে দিতে হবে। তার জন্যই আল্লাহর রাসুলকে (সা.) মডেল মানা সম্ভব।

কর্মহীনদের মডেলও মহানবী (সা.)

ফজর পড়ে অথবা না পড়ে আরামের বিছানা ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছেন কর্মের উদ্দেশ্যে। কারণ আপনার পরিবারের বোঝা আপনার কাঁধে। এ বোঝা সামলাতে গিয়ে অনেকে পাগল হয়ে যায়, আত্মহত্যা করে, মাজারে মাজারে ঘোরে, বিপথে চলে যায়। সারাটা দিন একটানা খাটুনি, বাসায় আসছেন, মেজাজ খিটখিটে, অল্পতেই হতাশ হয়ে যায়, তার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারে না। যদি কেউ আল্লাহর রাসুল (সা.)কে মডেল মানে তাহলে এগুলোর কোনোটাই তাকে ভেঙে পড়তে দেবে না।

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমার স্ত্রীর মুখে লোকমা তুলে দেয়াও সদকা।’ (বুখারি) রাসুল (সা.)-এর এ শিক্ষাটা যদি কারো মধ্যে থাকে, তাহলে কি তার ভেতর হতাশা থাকবে? না, সাময়িক হয়তো পরিশ্রান্ত, দুর্বল লাগবে কিন্তু খানিক বাদে সব ঠিক হয়ে যাবে।

কর্মের প্রেরণায় মডেল রাসুল (সা.)

আজ দেশে বেকারত্বের বিশাল বোঝা। ২৬ লাখ শিক্ষিত নাগরিকের চাকরি নেই! যুবকরা পড়ালেখা শেষ করে চাকরিতে ঢোকে না। বেতন কম, পড়ার মানের সঙ্গে যায় না। এভাবে সে বেকার হয়ে যায়, হয়ে পড়ে পিতামাতার জন্য বোঝা। তার মধ্যে যদি রাসুল (সা.)-এর আদর্শ থাকত তাহলে তাকে এমন জীবন পোহাতে হতো না! এক যুবক পাহাড় থেকে কাঠ কেটে আনছে আর সারা শরীর থেকে ঘাম বেয়ে পড়ছে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বলতে লাগলেন, সে যদি পরিবারের ভরণপোষণের জন্য কাঠ না কেটে এই সুঠাম দেহ নিয়ে জিহাদের শরিক হতো! রাসুল (সা.) বললেন, কী বলছ তোমরা? (এটা ভুল মেসেজ, ভুল মোটিভেশন) তার পরিশ্রম দিয়ে সে তার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে গিয়ে থাকে, তবে সে ইতোমধ্যেই জিহাদে নিয়োজিত আছে। মুসলিমদের ছেলেদের মধ্যে কেন বেকারত্ব বাড়ছে? কারণ পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে তাদের জন্য রাসুল (সা.)-এর জীবনী শেখানো হয় না, তাঁর আদর্শ বোঝানো হয় না। আজ তাদের সেখানো হচ্ছে মানবরচিত পশ্চিমাদের সংস্কৃতি। নিজের হাতে কাজ করাটা তারা আজ নিচু মানের কাজ মনে করছে। অথচ হাদিসে এসেছে, খাদিজা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, সর্বোত্তম আয়-উপার্জন কোনটি? জবাবে নবীজি বলেন, ‘ব্যক্তির নিজ শ্রমে অর্জিত উপার্জন ও সততার ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়।’ (মুসনাদে আহমদ)

যুবকদের মডেল রাসুল (সা.)

আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন যৌবনের দুয়ারে তখন তিনি দেখলেন, মক্কায় বিদেশি লোক এলে তার জানমাল অনিরাপদ, মেয়েদের সম্মান নেই, শিশু থেকে বৃদ্ধরা পর্যন্ত অনিরাপদ। জাহেলি যুগের এসব অসংগতি দূর করতে তিনি সমবয়সি যুবকদের নিয়ে ‘হিলফুল ফযুল’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করলেন। এ আদর্শ আমাদের যুবকদের মধ্যে নেই। তাই যুবকরা সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে কাজ না করে বখে যাচ্ছে। হতাশায় ভুগছে কিংবা অসামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ছে।

তিনি শিক্ষক হিসেবেও মডেল

রাসুলুল্লাহ (সা.) হচ্ছেন আমাদের ইমাম। তাঁকে সেভাবেই অনুসরণ করা উচিত ছিল যেভাবে আমরা নামাজে ইমামের অনুসরণ করি। ইমাম যা-ই করেন আমরাও তা-ই করি। ইমামরা হলেন আমাদের শিক্ষক। নবী (সা.) কোনো বিদ্যালয় বা গোষ্ঠীর শিক্ষক ছিলেন না, তিনি পুরো মানবতার শিক্ষক। সব যুগে সব খানে তিনিই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসলিম)

নারীদের জন্যও শ্রেষ্ঠ মডেল

আমাদের মা-বোনেরা, তাদের জীবনের লক্ষ্য কী? অধিকাংশই নিমজ্জিত উদাসীনতায়। জীবনের লক্ষ্য আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার প্রাপ্তি। কারণ তাদের মাঝেও রাসুল (সা.)-এর মডেল নেই। ছাত্রজীবনে ভালো রেজাল্ট আর ভালো জীবনসঙ্গী পাওয়ার টার্গেট থাকে। তারপর বিবাহিত জীবনে পাওয়া না পাওয়া নিয়ে হতাশা, স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য একপর্যায়ে ডিভোর্স পর্যন্ত হয়ে যায়। সন্তান লালন-পালনে নেই তাদের কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা। মা-বোনেরা, আপনারাও কিসের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত? আপনি ইহকালের ক্ষুদ্র টার্গেটের পেছনে না ছুটে ইচ্ছে করলে হতে পারেন খালিদ বিন ওয়ালিদ, তারেক বিন জিয়াদ, সালাউদ্দিন আইয়ুবির মতো বীরের মা। আপনারা হলেন জাতি গড়ার প্রথম ও প্রধান কারিগর। সেটাই তো আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।

পিতা হিসেবে শ্রেষ্ঠ মডেল

আদরের দুলালি বেহেশতের নারীদের সর্দার ফাতেমা (রা.)কে আল্লাহর নবী (সা.) কিভাবে তৈরি করেছেন দেখুন। ফাতেমা (রা.) নিজের হাতে যাতা ঘুরিয়ে ও সংসারের সব কর্ম একা করতে কষ্ট পেতেন। আলী (রা.) তাঁকে পরামর্শ দেন, তোমার আব্বার কাছে যুদ্ধলব্ধ একটি দাসী চাও, যে তোমাকে সংসারকর্মে সাহায্য করবে। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করতে এসে তাঁকে না পেয়ে ফিরে যান। রাতে তাঁরা বিছানায় শুয়ে পড়লে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁদের কাছে আসেন। তিনি বলেন, ‘আমার আসহাবে সুফফার দরিদ্র সাহাবিদের বাদ দিয়ে তোমাকে কোনো দাসী দিতে পারব না। তবে দাসীর চেয়েও উত্তম বিষয় তোমাদেরকে শিখিয়ে দিচ্ছি। তোমরা যখন বিছানায় শুয়ে পড়বে তখন ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’, ৩৩ বার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ এবং ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে। (বুখারি, মুসলিম) আদরের কন্যাকে তিনি ভোগ নয় ত্যাগ শেখালেন।

শ্বশুর হিসেবে শ্রেষ্ঠ মডেল

আলী (রা.) ও ফাতিমা (রা.)-এর মধ্যে মনোমালিন্য হলে রাসুল (সা.) যেভাবে তাদের মিলিয়ে দিতেন। সাহল বিন সাদ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) একদিন ফাতিমা (রা.)-এর বাসায় গিয়ে আলী (রা.)কে ঘরে পেলেন না। তিনি ফাতিমা (রা.)কে জিজ্ঞাসা করলেন, আলী (রা.) কোথায়? তিনি বললেন, আমার ও তাঁর মধ্যে কিছু ঘটেছে। তিনি আমার সঙ্গে রাগ করে বাইরে চলে গেছেন। আমার কাছে দুপুরের বিশ্রামও করেননি। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে বললেন, দেখ তো সে কোথায়? সে ব্যক্তি খুঁজে এসে বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! তিনি মসজিদে শুয়ে আছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এলেন, তখন আলী (রা.) কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন। তাঁর শরীরের এক পাশের চাদর পড়ে গিয়েছে এবং তাঁর শরীরে মাটি লেগেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর শরীরের মাটি ঝেড়ে দিতে দিতে বললেন, ‘উঠ, হে আবু তুরাব! (মাটিওয়ালা) উঠ, হে আবু তুরাব’। (বুখারি)

এভাবে জামাতার মন নরম করে মেয়ে আর জামাইকে মিল করে দিয়েছেন রাসুল (সা.)। শ্বশুর হিসেবে আমাদের মাঝে নেই রাসুল (সা.)-এর সেই উত্তম আদর্শ। তাঁকে মডেল মানছি না বলেই আমাদের পরিবারে এত কলহ।

ঐক্য প্রতিষ্ঠায় শ্রেষ্ঠ মডেল তিনি

আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তোমরা একযোগে আল্লাহর রজ্জু সুদৃঢ় রূপে ধারণ কর ও বিভক্ত হয়ো না এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর যে দান রয়েছে, তা স্মরণ কর। যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, তখন তিনিই তোমাদের অন্তঃকরণে প্রীতি স্থাপন করেছিলেন, অতঃপর তোমরা তাঁর অনুগ্রহে ভ্রাতৃত্বে আবদ্ধ হলে এবং তোমরা অনল কুণ্ডের ধারে ছিলে, অনন্ত তিনিই তোমাদেরকে তা থেকে উদ্ধার করেছেন।’ (সুরা আলে ইমরান: ১০৩)

মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রহ.) বলেন, আউস ও খাযরাজের মধ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে শত্রুতা ছিল, অথচ তারাও পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেছে দেখে ইহুদিরা চোখে আঁধার দেখতে থাকে। লোক নিযুক্ত করে যেন তারা আউস ও খাযরাজের সভাস্থলে গমন করে এবং তাদেরকে তাদের পুরাতন যুদ্ধ-বিগ্রহ ও শক্রতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাদের নিহত ব্যক্তিদের কথা যেন নতুনভাবে তাদেরকে মনে করিয়ে দেয় এবং এভাবে যেন তাদেরকে উত্তেজিত করে তোলে। এ ওষুধ একদা তাদের ওপর পড়েও যায় এবং উভয় গোত্রের মধ্যে পুরাতন অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে। এমনকি তাদের মধ্যে তরবারি চালনারও উপক্রম হয়ে যায়। সেই অজ্ঞতার যুগের গণ্ডগোল ও চিৎকার শুরু হয়ে যায় এবং একে অপরের রক্তপিপাসু হয়ে পড়ে। স্থির হয় যে, তারা হুররার প্রান্তরে গিয়ে প্রাণ খুলে যুদ্ধ করবে এবং পিপাসার্ত ভূমিকে রক্ত পানে পরিতৃপ্ত করবে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) এ সংবাদ জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং উভয় দলকে শান্ত করে দেন। অতঃপর তিনি তাদের উভয় দলকে বলেন— ‘পুনরায় তোমরা অজ্ঞতা যুগের ঝগড়া শুরু করে দিলে? আমার বিদ্যমানবস্থায় তোমরা পরস্পরের মধ্যে তরবারি চালনা আরম্ভ করলে?’ তারপরে তিনি তাদেরকে এ আয়াতটি পাঠ করে শুনিয়ে দেন। এতে সবাই লজ্জিত হয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পূর্বের কার্যের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করতে থাকে। আবার তারা পরস্পরে কোলাকুলি করে এবং হাতে হাত মিলিয়ে নেয়। পুনরায় তারা ভাই ভাই হয়ে যায়। (ইবনে কাসির)

হুনায়ন যুদ্ধে বিজয় লাভের পর ধর্মীয় মঙ্গলের কথা চিন্তা করে রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন যুদ্ধলব্ধ মাল বণ্টন করতে গিয়ে কোনো কোনো লোককে কিছু বেশি প্রদান করেন তখন এক লোক কিছু কটূক্তি করে। ফলে রাসুলুল্লাহ (সা.) আনসার দলকে একত্রিত করে একটি ভাষণ দান করেন। ওই ভাষণে তিনি একথাও বলেন, ‘হে আনসারের দল! তোমরা কি পথভ্রষ্ট ছিলে না? অতঃপর আমার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে সুপথ-প্রদর্শন করেন? তোমরা কি দলে দলে বিভক্ত ছিলে না? অতঃপর আল্লাহ আমারই কারণে তোমাদের অন্তরে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি স্থাপন করেন। তোমরা দরিদ্র ছিলে না? অতঃপর আল্লাহ আমারই মাধ্যমে তোমাদেরকে সম্পদশালী করেন? প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তরে এ পবিত্র দলটি আল্লাহর শপথ করে সমস্বরে বলে উঠেন— আমাদের ওপর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর অনুগ্রহ এর চেয়েও বেশি রয়েছে।

তাই আসুন জীবনের সব স্তরে নবীজিকে মডেল মানি। তাঁর আদর্শ বাস্তবায়ন করে জীবনকে সুন্দর করি।

২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ টঙ্গীর আন-নূর জামে মসজিদে কৃত জুমাপূর্ব আলোচনা থেকে অনুলিখন— মুহা. আব্দুল খালেক আশিক

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ