ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বামী হিসেবে যেমন ছিলেন মহানবী (সা.)

প্রকাশনার সময়: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৫

রাসুল (সা.)-এর জীবনচরিত গোটা মানবতার জন্য চলার দিশা, উত্তম নির্দেশিকা। জীবনের প্রতিটি বাঁকে মানুষকে পথ দেখায় সিরাত। জীবনের আধারে ঘেরা দিকগুলোকে আপন রৌশনিতে দীপ্তময় করে তোলে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হলো পবিত্র ও বরকতময়। বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা ও মজবুত করার ক্ষেত্রে স্বামীর ভূমিকা অপরিসীম। ইসলামও বিবাহের লাগাম তার হাতে অর্পণ করেছে। এজন্যই একজন স্বামীর স্ত্রীর সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক হওয়া উচিত? সাংসারিক জীবনে কী হবে তার কর্মপন্থা? তার জন্য আমাদের সিরাত থেকে শিক্ষা নেয়া এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা আবশ্যক।

স্ত্রীর কাজে সহযোগিতা

রাসুল (সা.) এর কাঁধে নবুয়্যতের সুমহান দায়িত্ব অর্পিত ছিল। ফলে বহির্জীবন অত্যন্ত ব্যস্ততাপূর্ণ ও ধৈর্য পরীক্ষার ক্ষেত্র ছিল। তথাপি তাঁর মোবারক সুন্নত ছিল, যখন ঘরে আগমন করতেন কখনো আটা পিষতেন, কখনো ঘরের অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ করে স্ত্রীকে সহযোগিতা করতেন।

আয়েশা (রা.)কে রাসুলের ঘরোয়া আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, উত্তরে তিনি বলেন— মাথা থেকে উকুন বের করতেন, বকরির দুধ দোহন করতেন, নিজ কাপড় সেলাই করতেন, নিজের জুতা সেলাই করতেন, নিজের কাজ নিজেই সম্পাদন করতেন। সেই সব কাজ করতেন যেগুলো পুরুষরা সাধারণত নিজের ঘরে করে থাকে। তিনি নিজের পারিবারিক লোকদের সেবায় নিয়োজিত থাকতেন (ঘরে থাকাকালীন)। যখন আজান হতো তখন কাজ ছেড়ে মসজিদে চলে আসতেন (মুসনাদে আহমাদ)।

রাসুল (সা.) এর কর্মপন্থা থেকে এক সফল ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের মূলনীতি জানা যায়। এটা ঠিক যে নারী-পুরুষের মাঝে কর্ম বণ্টিত আছে, পুরুষ বাহিরের ও নারী ঘরোয়া কাজের দায়িত্বশীল। তবুও এ বন্ধনকে মিল-মুহাব্বতের উপমা ও আরো মজবুত করতে স্বামীর ওপর এ দায়িত্ব অর্পিত হয় যে, সে নারীর কাজে আন্তরিক হবে, ঘরোয়া কাজে তাকে সহযোগিতা করবে এবং ঘরোয়া কাজে তাকে পরামর্শ দেবে।

নারীর মতামতের মূল্যায়ন

রাসুল (সা.) এর বৈবাহিক জীবনের এক আদর্শ ও সুস্পষ্ট বিষয় এই ছিল, তিনি সম্মানিতা স্ত্রীদের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেন। হোদায়বিয়া সন্ধির সময় মক্কার কাফেররা হুজুর (সা.) ও প্রায় ১৫০০ সাহাবায়ে কেরামকে ওমরা পালনে বাধা প্রদান করল এবং হুজুর (সা.) অস্বাভাবিকভাবে অন্তর্দৃষ্টি, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার কারণে কাফেরদের দ্বারা বাহ্যিকভাবে পরাভূত হয়ে সন্ধি করে নিলেন। সন্ধিপত্র লেখার পর হুজুর (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে বললেন দাঁড়িয়ে যাও! নিজেদের জন্তুকে কোরবানি করো! তিনবার বলার পরও সাহাবায়ে কেরাম যারা মানসিকভাবে ব্যথিত ও মনঃক্ষুণ্ন ছিলেন তারা দাঁড়ায়নি, কোরবানিও করেনি। তখন হুজুর (সা.) উম্মে সালামা (রা.)-এর কাছে আগমন করলেন এবং সাহাবায়ে কেরামের এ আচরণের বর্ণনা দিলেন। উম্মে সালামা (রা.) যিনি বুঝমান ও বুদ্ধিমতী ছিলেন। বললেন আপনি তাদেরকে কিছুই বলবেন না বরং আপনি দাঁড়িয়ে নিজ উট জবেহ করুন এবং হলোক করান।

হুজুর (সা.) তাঁর মতামত কবুল করলেন এবং হলক করালেন। হুজুর (সা.)-এর কর্মতৎপরতা দেখে সাহাবায়ে কেরামও কোরবানি করলেন এবং হলক করালেন। আমলের ক্ষেত্রে এতই ভিড় হলো যে, একজন অপর জনের ওপর পরার উপক্রম। এতই তড়িৎগতির ছিল যে, প্রত্যেকেই নেড়ে করা বা চুল ছাটার খেদমত আঞ্জাম দিতে লাগলেন। (বুখারি: ২৭৩১) এর দ্বারা বুঝে আসে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নারীর মতামত নেয়া উচিত। তাদের মতামত সুন্দর ও পছন্দনীয় হলে, সেটার ওপর আমল করাও উচিত।

পরিবারের লোকদের দ্বীনের ফিকির

রাসুল (সা.)-এর বৈবাহিক জীবনের আলোকময় ও অনুসরণীয় দিক এটিও যে, তিনি ঘরের লোকদের দ্বীনদারিতার চিন্তা করতেন। তাদেরকে দ্বীনদার বানানোর চেষ্টা করতেন। আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) যখন ঘরে আসতেন তখন এ বাক্য বারংবার বলতেন, যদি আদম সন্তানের কাছে সম্পদে পূর্ণ দু’টি ময়দান থাকে, তবু সে তৃতীয় আরেকটি ময়দান পাওয়ার প্রতি লোভ করবে। তার লোভের মুখ শুধু কবরের মাটিই ভরতে পারবে। (শুয়াবুল ঈমান: ৯৭৯৯) হুজুর (সা.) এর এ কালিমা বারংবার বলার উদ্দেশ্য এই ছিল, নিজ পরিবারের লোকদেরকে দুনিয়ার অসাড়তা ও ধ্বংস হওয়ার বিশ্বাস অন্তরে সৃষ্টি করা। বর্তমানে এ দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, প্রচুর পরিমাণ পুরুষ নামাজ আদায় করে এবং গুরুত্বের সঙ্গে কোরআন তিলাওয়াত ও নফল নামাজ পড়ে কিন্তু তাদের ঘরে দ্বীনের পরিবেশ নেই, তার স্ত্রী-কন্যা ফরজ ওয়াজিব থেকে উদাসীন এবং অলসতা করে থাকে। রাসুল (সা.)-এর সিরাত থেকে আমরা এ শিক্ষাই পাই, আমরা নিজেদের পরিবারের লোকদের দ্বীনদার বানানোর চেষ্টা করব এবং তাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক চলার ব্যাপারে অভ্যস্ত করব।

স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ

স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও সম্পর্কের প্রকাশও এ বন্ধনকে মজবুত করার ক্ষেত্রে অপরিসীম ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর স্ত্রীদের প্রতি সময়ে সময়ে ভালোবাসা ও মুহাব্বত প্রকাশ করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, একবার আমি পানি পান করছিলাম। এমন সময় রাসুল (সা.) ঘরে আগমন করলেন। ঘরে প্রবেশ করে তিনি বললেন, আয়েশা! একটু পানি রেখো, আমিও সামান্য পানি রেখে দিলাম। তিনি সন্নিকটে আসলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি পাত্রের কোন অংশে মুখ লাগিয়ে পান করেছ? আয়েশা (রা.) বলার পর হুজুর (সা.) পাত্রের ওই অংশ দিয়ে পানি পান করেন। (নাসায়ী)

স্ত্রীর আত্মীয় ও প্রিয়জনের প্রতি খেয়াল রাখা

আয়েশা (রা.) বলেন, খাদিজা (রা.)-এর প্রতি আমার ঈর্ষা হতো অথচ আমি তাকে কখনোই দেখিনি। ঈর্ষার কারণ এই ছিল, রাসুল (সা.) বেশি পরিমাণে তার আলোচনা করতেন, কখনো বকরি জবেহ করলে খাদিজা (রা.) এর বান্ধবীদের গোশত দিতেন। (বুখারি)

এর দ্বারা আমরা এটাই শিক্ষা পাই, স্ত্রীর আত্মীয় ও বান্ধবীদের সঙ্গে উত্তম ও কল্যাণকামিতার আচরণ করা। সময়ে সময়ে তাদের জন্য হাদিয়া পাঠানো। স্ত্রীর সামনে তার আত্মীয়দের খারাপ না বলা, তাদের নিন্দা না করা। এতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মজবুত ও মুহাব্বত বৃদ্ধি পাবে। বৈবাহিক জীবন হবে শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যময়।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ