ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সিরাতের সান্নিধ্যে ঈমানের মজবুতি

প্রকাশনার সময়: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২২:৩৮

নবী (সা.)-এর পবিত্র সিরাত পাঠের মাধ্যমে আমরা জ্ঞান-প্রজ্ঞা, দ্বীন-ঈমান, আদব-আখলাক, আদর্শ জীবন গঠন ও আল্লাহর দিকে দাওয়াত ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে অতুলনীয় পাথেয় অর্জন করতে পারি। আজ আমরা আলোচনা করছি সিরাত পাঠ কীভাবে আমাদের মাঝে ঈমানের মজবুতি ও দূঢ়তা তৈরি করে।

পবিত্র সিরাত পাঠের অনন্য প্রাপ্তি হচ্ছে ঈমান-বৃদ্ধি। প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাস সাক্ষী, পবিত্র সিরাত যুগে যুগে অসংখ্য মানুষকে ঈমানের পথ দেখিয়েছে। নবী (সা.)-এর ওপর নাজিল হওয়া কোরআন, সেই কোরআনের আলোয় উদ্ভাসিত তাঁর বাস্তব জীবন, তাঁর অনন্য চরিত্র-মাধুর্য, তাঁর মহত্ব, মহানুভবতা যুগে যুগে অসংখ্য মানুষকে ঈমান ও বিশ্বাসের স্নিগ্ধ ছায়াতলে নিয়ে এসেছে। তাঁঁর পবিত্র জীবন তাঁর নবুওত ও রিসালাতের এক দেদীপ্যমান প্রমাণ, যার প্রভাব কোনো ন্যায়নিষ্ঠ হূদয় ও মস্তিষ্ক এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই তাঁর পবিত্র জীবন ও কর্ম ঈমানের আলোক বঞ্চিত প্রত্যেক ন্যায়নিষ্ঠ মানবের পক্ষে ঈমান লাভের মাধ্যম আর ঈমানের আলোকপ্রাপ্ত সৌভাগ্যবান মানবের ঈমান-বৃদ্ধির উপায়। তবে এর জন্য খোলা মন নিয়ে পবিত্র সিরাতের সান্নিধ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সৌভাগ্যবান মুমিনের জন্য পবিত্র সিরাতের অধ্যয়ন ও আনুগত্য যে অনন্য প্রাপ্তি নিয়ে আসে তা হচ্ছে, নবী (সা.)-এর মহব্বত ও ভালোবাসা। মুমিন যতই তাঁকে জানবে ততই তাঁর মহানুভবতার সঙ্গে পরিচিত হবে, মানবজাতির প্রতি তাঁর মহাঅনুগ্রহের দিগন্ত ততই তার সামনে উন্মোচিত হতে থাকবে। মানুষ তো মানুষকে তার মনুষ্যত্ব, মহানুভবতা ও অনুগ্রহের কারণে ভালোবেসে থাকে।

মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) সিরাত পাঠের উপকারিতা বর্ণনা করে লেখেন— সিরাত অধ্যয়নের দ্বারা নিজের নবী (সা.)-এর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরিচিতি লাভ হবে। আর এ পরিচয় লাভের মাধ্যমে অনিবার্যভাবে সৃষ্টি হবে, নবীজির প্রতি ভালোবাসা। যে ভালোবাসার দরুন সত্য প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী লাভ হবে জান্নাতে তাঁর সঙ্গ ও সান্নিধ্য। আর এটা যে এক মহানিআমত তাতে কি কারো দ্বিমত আছে? (ভূমিকা, বাণী অংশ, সীরাতে মুস্তফা মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী)

এই মহব্বত ও ভালোবাসাই হচ্ছে ওই মহাসম্পদ, যা দ্বীনের পথে চলা সহজ করে দেয়। এ পথের ছোট-বড় ত্যাগ ও কোরবানিকেও বানিয়ে দেয় এক অপার্থিব আনন্দের উপকরণ, যার প্রাণবন্ত নমুনা দেখা যায় তাঁর মহান সাহাবিদের জীবন ও কর্মে।

এ প্রসঙ্গে মুফাককিরে ইসলাম মাওলানা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর একটি বক্তব্য তুলে দিচ্ছি, যা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিষয়বস্তুর গভীরতা উপলব্ধির পক্ষে সহায়ক হবে বলে মনে করি। তিনি লেখেন— ‘রাসূল (সা.)-এর পরিপূর্ণ ও খাঁটি আনুগত্য, তাঁর আদব-আখলাকের অনুসরণ, শরীয়তের নীতি ও বিধানকে প্রবৃত্তির চাহিদা ও সামাজিক রসম-রেওয়াজের ওপর প্রাধান্য দেওয়া এবং দাওয়াতের পথে জান-মালের কোরবানি পেশ করা কিছুতেই সম্ভব নয়, যদি এই গভীর, আন্তরিক ও মন-মস্তিষ্ককে আচ্ছন্নকারী মহব্বত না থাকে। এ কারণে কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে— ‘বল, তোমাদের কাছে যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের বংশ, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের সেই ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশঙ্কা কর এবং তোমাদের বাসস্থান, যা তোমরা ভালোবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।’ (সূরা তাওবা: ২৪)। এ মহব্বতের কারণেই সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সা.)-এর আনুগত্যের বিষয়ে লালায়িত ও আগুয়ান ছিলেন এবং এক্ষেত্রে অনুপম প্রাণবন্ততা, ধৈর্যশীলতা, সংযম ও কষ্ট-সহিষ্ণুতার স্বাক্ষর রেখেছেন। এসব বিষয়ে তাঁরাই সর্বযুগে সর্বশ্রেষ্ঠ।

সিদ্দীকে আকবর (রা.)-এর দৃষ্টান্ত দেখুন। রাসূল (সা.)-এর প্রাণ তাঁর কাছে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয় ছিল। নিজের জীবন ও সুস্থতার চেয়েও তিনি অগ্রগণ্য মনে করতেন নবী (সা.)-এর জীবন ও সুস্থতাকে। ফলে নিষ্ঠুর উতবা ইবনে রবিআ যখন তাঁর মুখমণ্ডল আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল, তাঁর বুকের ওপর চড়ে বসে তার ওপর নিদারুণ নির্যাতন করেছিল, খবর পেয়ে তার গোত্র বনু তাইম তাকে এমন অবস্থায় উদ্ধার করল যে, তার মারা যাওয়ার ব্যাপারে কারো সংশয় ছিল না। এ অবস্থায়ও দিন শেষে হুঁশ ফিরে পাওয়ার পর সবার আগে যে কথা তার মুখে উচ্চারিত হয়েছিল তা হলো— রাসূলুল্লাহ (সা.) নিরাপদ আছেন তো? কওমের লোকেরা তাকে আশ্বস্ত করার পরও তিনি নিশ্চিত হতে পারলেন না, বললেন— ‘আল্লাহর কসম! আমি ওই পর্যন্ত দানাপানি স্পর্শ করব না, যে পর্যন্ত না তাঁর সান্নিধ্য ও দর্শন পাই!’ (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৩/৩০)।

এ রকম প্রাণোৎসর্গকারী আশিকদের আরেক দৃষ্টান্ত ওই আনসারি সাহাবিয়া, যাকে উহুদ যুদ্ধের পর একে একে তাঁর বাবা, ভাই ও স্বামীর শাহাদাতের সংবাদ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু এসব সংবাদকে উপেক্ষা করে তিনি শুধু রাসূল (সা.)-এর নিরাপদ থাকার সংবাদই জানতে চাচ্ছিলেন। লোকেরা যখন তাকে নবী (সা.)-এর নিরাপদ থাকার সংবাদ জানাল এবং তিনি স্বচক্ষে তাঁর দর্শন লাভ করলেন তখন বলে উঠলেন— ‘আল্লাহর রাসূল! আপনি যখন নিরাপদ আছেন তো সব মুসিবত আমার কাছে তুচ্ছ।’ (দালাইলুন নুবুওয়াহ, বায়হাকি: ৩/৩০২; সীরাতে ইবনে হিশাম: ২/৯৯)।

এমনই উৎসর্গপ্রাণ সাহাবিদের একজন আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ বিন উবাই, যিনি তার বাবা (বিখ্যাত মুনাফেক) আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে বলতে শুনেছিলেন— ‘আমরা মদিনায় ফেরার পর সম্মানিত লোকেরা তুচ্ছ লোকদের বের করে দেব।’ তিনি তখন বাবার বিরুদ্ধে মদিনার দরজায় তরবারি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, তোমরাই এমন কথা বলেছিলে? তো এখনই প্রমাণ হয়ে যাবে, সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত কি তোমরা, না রাসূলুল্লাহ! তোমরা ওই পর্যন্ত মদিনার ছায়ায় ঢুকতে পারবে না, যে পর্যন্ত না রাসূল (সা.) তোমাদের ঢোকার অনুমতি দেন। এরপর সত্যি সত্যি তিনি নবী (সা.)-এর অনুমতির আগ পর্যন্ত তার বাবাকে মদিনায় ঢুকতে দেননি।

এই জযবা ও নবীপ্রেমের কারণেই তারা তাদের প্রাণকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বের হতে পেরেছিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য স্বজন-স্বদেশ ত্যাগ করা ও আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাতবরণ করা তাদের জন্য সহজ হয়ে গিয়েছিল। বরং হিজরত ও শাহাদাতের বিপরীতে প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকাই তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। এ অতুলনীয় সমর্পণ ও ভালোবাসার কারণেই বদরের যুদ্ধের সময় তারা বলতে পেরেছিলেন— ‘আমাদের সব বিষয় আপনার হুকুমের অধীন। আল্লাহর কসম! আপনি যদি সুদূর বারক গামদান পর্যন্তও ভ্রমণ করেন আমরা আপনার সঙ্গেই থাকব। আল্লাহর কসম! আপনি যদি আদেশ করেন তাহলে এই সমুদ্রেও আমরা আপনার সাথে ঝাঁপ দেব।’

রাসূল (সা.)-এর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের এ অতুলনীয় ভালোবাসার বৃত্তান্ত আলোচনা করার পর মুফাক্কিরে ইসলাম আলী নদভী (রহ.) লেখেন— ‘আজ মুসলিম জাহানে শরিয়তের বিধি-বিধান পালনে যে ত্রুটি, নেক আমলের ব্যাপারে যে উদাসীনতা, ত্যাগ ও কষ্টের যে কোনো বিষয়ে যে পলায়নপরতা এবং সুন্নতের পাবন্দির ক্ষেত্রে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের যে অবসাদ, আলস্য— এই সবকিছুর মূলেই আছে রাসূল (সা.)-এর মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের অনুপলব্ধি। যে ব্যাপারে স্বয়ং কোরআন মাজিদে অত্যন্ত তাকিদ রয়েছে। এরই সঙ্গে রাসূল (সা.)-এর প্রতি মহব্বত-ভালোবাসার অভাবও এর এক বড় কারণ।

মনে রাখতে হবে, নবী (সা.)-এর ভালোবাসাই হচ্ছে ওই প্রাণসঞ্জিবনী প্রেরণা, যা আশ্চর্য শক্তি ও উদ্যমের উৎস হিসেবে এবং ইতিহাসের বিস্ময়কর কীর্তি ও ঘটনাবলির জন্য অতীতেও প্রসিদ্ধ ছিল, বর্তমানেও প্রসিদ্ধ। এ প্রেম ও জযবার শূন্যস্থান বিচাির-বুদ্ধি, সংকল্প ও ব্যবস্থার প্রাচুর্য দ্বারা কিছুতেই পূরণ করা যাবে না। এটা এমনই এক অপূর্ণতা, যার ক্ষতিপূরণ অন্য কিছু দ্বারা কিছুতেই সম্ভব নয়।’ (মানসিবে নবুওত আওর উসকে আলী মাকাম হামেলীন, পৃ. ১২৮-১৩১)।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ