মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

অমুসলিমদের সঙ্গে মহানবীর মহানুভবতা

প্রকাশনার সময়: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২২:৪৪

একটি মুসলিম দেশে ইসলাম মুসলমানকে শুধু অমুসলিমদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করতেই বলে না, রাষ্ট্রে তাদের সার্বিক নিরাপত্তা এবং সুখ-সমৃদ্ধিও নিশ্চিত করে। পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহয় একাধিক স্থানে অমুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকার তুলে ধরা হয়েছে। অমুসলিমরা নিজ নিজ উপাসনালয়ে উপাসনা করবেন। নিজ ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মালয়কে সুরক্ষিত রাখবেন। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তারা সমান। তাদের প্রতি কোনো প্রকার বৈষম্য ইসলাম বরদাশত করে না। যেসব অমুসলিমের সঙ্গে কোনো সংঘাত নেই, যারা শান্তিপূর্ণভাবে মুসলিমদের সঙ্গে বসবাস করেন তাদের প্রতি বৈষম্য দেখানো নয়; ইনসাফ করতে বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ নিষেধ করেন না ওই লোকদের সঙ্গে সদাচার ও ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে যারা তোমাদের সঙ্গে ধর্মকেন্দ্রিক যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের আবাসভূমি হতে তোমাদের বের করে দেয়নি। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন।’ (সূরা আল-মুমতাহিনা, আয়াত: ৮)।

আল্লাহতায়ালা ঈমানের দাবিদার প্রতিটি মুসলমানকে নির্দেশ দিয়েছেন পরমতসহিঞ্চুতা ও পরধর্মের বা মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তারা আল্লাহর বদলে যাদের ডাকে, তাদের তোমরা কখনো গালি দিয়ো না, নইলে তারাও শত্রুতার কারণে না জেনে আল্লাহতায়ালাকেও গালি দেবে, আমি প্রত্যেক জাতির কাছেই তাদের কার্যকলাপ সুশোভনীয় করে রেখেছি, অতঃপর সবাইকে একদিন তার মালিকের কাছে ফিরে যেতে হবে, তারপর তিনি তাদের বলে দেবেন, তারা দুনিয়ার জীবনে কে কী কাজ করে এসেছে।’ (সূরা আল আনআম, আয়াত: ১০৮)।

কোনো বিধর্মী উপসনালয়ে সাধারণ অবস্থা তো দূরের কথা যুদ্ধাবস্থায়ও হামলা করা যাবে না। কোনো পুরোহিত বা পাদ্রির প্রতি অস্ত্র তাক করা যাবে না। কোনো উপসনালয় জ্বালিয়ে দেয়া যাবে না। হাবীব ইবন অলিদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) সৈন্যদল প্রেরণকালে বলতেন, ‘তোমরা আল্লাহ ও আল্লাহর নামে আল্লাহর পথে যাত্রা কর। তোমরা আল্লাহর প্রতি কুফরকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আমি তোমাদের কয়েকটি উপদেশ দিয়ে প্রেরণ করছি : (যুদ্ধক্ষেত্রে) তোমরা বাড়াবাড়ি করবে না, ভীরুতা দেখাবে না, (শত্রুপক্ষের) কারো চেহারা বিকৃতি ঘটাবে না, কোনো শিশুকে হত্যা করবে না, কোনো গির্জা জ্বালিয়ে দেবে না এবং কোনো বৃক্ষও উৎপাটন করবে না।’ (আবদুর রাযযাক, মুসান্নাফ: ৯৪৩০)।

এদিকে মুতার যুদ্ধে রওনার প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দেন : ‘তোমরা কোনো নারীকে হত্যা করবে না, অসহায় কোনো শিশুকেও না; আর না অক্ষম বৃদ্ধকে। আর কোনো গাছ উপড়াবে না, কোনো খেজুরগাছ জ্বালিয়ে দেবে না। আর কোনো গৃহও ধ্বংস করবে না।’ (মুসলিম: ১৭৩১)।

আরেক হাদিসে আছে, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের কোনো বাহিনী প্রেরণ করলে বলতেন, ‘তোমরা গির্জার অধিবাসীদের হত্যা করবে না।’ (ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ : ৩৩৮০৪; কিতাবুল জিহাদ, যুদ্ধক্ষেত্রে যাদের হত্যা করা নিষেধ অধ্যায়)।

আবু বকর (রা.)ও একই পথে হাঁটেন। খিলাফতের সূচনাকালে প্রথম যুদ্ধের বাহিনী প্রেরণ করতে গিয়ে তিনি এর সেনাপতি উসামা ইবন যায়েদ (রা.)-এর উদ্দেশে বলেন, ‘হে লোক সকল, দাঁড়াও আমি তোমাদের দশটি বিষয়ে উপদেশ দেব। আমার পক্ষ হিসেবে কথাগুলো তোমরা মনে রাখবে। কোনো খেয়ানত করবে না; বাড়াবাড়ি করবে না; বিশ্বাসঘাতকতা করবে না; (শত্রুদের) অনুরূপ করবে না; ছোট বাচ্চাকে হত্যা করবে না; বয়োবৃদ্ধকেও না আর নারীকেও না; খেজুরগাছ কাটবে না কিংবা তা জ্বালিয়েও দেবে না; কোনো ফলবতী গাছ কাটবে না; আহারের প্রয়োজন ছাড়া কোনো ছাগল, গরু বা উট জবাই করবে না। আর তোমরা এমন কিছু লোকের সামনে দিয়ে অতিক্রম করবে যারা গির্জাগুলোয় নিজেদের ছেড়ে দিয়েছে। তোমরাও তাদের তাদের এবং তারা যা ছেড়ে নিজেদের জন্য তাতে ছেড়ে দেবে।’ [মুখতাসারু তারিখি দিমাশক : ১/৫২; তারিখুত তাবারি]।

অমুসিলমদের সঙ্গে মহানবীর মহানুভবতা

কোনো মুসলিম যদি কোনো অমুসলিমের প্রতি অন্যায় করেন, তবে রোজ কিয়ামতে খোদ নবী (সা.) তার বিপক্ষে লড়বেন বলে হাদিসে এসেছে। একাধিক সাহাবি থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সাবধান! যদি কোনো মুসলমান কোনো অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে তার অধিকার খর্ব করে, তার ক্ষমতার বাইরে কষ্ট দেয় এবং তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক নিয়ে যায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি তার পক্ষে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ উত্থাপন করব।’ (আবু দাঊদ : ৩০৫২)।

অপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে মুসলমান কর্তৃক নিরাপত্তাপ্রাপ্ত কোনো অমুসলিমকে হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ তার ঘ্রাণ পাওয়া যায় চল্লিশ বছরের পথের দূরত্ব থেকে।’ (বুখারি: ৩১৬৬)।

আরেক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবি বাকরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি চুক্তিতে থাকা কোনো অমুসলিমকে অসময়ে (অন্যায়ভাবে) হত্যা করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (আবু দাউদ : ২৭৬০; নাসাঈ : ৪৭৪৭) {শায়খ আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।}

ঐতিহাসিক বিদায় হজের দীর্ঘ ভাষণে রাসূলুল্লাহ (সা.) সমাজ ও রাষ্ট্রের সব দিক ও বিভাগ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি মাতা-পিতার হক, সন্তানসন্ততির হক, আত্মীয়স্বজনদের হক, অনাথ ও দরিদ্রদের হক, প্রতিবেশীর হক, মুসাফিরের হক, চলার পথের সঙ্গী বা পথচারীর হক, দাস-দাসী বা চাকর-চাকরানীর হক এমনকি ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমের হক সম্পর্কেও নির্দেশনা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজে মুসলমানদের কাছে অমুসলিমদের আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে আমানত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মুসলমানদের তিনি অমুসলিমদের নিরাপত্তা দানের নির্দেশ দিয়েছেন।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজনে অমুসলিমদের জান-মালের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদের ইজ্জত-আব্রু ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তার জন্য প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ অমুসলিম জনগোষ্ঠী তারাও মানুষ, তারাও আল্লাহর বান্দা। ইসলাম সম্পর্কে তারা ভুল বা বিভ্রান্তির শিকার হলে তাদের প্রতি আক্রমণ না করে তাদেরকে মূল সত্য এবং ইসলামের মহানুভতা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।

ইসলামের দৃষ্টিকোণে দুনিয়ায় মানুষের প্রাণ হরণ কিংবা জীবননাশের চেয়ে বড় অপরাধ আর হয় না। পবিত্র কোরআনে তাই একজন মানুষের হত্যাকে পুরো মানবজাতির হত্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করা কিংবা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া যে কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে তাকে বাঁচাল, সে যেন সব মানুষকে বাঁচাল।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৩২)।

মানুষের প্রাণহানি ঘটানোকে যেখানে বলা হয়েছে পুরো মানব জাতিকে হত্যার সমতুল্য, সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকে গণ্য করা হয়েছে হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ হিসেবে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর ফিতনা হত্যার চেয়ে কঠিনতর।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯১)।

অতএব, বাংলাদেশের রামুতে কয়েক বছর আগে একটি অন্যায়কে কেন্দ্র করে যা করা হয়েছে, তাও ন্যায়সঙ্গত হয়নি। এক জনের অপরাধে দশ জনকে শাস্তি প্রদান কোনো মুসলমানের কাছে সমর্থনযোগ্য নয়। বিভিন্ন সময় দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে পূজোমণ্ডবে অনাকাঙ্ক্ষিত হামলা হয়। প্রতিমা ভাঙচুর করে দুষ্কৃতকারীরা। প্রতিটি নির্বাচনের আগে-পরে রাজনৈতিক মতবাজরা বিভিন্ন মন্দিরে হামলা করে। এসব কখনো ভালো ফল বয়ে আনে না। শান্তি ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ নষ্ট করে। পৃথিবীর কাছে একটি মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ছোট করে। ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমরা ভুল বার্তা পান।

আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলামের শান্তিপূর্ণ ও উদারনৈতিক শিক্ষার সৌজন্যেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পরমতসহিষ্ণুতার জন্য বরাবর সারা বিশ্বের সুনাম কুড়িয়েছে। এ দেশের মুসলমান সব সময় তাদের ধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তবর্তী যে সরকার গঠন হয়েছে, সেখানে বাইরের উসকানিতে বিভিন্ন মন্দিরে হামলা হয়েছে এবং হামলার চেষ্টা হয়েছে। সুখের কথা, এমন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন মাদরাসা ও ইসলামী সংগঠনের উদ্যোগে মন্দির পাহারা দেশ-বিদেশে সুধিজনের সুনাম কুড়িয়েছে। এ দেশে মসজিদ-মন্দিরে পাশাপাশি স্ব-স্ব ধর্মের ইবাদত হয়। পবিত্র মাহে রমজানে হিন্দুরা সাড়ম্বরে অষ্টমী পালন করে। খ্রিস্টানরা জাঁকজমকভাবে বড়দিন উদযাপন করেন। বৌদ্ধ ও অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব নির্বিবাদে পালন করেন।

পক্ষান্তরে আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভারতে ক’দিন পরপরই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু কর্তৃক মুসলিমরা আক্রান্ত হন, আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারে এ সেদিনও রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে সাধারণ বৌদ্ধ থেকে নিয়ে শান্তিপ্রিয় হিসেবে খ্যাত ভিক্ষুরা পর্যন্ত নির্বিচার হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালাল মুসলমানের বিরুদ্ধে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।

নারী-শিশু-বৃদ্ধকে অকাতরে হত্যা করা হয়েছে। এ দেশের কোটি মুসলমানের হূদয় কেঁদেছে তখন, তবে কেউ এ দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু বা বৌদ্ধদের ওপর সে ক্ষোভ দেখাননি।

আমেরিকায় মহানবীকে (সা.) অবমাননা করে চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘটনায় যখন সারা বিশ্ব উত্তাল, বিশ্বের দুইশ কোটি মুসলিমের হূদয়ে যখন জ্বলছে ক্ষোভের দাবানল, তখন একের পর এক ফ্রান্সের সাপ্তাহিকে, তারপর স্পেনের একটি ম্যাগাজিনে মহানবীর ব্যঙ্গ কার্টুন প্রকাশের ঘটনা বিশ্ব মুসলিমকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। বাক-স্বাধীনতার নামে অন্যের পবিত্র ধর্মানুভূতিতে আঘাত কোনো ধর্মই অনুমোদন করে না। তারপরও ঘটছে এমন ঘটনা। স্বল্প বিরতিতে ক’দিন পরপরই ঘটছে এর পুনরাবৃত্তি। এসব বর্বর ঘটনার পর নিন্দা ও প্রতিবাদের বিষয়টি স্বাভাবিক, সমর্থনযোগ্য এবং করণীয়ও বটে। কিন্তু আইন হাতে তুলে নিয়ে নির্বিচারে সহিংসতা অন্যায়। এক জনের অপরাধে দশজনকে শাস্তি দেওয়া অনুমোদিত নয়। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সঙ্গে সাক্ষদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান হও। কোনো কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদের কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর। এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৮)।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ