ঢাকা, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ১ রবিউস সানি ১৪৪৬

আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের বাসনা

প্রকাশনার সময়: ২২ আগস্ট ২০২৪, ০৯:১৩

আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ অবশ্যম্ভাবী এবং এটা জিন ও মানুষের জন্য অনিবার্য, তারা তা থেকে পালাতে পারবে না। এটা হচ্ছে হাশরের দিন, যেদিন মানুষ তাদের কাজের প্রতিফল পাবে। সেদিন কেউ তার প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিজয়ী হবে; প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হয়ে তার চোখ শীতল হবে। এটি হবে সম্মান ও বিজয়ের সাক্ষাৎ। আবার কেউ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার জন্য সেই সাক্ষাৎ লজ্জা ও আফসোসের হবে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ! তোমাকে রবের কাছে পৌঁছা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, অতঃপর তুমি তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করবে।’ (সূরা আল-ইনশিকাক: ৬)। নবী (সা.) বলেছেন, ‘আর তোমরা অচিরেই তোমাদের রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে; অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন।’ (সহিহ বুখারি)।

আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস এবং সর্বদা তা মনে রাখা বান্দাকে তার প্রভুর সঙ্গে অঙ্গীকার পূরণে, তাঁর দ্বীনের ওপর দৃঢ় থাকতে, তাঁর আনুগত্যে ধৈর্য ধারণ করতে, তাঁর উত্তম প্রতিদানের আশা রাখতে এবং তাঁর কঠোর শাস্তিকে ভয় পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের জন্য অগ্রিম (পাথেয়) প্রেরণ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় তোমরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। আর মুমিনদেরকে সুসংবাদ দাও।’ (সূরা আল-বাকারা: ২২৩)।

এটা বান্দার জন্য বিপদ ও দুঃখ-কষ্ট এবং ফিতনার ঝড় ও বিপর্যয় মোকাবিলা করার সেরা সম্বল। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যাদের প্রত্যয় ছিল আল্লাহর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হবে তারা বলল, আল্লাহর হুকুমে কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাভূত করেছে! আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (সূরা আল-বাকারা: ২৪৯)।

প্রত্যেক বান্দা যিনি তার প্রভুর সাক্ষাৎ লাভের জন্য আমল করেছেন এবং সেই দিনটির জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন, তার উচিত আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভে আগ্রহী থাকা। কারণ বান্দা তো তার এমন মাওলার সঙ্গেই সাক্ষাৎ করবে যার প্রতি মহব্বতকে তার সব ভালোবাসার বস্তুর ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন এবং তাঁরই সন্তুষ্টিকে সব ইচ্ছার চেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন।

আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের তীব্র আকাঙ্ক্ষা হূদয়ে এমন প্রশান্তির হওয়া প্রবাহিত করে, যা পার্থিব ফেতনা থেকে মুক্তি দেয় এবং কষ্ট হালকা করে। বস্তুত যে ব্যক্তি আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে আনন্দিত এবং সাক্ষাৎ লাভে আগ্রহী হয়, সেই তো এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় তৃপ্তি অর্জন করে।

আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের আকাঙ্ক্ষা এক তীব্র ইচ্ছা, যা বান্দাকে তার প্রভুর নিকটবর্তী হতে উদ্বুদ্ধ করে। এটি আল্লাহর সঙ্গে ভালো সম্পর্কের ফলস্বরূপ। প্রকৃতপক্ষে ওই ব্যক্তিই আল্লাহর সাক্ষাৎকে ভালোবাসে ও তা আকাঙ্ক্ষা করে, যে নিজের হূদয়কে আল্লাহর একত্ব, তাঁর প্রতি ভালোবাসা এবং আশা ও ভয় দ্বারা পরিপূর্ণ করেছে, অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করেছে এবং শুধু তাঁর সন্তুষ্টির জন্য বিশুদ্ধভাবে সৎ আমল করেছে, অন্য কারো আশায় নয়। আল্লাহ বলেন, ‘কাজেই যে তার রব-এর সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকাজ করে ও তার রব-এর ইবাদাতে কাউকেও শরিক না করে।’ (সূরা আল-কাহফ: ১১০)।

আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহর প্রতি আকাঙ্ক্ষা এবং তাঁর সাক্ষাৎ লাভের আগ্রহ আল্লাহর বন্ধুদের জন্য এক অগ্রিম মহাপুরস্কার। তিনি তাদের এ আকাঙ্ক্ষার মাধ্যমে সান্ত্বনা দেন, তাদেরকে সাক্ষাতের মিষ্টতা মৃত্যুর আগেই আস্বাদন করান এবং তাদের আগমনের আগেই এটা দ্বারা তাদেরকে স্বাগত জানান। আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহর সাক্ষাৎ কামনা করে (সে জেনে রাখুক,) আল্লাহর নির্ধারিত কাল নিশ্চয় আসবে। আর তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা আল-আনকাবুত: ৫)।

নবী (সা.) বলেছেন, ‘যখন মুমিনের মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তার সম্মানিত হওয়ার খোশখবর শোনানো হয়। তখন তার সামনের খোশখবরের চেয়ে তার কাছে অধিক পছন্দনীয় কিছুই থাকে না। কাজেই সে তখন আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করাকেই ভালোবাসে, আর আল্লাহও তার সাক্ষাৎ ভালোবাসেন।’ (সহিহ বুখারি) এ হাদিসে মুমিনদের জন্য বিশাল সুখবর, মৃত্যুর কষ্ট হালকাকরণ এবং প্রিয়জনদের হারানোর সময় মুসলমানের জন্য সান্ত্বনা রয়েছে।

এই তো মুত্তাকীদের ইমাম এবং ধার্মিকদের আদর্শ আমাদের নবী (সা.), তাঁর হূদয় আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় পরিপূর্ণ ছিল। তাই তিনি দুনিয়াতে চিরস্থায়িত্ব ও পৃথিবীর সব ধন-সম্পদ এবং পরবর্তীতে জান্নাত লাভের পরিবর্তে সেটাকেই (আল্লাহর সাক্ষাৎ) বেছে নিয়েছিলেন। আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.)-এর মুক্তদাস আবু মুয়াইহিবা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) গভীর রাতে আমাকে ডেকে পাঠালেন। তারপর তিনি বললেন, ‘হে আবু মুয়াইহিবা! আমাকে বাকি’ কবরস্থানের অধিবাসীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং তুমি আমার সঙ্গে চলো। তাই আমি তার সঙ্গে সেখানে গেলাম। যখন তিনি কবরবাসীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, তখন বললেন, ‘হে কবরবাসী! তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। লোকেরা যে অবস্থায় সকালে উপনীত হচ্ছে তার চেয়ে ভালো অবস্থায় সকাল করার জন্য তোমাদের অভিনন্দন। অন্ধকার রাতের টুকরার মতো ফিতনা ছুটে আসছে। একটির পেছনেই আরেকটি আসছে। পরবর্তীটি পূর্ববর্তীটির চেয়ে নিকৃষ্টতর।’

তারপর আমার দিকে ফিরে তিনি বললেন, ‘হে আবু মুয়াইহিবা! আমাকে দুনিয়ার ধনভাণ্ডারের চাবিগুচ্ছ এবং দুনিয়াতে চিরস্থায়িত্ব, অতঃপর জান্নাত দেওয়া হয়েছিল। এরপর আমাকে এগুলো এবং আমার রবের সাক্ষাৎ ও জান্নাত— এ দুটির মাঝে একটিকে বেছে নিতে বলা হয়েছে।’ আমি বললাম, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কোরবান হোক হে আল্লাহর রাসূল! আপনি দুনিয়ার ধনভাণ্ডারের চাবিগুচ্ছ ও দুনিয়াতে চিরদিন থাকার সুযোগ, অতঃপর জান্নাত গ্রহণ করুন। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম, না, হে আবু মুয়াইহিবা! বরং আমি আমার রবের সাক্ষাৎ ও জান্নাতকেই বেছে নিয়েছি।’

এরপর তিনি বাকির কবরবাসীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন, অতঃপর ফিরে এলেন। এরপরই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সেই ব্যথা শুরু হল যাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। (সুনানে দারেমী) আর মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে— ‘তারপর তিনি মাত্র সাত বা আট দিন বেঁচে ছিলেন।’

এই হাদিসে স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রতি সবচেয়ে বেশি মহব্বত পোষণকারী ছিলেন। তাঁকে এই বিশেষ এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে, যার পরিণতি হলো আল্লাহর সাক্ষাৎ ও জান্নাত লাভ। তাই তিনি স্বীয় প্রভু ও মাহবুবের সঙ্গে তাড়াতাড়ি সাক্ষাৎ করতে পছন্দ করেছেন। আর এটাই ইবরাহিমী মিল্লাতের বাস্তবতা।

এই পৃথিবীতে নবী (সা.)-এর শেষ কথা ছিল, ‘হে আল্লাহ! আমার গুনাহ মাফ করুন, আমার প্রতি দয়া করুন এবং আমাকে মহান বন্ধুর সঙ্গে মিলিত করুন।’

নবী (সা.)-এর একটি দোয়া হলো, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে (জান্নাতে) তোমার প্রতি দৃষ্টি দেয়ার স্বাদ গ্রহণ করতে চাই এবং ক্ষতিকর কষ্ট ও পথভ্রষ্টকারী ফাসাদে পড়া ছাড়া তোমার সাক্ষাতের আশা-আকাঙ্ক্ষা করি।’ এভাবেই নবী (সা.) তাঁর দোয়ায় দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বোচ্চ নেয়ামতকে একত্রিত করেছেন।

সৎকাজ, সদাচরণ, আনুগত্য ও উত্তম ঈমানে যারা নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসরণকারী, তাদের প্রত্যেকের জন্য আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভের আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহের একটি অংশ রয়েছে। এ আকাঙ্ক্ষার পরিমাণ তার ঈমানের ওপর নির্ভর করে, যা এমন সৎ আমল দ্বারা প্রমাণিত হয় যা আল্লাহর সঙ্গে সত্যিকারের সম্পর্ক ও সাক্ষাতের আকাঙ্ক্ষা অবধারিত করে, এমনকি তার নিকট আগমনের মুহূর্ত পর্যন্ত।

দ্বিতীয় খুতবা

যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য চূড়ান্ত সম্মান হচ্ছে, তাঁর সাক্ষাতে আগ্রহী ও আকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি সুখময় স্থায়ী আবাসে স্বীয় রবের সাক্ষাৎ লাভ করবে। এ ব্যাপারে দয়াময় আল্লাহতায়ালা তাঁর নেক বান্দাদের সুসংবাদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যারা ইহসানের সঙ্গে আমল করে তাদের জন্য আছে জান্নাত এবং আরও অতিরিক্ত।’ (সূরা ইউনুস: ২৬)।

অতঃপর তাঁর রাসূল অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় এ সুসংবাদ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘জান্নাতিরা জান্নাতে প্রবেশ করার পর এক ঘোষণাকারী ডেকে বলবে, জান্নাতিগণ! নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহতায়ালার একটি প্রতিশ্রুতি রয়েছে যা তিনি এখন পূর্ণ করবেন। তারা বলবে, তা কী? আল্লাহতায়ালা কি আমাদের চেহারাগুলো আলোকিত করেননি, আমাদের (সৎ কর্মের) পাল্লা ভারী করেননি, আমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাননি এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেননি? রাসূল (সা.) বলেন, তখন আল্লাহতায়ালা আবরণ উন্মুক্ত করবেন এবং তারা তাঁর দিকে তাকাবে। আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তাদেরকে তাঁর দর্শনের চাইতে অধিক প্রিয় ও অধিক নয়নপ্রীতিকর আর কিছু দান করেননি। আর এটাই হলো সেই অতিরিক্ত। অতঃপর তিনি তেলাওয়াত করেন— ‘যারা ভালো কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে শুভ পরিণাম (জান্নাত) এবং আরও বেশি।’ (ইবনে মাজাহ)।

১৬ আগস্ট ২০২৪ মদিনা মুনাওয়ারার

মসজিদে নববীতে প্রদত্ত জুমার খুতবার

ভাষান্তর— হারুনুর রশীদ ত্রিশালী

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ